এলসি খুলতে আগ্রহ কম ব্যাংকের, খাদ্যপণ্যের দামে আরও অস্থিতিশীলতার শঙ্কা
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় নিত্য খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছে না অনেক ব্যাংক। এতে আমদানি কমে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির হওয়ার আশঙ্কা করছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।
আমদানিকারকরা বলছেন, এই পরিস্থিতির উন্নতি নাহলে ইতোমধ্যেই বল্গাহীন নিত্যপণ্যের দাম আগামী দুই সপ্তাহ পর থেকে আরও বাড়বে।
আমদানিতে সাম্প্রতিক এই বিচ্ছিন্নতা স্বীকার করে ব্যাংকাররা বলছেন, সেপ্টেম্বর পর্য়ন্ত নিত্যপণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে ডলার সংকট আরো তীব্র হয়েছে।
দেশের বৃহৎ পাইকারি পণ্যের বাজার– চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে অবস্থিত অন্তত তিনটি ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজাররা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, এখন তারা বেশিরভাগ খাদ্য আমদানিকারককে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিকবার চেষ্টা করে ব্যর্থতার পর– যেসব প্রতিষ্ঠানের ভালো লিমিট রয়েছে তাদের কিছু কিছু এলসি খুলতে দেয়া হচ্ছে বলে জানান তারা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি নামকরা নিত্যপণ্য আমদানিকারক– সিটি কমোডিটিসের অভিজ্ঞতা। প্রতিষ্ঠানটি ৩ লাখ ২৩ হাজার ডলারের ছোলা আমদানি করতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় ঋণপত্র খোলার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, পর্য়াপ্ত ডলার না থাকায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে ব্যাংকটি।
পরবর্তী প্রায় দুই-তিন সপ্তাহ অন্তত তিনটি ব্যাংকে এলসি খোলার চেষ্টা করে সিটি কমোডিটিস। সবখানেই বিফল হয় চেষ্টা। অবশেষে এই ঋণপত্র খোলে ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা।
এই বিষয়ে কমার্স ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, 'প্রতিষ্ঠানটির ঋণপত্র খোলার প্রস্তাব পেয়ে বিষয়টি নিয়ে আমরা ঢাকায় হেডকোয়ার্টারের সাথে আলাপ করেছি। কিন্তু, ব্যাংকের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট থেকে এত বড় ভলিউমের ঋণপত্র খুলতে রাজি হয়নি। আমাদের শাখার দীর্ঘদিনের পুরানো গ্রাহক হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটির ঋণপত্র খুলতে না পারাটা সত্যিই দুঃখজনক'।
খাদ্যপণ্যের কৌটা তৈরির টিন প্লেট আমদানি করে খাতুনগঞ্জের এমএস এন্টারপ্রাইজ। সিটি কমোডিটিসের চেয়েও মন্দ কপাল তাদের। ৪০ হাজার ডলারের দুই কনটেইনার টিন প্লেট আমদানি করতে গত দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। ৭৫ শতাংশ মার্জিনের প্রস্তাব দিয়েও এখনো কোনো ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
খাতুনগঞ্জের ডাল জাতীয় পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স শ্রী মাতৃভান্ডার। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হারাধন নাগ বলেন, 'এভাবে চলতে থাকলে, আমদানি সংকটে নিত্যপণ্যের সংকট তৈরির আশঙ্কা রয়েছে'।
তার প্রতিষ্ঠানও ডাল আর ছোলা আমদানির ঋণপত্র খুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবিএল) এর শাখা ব্যবস্থাপক আরফানুল ইসলাম জানান, তাদের ব্যাংক সরিষা ও ভুট্টা আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রাম চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির একটি প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিতে হয়েছে ব্যাংকটিকে।
আমদানিকারকরা বলছেন, ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকগুলোর অনীহা এবং দেরির কারণে এরমধ্যেই তার প্রভাব পড়েছে নিত্য খাদ্যপণ্যের বাজারে। গত এক সপ্তাহে খাতুনগঞ্জে বেশিরভাগ খাদ্যপণ্যের দাম মণপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা বেড়েছে।
সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের এক আমদানিকারক বলেছেন, ভারত থেকে খাদ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে ব্যাংকগুলির অনীহা দেখা যাচ্ছে, এতে করে আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যেই দেশের বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান নাশিম জানান, আগে খুলে রাখা এলসির আওতাতেই বর্তমানে তারা ভারত থেকে খাদ্য আমদানি করতে পারছেন।
অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান মহাসচিব মাকসুদ খান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংককে এলসি খোলা নিরুৎসাহিত করতে বলা হয়েছে। 'এতে ধীরে ধীরে আমদানি কমতে থাকায়– তার আঘাত আসবে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দামে'।
বিলাসপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে অর্থবছরের প্রথম দুই-তিন মাস (জুন-আগস্ট) বিলাস বা কম প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কিছুটা কমলেও, পরে তা আবার বেড়ে গেছে। বিলাসপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি ডলার সংকটকে আরো ত্বরান্বিত করেছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের।
চট্টগ্রাম কাস্টমস'র তথ্যমতে, আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৯টি স্ক্র্যাপ জাহাজ। কিন্তু, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২টিতে। এমনকি ডলার সংকট বাড়ার পরও গত মাসে (অক্টোবর) স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে ১৩টি।
স্ক্র্যাপ জাহাজের মতো ফল আমদানিও জুলাইয়ের পর থেকে বেড়েছে। জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২১ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন ফল (কমলা, মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর ও নাশপতি) আসে । আগষ্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৪৫৪ মেট্রিক টনে। আর সেপ্টেম্বরে আমদানি হয় ৩৪ হাজার ১৯০ টন। আগের মাসের চেয়ে প্রায় ৮ হাজার টন বেড়ে সর্বশেষ গেল মাসে (অক্টোবর) আমদানি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৮৮ টন।
স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির বিষয়ে শিপ ব্রেকিং খাতের উদ্যোক্তা- কেআর স্টিলের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন বলেন, কিছু কিছু ইয়ার্ড মালিক বিশেষ করে যারা ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছেন– তারা প্রভাব খাটিয়ে এই সময়েও স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করছে। যা ডলার সংকট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অভ কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়– সেই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে এই সময়ে বিলাস পণ্য আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন এই ব্যবসায়ী নেতা।