কাষ্ঠগোলক, হাতলওয়ালা তক্তা আর ত্রিকাঠির খেলা
১৮৭৪ সালে ক্রিকেটে প্রথম টেস্টিকুলার গার্ড চালু হয়, কিন্তু ক্রিকেট হেলমেট চালু করতে সময় লাগে ১০০ বছর এবং নিতে হয় বেশ কিছু মৃত্যুর পরিসংখ্যান। নাজুক স্থানে বলের আঘাতে মৃত্যুর বিবরণ না পাওয়া গেলেও মাথায় বলের আঘাতে মৃত্যু তো হামেশাই ঘটছে। রমন লাম্বা ক্রিকেটের জন্য প্রাণ দেন ঢাকাতেই।
ব্রিটেনের সাসেক্সে হরস্টেড কিনস মাঠে ২৮ আগস্ট ১৬২৪ ছুড়ে দেওয়া কাষ্ঠতক্তা 'জ্যাসপার ভিনালের মাথায় গিয়ে লাগল, খেলা থেকে তাকে প্রত্যাহার করে নিতে হলো। দুই সপ্তাহ পরে তার মৃত্যু হলো। ২৩ বছর পর ১৬৪৭-এ ওয়েস্ট সাসেক্সের সেলসি মাঠে একই জায়গায় আঘাত গিয়ে লাগল এমনই একজন খেলোয়াড় হেনরি ব্র্যান্ডের মাথায়। ১৭৫১ সালের ১৪ জুন ফ্রেডরিকের (প্রিন্স অব ওয়েলস) মাথায় কাষ্ঠগোলক লেগেই মস্তিষ্কের রক্তনালিতে এমবোলিজম সৃষ্টি করল।
রাজা দ্বিতীয় জর্জের পুত্র, ব্রিটিশ সিংহাসনের জন্য ঘোষিত রাজপুত্র বলের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, মৃত্যু ঘটল ২০ মার্চ ১৭৫১, সিংহাসনের খুব কাছাকাছি পৌঁছার পর ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই প্যাট্রন ক্রিকেটের বলের কাছেই প্রাণ দিলেন। ১৪ জুন ১৭৬৪ জেমস বালশেন মাথায় বলের আঘাত পেয়ে সারে কাউন্টিতে মারা গেলেন।
নটিংহামশায়ারের ফাস্ট ক্লাস ক্রিকেটার জর্জ সামার ১৮৭০ সালে লর্ডস মাঠে এমসিসির বিরুদ্ধে খেলছিলেন। বল করছিলেন তখনকার ফাস্ট বোলার জন প্ল্যাটস। বলটা ব্যাটারের মাথায় আঘাত করল, তিনি পড়ে গেলেও আবার উঠে দাঁড়ালেন। তেমন কিছু হয়নি মনে করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। ট্রেনে চড়ে দলের সাথে তিনি নটিংহামশায়ার চলে যান। ঠিক চার দিন পর ১৯ জুন ১৮৭০ সাল ২৫ বছর বয়সে মাথায় আঘাতের কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অনুতপ্ত জন প্ল্যাটস বাকি জীবন আর ফাস্ট বল করেননি।
এমসিসির অলরাউন্ডার ফ্রেডরিক র্যানডন সিনিয়র খেলার পাশাপাশি আম্পায়ার হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। খেলার সময়ই ১৮৮১ সালে লর্ডস মাঠে একটি বল তার মাথায় আঘাত করে; আঘাতটা মারাত্মক ছিল, প্রায় দুই বছর চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৮৮৩-এ ফেব্রুয়ারিতে তার মৃত্যু হয়। ১১৭৫ সালে কুইন্সল্যান্ডের ব্রিসবেন মাঠে ব্যাট করছিলেন মার্টিন বেডকোবার, বল করছিলেন তখনকার বিশ্বের দ্রুততম বোলার জেফ থম্মসন। বলটা মাথায় নয়, হৃৎপিণ্ড বরাবর আঘাত করে এবং ব্যাটার মারা যান। মার্টিন এবং জেফ থম্মসন দুজনেই বন্ধু এবং একই ফ্ল্যাটে থাকতেন।
রমন লাম্বার ঢাকার মাঠের ট্রাজেডি তো সেদিনের। আবাহনী ক্লাবের হয়ে খেলতে এসেছিলেন ভারতের রমন লাম্বা। খেলা ছিল মোহামেডান ক্লাবের বিরুদ্ধে ঢাকা স্টেডিয়ামে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮। বল করছিলেন সাইফুল্লাহ খান, ব্যাটিংয়ে মেহরাব হোসেন অপি। ব্যাটে লেগে বলটা ফিল্ডার রমন লাম্বার মাথায় আঘাত করে উইকেটকিপার খালেদ মাসুদের গ্ল্যাভসে ফিরে আসে। আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছু হয়েছে বলে মনে না হলেও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে তার অবস্থার অবনতি ঘটছিল। তিনি আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে বললেন, আমি তো মরে যাচ্ছি। তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন, তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হলো।
দিল্লি থেকে শ্রেষ্ঠ নিওরো সার্জনও এলেন, কিন্তু রক্ষা পেলেন না রমন। ২৩ ফেব্রুয়ারি লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বিচ্ছিন্ন করা হলো। শোকের ছায়া নামল ক্রিকেট অঙ্গনে। তেলেগু ও হিন্দিতে তার জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র জার্সি নির্মিত হয়েছে।
মাথায় মারাত্মক আঘাত ও মৃত্যুর ঘটনার পরও হেলমেট পরার কঠোর বাধ্যবাধকতা নেই। ২০১৭ সালে আইসিসি হেলমেট পড়ার নির্দেশনা দিলেও তার বাস্তবায়ন করা না করার দায়িত্ব দিয়েছে দেশীয় ক্রিকেট কর্তৃপক্ষকে। আধুনিক ক্রিকেটে টেস্ট ম্যাচে প্রথম হেলমেট পরে মাঠে নামে ইংল্যান্ডের ডেনিস এমিস ১৯৭৮ সালে।
শুরুতে এটা ছিল মোটরবাইকচালকদের হেলমেট। অবশ্য তার আগে প্রথম শ্রেণির খেলায় প্যাটসি হেলমেট পরতে শুরু করেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভিভিয়ান রিচার্ডস মাথা রক্ষার এই শিরোস্ত্রাণ পরাকে কাপুরুষোচিত বলেছেন। ১৯৯১ সালে তিনি অবসরে যান, কখনো মাথা ঢাকতে কিছু ব্যবহার করেননি। ভারতের লিটল মাস্টার সুনীল গাভাস্কর হেলমেট পরতেন না। কারণ, তার মতে, হেলমেট ব্যাটারের রিফ্লেক্স তাৎক্ষণিক সারা দেবার ক্ষমতা শ্লথ করে দেয়। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন অ্যালাস্টেয়ার কুক অস্বস্তি সৃষ্টি করে বলে আইসিসির নির্দেশনা না মেনে হেলমেট পরতে অস্বীকার করেন।
কাঁধে এসে বাউন্সার আঘাত করলে অমনি অজ্ঞান হয়ে যান অস্ট্রেলিয়ান হিউজেস। মৃত্যু হয় তার। কাষ্ঠেগোলক আর হাতলওয়ালা তক্তার এই খেলা আম্পায়ারের জন্যও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। মাথায় বল লেগে ১৯১৪ সালে মারা গেছেন ইসরায়েলি আম্পায়ার হিলেল অস্কার।
সেই মারাত্মক কাষ্ঠগোলক তৈরির উপাদান ও ওজন নির্ধারণ করে দিয়েছে আইসিসি, বলের ওজন ১৬৩ গ্রাম। ১৭৭৪ সালে ইংলিশ ব্যাটার টমাস হোয়াইট প্রায় তিন উইকেট দূরত্বের সমান চওড়া ব্যাট নিয়ে মাঠে নামেন, উইকেট ঢাকা পড়ে যায় ব্যাটে। তার বিরুদ্ধে অন্যরা আপত্তি জানান। আপত্তি বহু দূর গড়ায়, ইচ্ছেমতো আকারের হাতলওয়ালা তক্তা ব্যবহার করা যাবে না। সিদ্ধান্ত হয় কোনো ব্যাট ৪.২৫ ইঞ্চির বেশি চওড়া হতে পারবে না।
সেইম সাইড সংঘর্ষ
অনূর্ধ্ব উনিশে ভারতের বাংলা দলের ক্যাপ্টেন অঙ্কিত কেশরী কুড়ি বছরে পৌঁছে অনূর্ধ্ব ২৩ দলের অন্তর্ভুক্ত হলেন। খেলাটা ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্ট লেক ক্যাম্পাস ক্রিকেট মাঠে। তিনি ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল দলের দ্বাদশ ব্যক্তি।
খেলা শেষ হবার মাত্র দুই ওভার বাকি থাকতে তাকে অর্ণব নন্দীর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। নকআউট পর্বে ইস্ট বেঙ্গলের প্রতিপক্ষ ভবানীপুরের ব্যাটার ক্যাচ উঠিয়ে দেন। ক্যাচটা অঙ্কিতকে ধরতেই হবে। অপর ফিল্ডার সৌরভ মন্ডল ভাবলেন ক্যাচটা তিনিই ধরবেন। একেবারে বলের তলদেশে দুজনের মধ্যে ভয়ংকর সংঘর্ষ হয়। মাথায় আঘাত লাগে অঙ্কিতের এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এ অবস্থায় তিন দিন থাকার পর প্রতিশ্রুতিশীল অলরাউন্ডার অঙ্কিত কেশরী ২৯ এপ্রিল ২০১৫ মৃত্যুবরণ করেন।
এক চোখ এক হাত এক পা-নেলসন
ব্রিটিশ নৌবীর সেনাপতি অ্যাডমিরাল নেলসন যখন জীবনের শেষ প্রান্তে, তখন তার চোখ একটি, হাত একটি, পা একটি, সে জন্য ক্রিকেটাররা ১১১ (১১১) রানকে বলে থাকে নেলসন। আর এই রানকে একই সঙ্গে দুর্ভাগ্যের প্রতীকও মনে করে। তিনটি উইকেট ওপরে কেনো বেইল নেই।
অ্যাডমিরাল নেলসনের এক চোখ এবং এক হাত থাকার বিষয়টি সত্য হলেও শেষ পর্যন্ত তার দুটো পা-ই বহাল ছিল। তবুও ক্রিকেটে নেলসন প্রচলিত হয়ে আসছে। কারও রান যখন ২২২, তখন বলা হয় ডাবল নেলসন। ব্রিটিশ ব্যাটার গ্রাহাম গুচ ১৯৯০ সালে লর্ডস মাঠে ভারতের বিরুদ্ধে ট্রিপল নেলসন করেছেন।
অলিম্পিকে ক্রিকেট ছিল, নেই, থাকবে!
১৮৯৬ সালের প্রথম অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে। ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় অন্তর্ভুক্ত হলেও শেষ মুহূর্তে ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বী দল না পাওয়ায় ইভেন্টটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯০০ সালের অলিম্পিক প্যারিসে। এবার ক্রিকেট হবেই, ব্রিটেন অবশ্যই থাকবে। ফ্রান্সও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে।
আরও দুটি দেশ বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস অংশগ্রহণের আবেদন জানিয়েছে। নকআউট পদ্ধতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্তও দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে থেকে যায় কেবল গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স। একটি খেলাই হয়, জয়-পরাজয় এতেই নির্ধারণ হয়ে যায়।
১৯ আগস্ট ১৯০০ খেলা শুরু হয়। টস জিতে ব্রিটেন ব্যাট হাতে নেয় এবং ১১৭ রান করে। প্রথম ইনিংসে ৭৮ রানে ফ্রান্সকে অলআউট করে দেয়। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেটে ১৭৫ রানের টার্গেট দেয়। কিন্তু দ্বিতীয় ইংনিসে ফ্রান্সের ধস নামে, ২৩ রানে সকলেই আউট হয়ে গেলে ব্রিটেন ১৫৮ রানে জিতে যায়। দুদিনের এই খেলা শেষ হতে তখনো পাঁচ মিনিট বাকি ছিল।
ব্রিটিশ ওপেনিং ব্যাটার সি বি কে বিচক্রফট প্রথম ইনিংসে ২৩ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৫০ রান করেছে। অবশ্য দ্বিতীয় ইনিংসে সর্বোচ্চ ৫৯ রান করেন বাওয়ারম্যান। ফ্রেডরিক ক্রিশ্চান ৭ উইকেট নেন।
১৯০৪ সালের সেইন্ট লুইস অলিম্পিকে ভৌত সুবিধার অভাব এবং আগ্রহী দেশের ঘাটতি থাকায় ক্রিকেট বাদ দেওয়া হয়। পরবর্তী প্রায় সোয়া শ বছর অলিম্পিকে আর ক্রিকেটের ঠাঁই হয়নি। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি আশা করছে ২০২৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিকে ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত হবে; তারপর ক্রিকেট সগৌরবে অলিম্পিকের স্থায়ী ইভেন্টে পরিণত হবে।
স্লো ব্যাটিং টি-টোয়েন্টির দর্শনবিরোধী
কুড়ি ওভারের খেলাতে সেখানে ২০০ ছাড়িয়ে যাবার চিন্তাও থাকে, সেখানে স্লো ব্যাটিংয়ের সুযোগ কোথায়। উইকেটে সেটেল্ড হওয়া বলতে যা বোঝায়, সে সুযোগ টি-টোয়েন্টির ব্যাটারের নেই। তাকে নেমেই পিটিয়ে খেলতে হবে। একটা 'ডাক' অনেক পিছিয়ে নিয়ে যাবে। এই সুযোগ ৫০ ওভারের ম্যাচেও নেই।
টেস্ট ম্যাচের কয়েকটি স্লো রানের তথ্য তুলে ধরতেই হয়। ২০০৫-০৬ মৌসুমে অকল্যান্ড মাঠে নিউজিল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলায় ১০১ মিনিট ক্রিজে থেকে ব্যাটার জিওফ অ্যালট শূন্য রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরে এসেছেন। তিনি ৭৭টি বল খেলেছেন। অ্যালট এবার নবাব পতৌদির ৩৩ বছর ধরে রাখা রেকর্ডটি ভেঙেছেন।
১৯৭১-৭৩ মৌসুমে বোম্বে (মুম্বাই) মাঠে ভারত বনাম ইংল্যান্ডের খেলায় দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী ক্যাপ্টেন পতৌদি ১০১ মিনিট ক্রিজে থেকে ৮৪টি বল মোকাবিলা করে ৫ রান করেছেন। ২০১১-১৩ মৌসুমে ইংল্যান্ড বনাম নিউজিল্যান্ডের খেলায় অকল্যান্ড মাঠে স্টুয়ার্ট বর্ড ১৩৭ মিনিটে উইকেটে থেকে ৭৭ বল খেলে একটি বাউন্ডারিসহ মোট ৬ রান করেছেন।
১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার খেলায় অস্ট্রেলিয়ার ডেমিয়েন মার্টিন ১০৩ মিনিট মাঠে থেকে ৫৯ বল খেলে রান করেছেন ৬ আর ১২৩ মিনিট ক্রিজে থেকে ১০১ বল খেলে ৭ রান করেছেন ইংল্যান্ডের ডানহাতি ব্যাটার জিওফ্রে মিলার। তিনি খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মেলবোর্ন মাঠে ১৯৭৯ সালে।
১৯৯৪ সালের আহমেদাবাদ টেস্টে রাজেশ চৌহান শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৩২ মিনিটে ৯৬ বল খেলে একটি বাউন্ডারির সাহায্যে মোট ৯ রান করেছেন। ১৯৪৬-৪৭ মৌসুমে অ্যাডেলেইড টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের গডফ্রে ইভান্স ১৩৩ মিনিটে ৯৬ বল খেলে ১টি চারসহ মোট ১৪ রান করেছেন। ভারতের রাহুল দ্রাবিড়েরও একটি স্লো ইনিংস আছে। ২০০৭ সালে ওভাল মাঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৪০ মিনিটে উইকেটে পাহারা দিয়ে ৯৬ বলে খেলে একটি বাউন্ডারিসহ মোট ১২ রান করেছেন।
সবচেয়ে বেশি সময় উইকেটে থাকার রেকর্ড ১৯৫৭-৫৮ ব্রিজটাউন মাঠে পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলায়। হানিফ মোহাম্মদ ৯৭০ মিনিট মাঠে ছিলেন। তবে তিনি হতাশ করেননি তার দেশকে; ৩৩৭ রানের একটি ঝকঝকে ট্রিপল সেঞ্চুরি উপহার দিয়েছেন। এ সময়ে সেঞ্চুরি চারটি হলেও তিনি টি-টোয়েন্টির জন্য উপযুক্ত নন। সব শুদ্ধ বলই হবে ১২০টি।
কাজেই এখানে ধীরস্থির হয়ে একটু একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া ব্যাটারের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন 'এক্সক্লুসিভ ব্যাটার'-এর। নেমেই যিনি ওভার বাউন্ডারি, বাউন্ডারি হাঁকিয়ে যেতে পারেন, তেমন বিস্ফোরণ ঘটানো খেলোয়াড়ই টি-টোয়েন্টির চাই।
২৫০ কোটি মানুষ ১৮০ দেশ
যত অভিজাত খেলাই হোক, ক্রিকেট নিজেই আভিজাত্যের বেড়াজাল ভেঙেছে। আশুতোষ গোয়াড়িকার পরিচালিত আমীর খান অভিনীত লগান সিনেমাটি যারা দেখেছেন, স্বীকার করবেন ক্রিকেট সত্যিই ধনী-নির্ধন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ব্রাহ্মণ-চন্ডাল, ব্রিটিশ লর্ড ও ভারতীয় প্রজার মধ্যকার সময় বিভাজনটি অন্তত খেলার সময়টাতে হলেও ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।
পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। পৃথিবীতে ফুটবল দর্শকের সংখ্যা সাড়ে তিন শ কোটি। ক্রিকেট মাত্র ১০০ কোটি পিছিয়ে। একসময় ফুটবলের এক-দশমাংশ দর্শকও ক্রিকেটের ভাগ্যে জোটেনি, এখন ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশে একটি গ্রামের সন্ধানও মিলবে না, যেখানে ব্যাটের বদলে হাতলওয়ালা তক্তা আর গোলাকার যে কোনো একটি বস্তু দিয়ে শিশু-কিশোরেরা, অনেক ক্ষেত্রে কিশোরীরাও ক্রিকেট খেলছে না।
ষোড়শ শতকে ক্রিকেট আসলে ইংরেজ শিশুদের খেলাই ছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশ বিস্তারের সাথে সাথে সদ্য কৈশোর পেরোনো ইংরেজ তরুণেরা যখন রাইটার হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, খেলাটা নতুন জায়গায় তারাই চালু করে। এত সাদা তরুণ কোথায় পাবে তখন কালো ও বাদামিদেরও ডাক পড়ে। ব্রিটিশ নারীরা ১৭০০ শতকেও ক্রিকেট খেলছে।
ক্রিকেট-স্মৃতি: আত্মকথন
আমার যে ক্রিকেটীয় মেধা, তাতে সেকালের থার্ড ডিভিশন কোনো টিমে দ্বাদশ কি ত্রয়োদশ খেলায়াড় হিসেবে আমার ঠাঁই হলেও হতে পারত। ছোটবেলা থেকেই চশমাধারী হবার কারণে মুরব্বিজনেরা একটি ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন যে লাগসই একটা বাউন্সার ধেয়ে এলে আমার চোখ ও চশমা দুইই যাবে। খেলতে না পারার আফসোস এক আকস্কিক আমন্ত্রণে খানিকটা মিটে গেল।
ইংরেজি সাপ্তাহিক নিউ নেশন পত্রিকার ফিচার এডিটর বিখ্যাত সংস্কৃতি গুরু ওয়াহিদুল হক পুরোনো ইত্তেফাক ভবনের উল্টো দিকের দেশবন্ধু সুইটমিট থেকে আমাকে অনেকটা টেনেই ইত্তেফাকের চারতলায় নিউ নেশন অফিসে নিয়ে গেলেন। বললেন, আমাদের নিয়মিত ক্রীড়ালেখক আফজাল এইচ খানকে (তিনি ইংরেজি সংবাদও পড়তেন) আগামী সপ্তাহ থেকে আর পাওয়া যাবে না। তার কাজটা তোমাকে করতে হবে। রাজি হয়ে গেলাম এবং প্রথম লেখাটাই ক্রিকেট নিয়ে দামাল সামার ক্রিকেট। ওয়াহিদ ভাই বললেন, স্মার্টেস্ট ইংরেজির চর্চা ক্রীড়া সাংবাদিকতায়, ক্রীড়া লেখালোখিতে হয়ে থাকে, সবচেয়ে বেশি ক্রিকেটে।
উনিশ শত উনসত্তরের শুরুতে আমি ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম এমসিসি (মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাবই তখনকার ইংল্যান্ড দল) ইংল্যান্ড দলের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচটি দেখেছি, কতটা বুঝেছি, সে প্রশ্ন থাক। একমাত্র কালো খেলোয়াড় ব্যাসিল ডি আলিভেরা ১১৪ রান করেন, খেলাটি ড্র হয়।
একাত্তরে মার্চের ১ তারিখে ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম কমনওয়েলথ একাদশের খেলাতেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সংসদ অধিবেশন বাতিলের ঘোষণায় লঙ্কাকা- শুরু হয়ে যায়। স্টুডেন্টস আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে এমনিতে অর্ধেক দামে টিকেট মিলত, আমি সবচেয়ে সস্তা ইস্টার্ন গ্যালারির টিকেট কিনি। তখন ইস্টার্ন গ্যালারি উচ্চতায় ছিল ওয়েস্টার্ন গ্যালারির অর্ধেক। যখন গেটে দিয়ে বের হওয়া সম্ভব ছিল না, চেষ্টা করলে হয়তো পদপিষ্ঠ হতাম, গ্যালারির কাছাকাছি নির্মাণকাজের জন্য স্তূপ করা বালির ওপর আরও কজন দুঃসাহসী যুবকের মতো আমিও লাফিয়ে পড়ি।
পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করছিল। জনতার সাথে দৌড়ে স্টেট ব্যাংক পেরিয়ে যাই, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম ছিল স্টেট ব্যাংক, স্বাধীনতার উত্তরকালে বাংলাদেশ ব্যাংক নামায়ন হয়। বাংলাদেশে প্রথম বিদেশি ক্রিকেট দলের সফরে ঢাকা স্টেডিয়ামের ম্যাচে আমার কলেজজীবনের বন্ধু ও মেধাবী ছাত্র নজরুল কাদের লিন্টু বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলে। সুতরাং, আমাকে যেতেই হবে।
ইংলান্ডের ক্রিকেট স্পনসর কর্ণফুলী ইনস্যুরেন্সের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার অতিথি হিসেবে জন্যশূন্য ওভাল মাঠের ভেতরে প্রবেশ করি। তখন আলমগীর কবিরের সীমানা পেরিয়ে সিনেমাটির কথা মনে হয়। স্বপ্নপ্রবণ নায়ক জনশূন্য স্টেডিয়ামে যখন ফুলটস বলে ব্যাট চালাল, একেবারে ওভার বাউন্ডারি, সিনেমার দর্শকেরা সেই বলের ছুটে যাওয়ার ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছেন।
ক্যারি পেকারের ওয়ানডে ক্রিকেট সনাতনীদের ক্রিকেট ভাবনাকে দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে দিল। কয়েক বছর পর ১৯৮২ সালে যখন বিসিএস পরীক্ষার কয়েকটি পর্ব পেরিয়ে এখনকার চামেরি হাউসে ভাইবা বোর্ডে হাজির হলাম, এটা-ওটা জিজ্ঞেস করার পর বোর্ডের একজন জিজ্ঞেস করলন, ক্যারি প্যাকার ক্রিকেটের কি ক্ষতি করলেন? উত্তরে যদি উল্টোটা বলি তাহলে যদি ফেল করিয়ে দেন? প্রশ্ন শুনে মনে হয়েছে, তিনি সনাতনী চার বা পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচপন্থী ক্রিকেট অনুরাগী। তখন যদি জানতাম মাত্র কুড়ি ওভারের টি-টোয়েন্টি আসছে, বলতাম, ক্ষতির আর কী দেখেছেন স্যার, আরও ভয়ংকর কিছু ধেয়ে আসছে।