লাল বইয়ের দুনিয়ায়
ঘটনা ১.
বাইরে অন্ধকার, বরফ পড়ছে, জানালার শার্সি ঢেকে দিচ্ছে তুষার কণা, গনগনে চুল্লির তাতে ঘরের ভেতরটা আরামের মতো গরম, গালচের ওপর কুন্ডুলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে 'ভাসকা' বেড়াল, পাশে ঝাঁকড়ালোমো গেঁয়ো কুকুর 'পস্তোইকো' সামোভারে জল ফুটছে, সুরুয়ার মন মাতানো খুশবু ঘর জুড়ে…
বইয়ের এই বর্ণনাগুলো যেন দময়ন্তীকে নিয়ে যেত সেই বরফের দেশ সোভিয়েতে। বাংলা-বিহার বর্ডারের একটা ছোট্ট সুন্দর জায়গায় দময়ন্তীর ছেলেবেলা কেটেছিল। বাড়িভর্তি ছিল অনেক অনেক বই। লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনার পাশাপাশি বই পড়াই ছিল তার একমাত্র শখের জায়গা। আর সেসময় বই মানেই সোভিয়েত বই।
একটু বড় হতেই দময়ন্তীর সঙ্গী হয়েছিলেন চেকভ, দস্তয়েভস্কি, গোর্কি, তুর্গেনেভরা। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। বিয়ে হলো, কন্যা সন্তান হলো। মেয়ের জন্যও কিনতে শুরু করলেন ছোটদের রাশিয়ান বইগুলো। ততদিনে এসব বই প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে এসেছে...
ঘটনা ২.
ছোটোবেলায় দুপুরের খাওয়ার পর রাশিয়ান বই পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়তেন হাসান সৌরভ। বাবার মুখেই রুশ গল্পের সঙ্গে তার হাতেখড়ি। একদম ছোটোবেলায় যখন নিজে বানান করে পড়তেও পারতেন না, তখন বাবাই তাকে পড়ে শোনাতেন বইয়ের গল্পগুলো। তখন থেকেই রুশ বইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বইয়ের প্রকাশনাগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও শৈশবের সেই মহামূল্যবান সম্পদ গুলো আজও আগলে রেখেছেন সৌরভ। বইয়ের তাকে রাখা শৈশবের সেই বইগুলোর পৃষ্ঠা ওল্টালে আজও যেন হারিয়ে যান সেই বরফের দেশে…
'সোভিয়েত বুকস ট্রান্সলেটেড ইন বেঙ্গলী' নামক একটি ব্লগে নিজেদের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এসব কথা লিখেছেন দময়ন্তী এবং সৌরভ।
এবার আসি এই রুশ বই প্রসঙ্গে। কিভাবে এর আগমন আর কীভাবেই বা দুষ্প্রাপ্য বনে গেলো এইসব লোভনীয় বইগুলো?
১৯৩১ সালে মস্কোয় 'বিদেশী শ্রমজীবীদের প্রকাশন সমিতি' নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন তো আর একক রাশিয়ার যুগ ছিল না, তখন বলা হতো সোভিয়েত ইউনিয়ন। যে কারণে, এই বইগুলোকেও রুশ বই না বলে সোভিয়েত বই বলাই মনে হয় একটু বেশি সুবিধাজনক। যা-হোক, প্রকাশনা সংস্থাটি কিন্তু গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় প্রকাশন সমিতির উদ্যোগেই। অর্থাৎ সরকারিভাবেই। সুতরাং এর পেছনে কিছু উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যে ছিল তা স্পষ্ট।
যা-হোক, প্রথমে প্রকাশনার নাম পরিবর্তনের গল্পই বলা যাক। শুরুতে যে চার শব্দের নাম ছিল, শেষ পর্যন্ত তা ছিল না। কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল সে নাম। ১৯৩৯ সালে সংস্থাটি নাম প্রথমবার বদল করে 'বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়' এবং ১৯৬৩ সালে তা, 'প্রগতি প্রকাশন' [ইংরেজিতে 'প্রোগ্রেস পাবলিকেশন'] নামে আত্মপ্রকাশ করে।
'প্রগতি'র কাজ ছিল বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় সোভিয়েত সাহিত্যের এবং রুশ ভাষায় বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করা। সুতরাং কমবেশি অনেক ভাষাভাষীর বইয়েই সোভিয়েত সাহিত্য অনুবাদ করা হতো। আমাদের বাংলা ভাষায় অনুবাদ শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে সেখানে স্থায়ী বাংলা বিভাগ গড়ে ওঠার পর।
রুশ সাহিত্যের অনুবাদকেরা…
ফলে অনুবাদক নেওয়া হলো এই দুই বাংলা থেকেই। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়েছিলেন ননী ভৌমিক, নীরেন্দ্রনাথ রায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ফল্গু কর, সমর সেন ও শুভময় ঘোষ । এখানে বলে রাখি, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধায়ের স্ত্রী রেখা চট্টোপাধ্যায় এবং শুভময় ঘোষের স্ত্রী সুপ্রিয়া ঘোষও কিছু অনুবাদ করেছিলেন!
অল্প সময়ের জন্য সেখানে অনুবাদক হিসেবে এক কালের বিখ্যাত চলচ্চিত্র-অভিনেতা রাধামোহন ভট্টাচার্যও কাজ করেছিলেন। সেটা সম্ভবত ১৯৫৭ সাল। এরই কাছাকাছি কোন এক সময়ে কোলকাতা থেকে বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ও যোগ দেন সেখানে।
সত্তরের দশক পর্যন্ত ননী ভৌমিক ও বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়—এ দুজন ছাড়া 'প্রগতি'র বাংলা বিভাগে আর কোনও অনুবাদক ছিলেন না। ননী ভৌমিকের 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন', 'চলো সোভিয়েত দেশ বেড়িয়ে আসি'র মতো লেখার পাশাপাশি শিশুকিশোর সাহিত্যের অনুবাদ বিখ্যাত হয়েছিল। তার অনূদিত, 'রুশদেশের উপকথা' বইটি সে আমলে পড়েনি এমন শিশু মনে হয় কমই ছিল।
বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় করতেন সামাজিক বা রাজনৈতিক মতাদর্শমূলক সাহিত্যের অনুবাদ। রাধামোহন ভট্টাচার্য্যের আলেক্সেই টলস্টয়ের 'দ্য লেম প্রিন্স-এর অনুবাদ 'খোঁড়া রাজকুমার' খুব জনপ্রিয় হয়।
এরপর সত্তরের দশকে বাংলাদেশ-এর আবির্ভাবের ফলে 'প্রগতি'র বাংলা বিভাগের গুরুত্ব বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেল। বাংলা তখন আর উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত পৃথক পৃথক দুটি দেশের প্রাদেশিক ভাষা মাত্র নয়—একটি দেশের প্রাদেশিক ভাষা এবং অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা। তাই ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটল 'প্রগতি'র বাংলা বিভাগের।
এই পর্বে 'প্রগতি'র বাংলাবিভাগে যোগদান করেন বাংলাদেশ থেকে হায়াৎ মামুদ, খালেদ চৌধুরি (পশ্চিমবঙ্গের চিত্রশিল্পী খালেদ চৌধুরী নন) ও দ্বিজেন শর্মা এবং কোলকাতা থেকে অরুণ সোম এবং কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিছুকাল পরে প্রফুল্ল রায় (ঔপন্যাসিক প্রফুল্ল রায় নন)। এছাড়া ননী ভৌমিক ও বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় তো ছিলেনই; স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক দুজন বাঙালি যুবক বিজয় পাল এবং সুবীর মজুমদারও এই সময় 'প্রগতি'তে অনুবাদকের কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রথম পর্বের অনুবাদকদের মধ্যে একমাত্র নীরেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন রুশ ভাষা বিশেষজ্ঞ সাহিত্যিক। ননী ভৌমিক পরবর্তীকালে রুশ ভাষা শিখে সরাসরি রুশ থেকেই অনুবাদ করতেন। দ্বিতীয় পর্বের অনুবাদকদের মধ্যে ননী ভৌমিক ছাড়া শেষোক্ত দুজন, অরুণ সোম ও হায়াৎ মামুদই সরাসরি রুশ থেকে অনুবাদ করতেন, বাকিরা করতেন ইংরেজি থেকে। এসব বইয়ের ভান্ডারে বিভিন্ন রূপকথার বই যেমন থাকতো, তেমনি থাকতো সামাজিক, রাজনৈতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন বই।
এছাড়া, বাঙালি পাঠকের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল কয়েকটি পত্রপত্রিকাও—'সোভিয়েত দেশ', 'সোভিয়েত নারী', 'সোভিয়েত ইউনিয়ন'।
প্রচারণার উদ্দেশ্যে…
প্রকাশনীটির মূল লক্ষ্য ছিল রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের) বই অনুবাদ করা, যার মাধ্যমে অন্যান্য দেশের সাধারণ পাঠকেরা এসব বইয়ের সাথে পরিচিত হতে পারে। কিন্তু এর পেছনে কি শুধুই ব্যবসায়িক স্বার্থ ছিল?
উত্তর হলো, না। মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্য এবং আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বইগুলোর অনুবাদ ছাড়াও সোভিয়েত তথা রুশ সাহিত্য ও সংস্কৃতি-আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যও ছিল প্রগতি প্রকাশনীর।
যেকারণে, প্রকাশিত অনুবাদের অন্তত এক-চতুর্থাংশ হতো সোভিয়েত ও রুশ সাহিত্যের। তার সিংহভাগ ছিল শিশু ও কিশোর সাহিত্যের। কারণ, শিশু-কিশোরের মনে নির্দিষ্ট কোন ভাবাদর্শ গাঁথা হয়ে গেলে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সুদূরপ্রসারী হওয়া খুবই সম্ভব। প্রকাশের তৃতীয় স্থানে থাকত রুশ ও সোভিয়েত ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুবাদ।
এমন নয় যে, বইগুলো খুব রাজনৈতিক হতো। বিদেশি সাহিত্যগুলোর মতো এই বইগুলোও রূপকথা, রাজ্য-রাজারানি নিয়েই হতো। কিন্তু এসব রুশ সাহিত্যের এসব ছোট্ট পাঠকদের মনে, কোনো রাজার ছেলে বীরপুরুষ ছিল না, বরং গরীব কৃষাণ পরিবারের ছেলেটিই ছিল বীর। তাদের কাছে বীরপুরুষ মানে ডালিমকুমার বা কোনো ইংরেজ সাহিত্যের রাজকুমার নয়, বরং ইভান। তাদের চোখে রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হলো, জার। যে অত্যাচারী জারকে সরিয়ে দিচ্ছে একজন কৃষাণের ছেলে, ইভান। ফলে, এসব শিশুদের কাছে শক্তির উৎস মানেই ছিল তিনটি জিনিস—লোহার টুপি, লোহার কাঠি, এবং লোহার জুতো।
রূপকথার এই গল্পগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে অন্যান্য দেশে পাঠান হতো শুধু নিজেদের আদর্শ প্রচারণার উদ্দেশ্যেই।
সেসময় পৃথিবী মূলত দুটি আদর্শে বিভক্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, অপরদিকে আমেরিকার ছিল পুঁজিবাদী আদর্শ। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন শিশুদের মনে এই ধারণাগুলো এই বইয়ের মাধ্যমেই এনে দিত।
রুশ সাহিত্য ছিল একইসাথে মানবতাবাদী ও সর্বব্যাপী
প্রচারের দিকটার কথা ছেড়ে দিলেও একথা অনস্বীকার্য যে রুশ সাহিত্য যেকোন অবস্থাতেই মূলত মানবতাবাদী। তাই তার আবেদনও ছিল সর্বব্যাপী। রুশ সাহিত্য বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রূপে স্বীকৃত। আর পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশু ও কিশোর সাহিত্যের বিকাশ হয়েছিল সোভিয়েত আমলেই।
যাহোক, 'প্রগতি' ততদিনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রকাশনালয়ে পরিণত হয়। পৃথিবীর ৫৬টি ভাষায় অনুবাদ সাহিত্য প্রকাশিত হতো এখান থেকে। 'প্রগতি'র প্রকাশিত বইগুলো তাদের বিষয়বৈচিত্র্য, মুদ্রণ পারিপাট্য, নজরকাড়া অলংকরণ এবং সুলভমূল্যের জন্য তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষত ভারতের মতো দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
কারণ সেসময়ে ছবির বই বা সচিত্র বইগুলো খুব দূর্লভ ছিল এই অঞ্চলে। পশ্চিম থেকে যে বইগুলো আসতো, সেগুলোর দামও থাকতো নাগালের বাইরে। সেখানে এই কম দামী, শিল্পানুগ বইগুলো ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির সবচেয়ে বিশ্বস্ত বই। দাম, মান, উৎপাদন, স্বাদ সব দিক থেকেই বইগুলো সবার পছন্দের হয়ে উঠলো। সে কারণে আমাদের দেশে এই বইগুলো প্রচুর বিক্রিও হতো একসময়। মানুষের কাছে ক্লাসিক্স সাহিত্য নিয়ে গেছে এই বইগুলোই।
আশির দশকে 'প্রগতি'র অগ্রগতি এতদূর হয়েছিল যে বিশেষভাবে গল্প উপন্যাস এবং শিশু ও কিশোর সাহিত্য অনুবাদের জন্য ১৯৮২ সালে 'রাদুগা' নামে পৃথক আরও একটি প্রকাশন সংস্থা গঠিত হয়। সেখানে অরুণ সোম ছিলেন বাংলা বিভাগের একমাত্র স্থায়ী অনুবাদক। ননী ভৌমিক 'প্রগতি'তেই থেকে গেলেন, যদিও 'প্রগতি'তে থেকেও 'রাদুগা'র বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বইও তিনি অনুবাদ করেছেন। এছাড়া দ্বিজেন শর্মা এবং তার স্ত্রী দেবী শর্মাও 'রাদুগা'র দু-একটি ছোটখাটো বই অনুবাদ করেছেন। বছর দুয়েকের মধ্যে, ১৯৮৪ সালে তাশখন্দে 'রাদুগা'র একটি বাংলা বিভাগও খোলা হয়।
রাদুগা থেকে প্রকাশিত গোর্কির 'চড়ুইছানা' বইটির প্রচ্ছদে অসংখ্য চড়ুই পাখি একত্রে বসে কিঁচিরমিঁচিরের ছবি, সাথে 'দাদুর দস্তানা', 'নাম ছিল তার ইভান', 'রুপোলী খুর', 'পীত দানবের পুরী', 'মোরগছানা', 'বাহাদুর পিঁপড়ে', 'আলতাজবা' নামের এই রঙিন বইগুলো ঘুরত বাচ্চাদের হাতে হাতে।
একটু বড় হলে, চেঙ্গিস আয়াতমাতভের 'পাহাড় ও স্তেপের আক্ষান', নিকোলাই অস্ত্রভস্কির 'ইস্পাত', বরিস পলভয়ের 'মানুষের মতো মানুষ', ইভান তুর্গেনিভের 'পিতাপুত্র' দস্তয়েভস্কির 'মাকারচুদ্রাই', বরিস পস্তারনেকের 'ডক্টর জিভাগো' আর কত কি ছিল সে সময়ের কিশোর-কিশোরীদের আকর্ষণের কেন্দ্র!
এছাড়া তদের ম্যাগাজিনগুলোতে মহাকাশ অভিযান, বিভিন্ন জাতির লোককথা ও সাংকৃতিক জীবনযাত্রা নিয়ে প্রচুর আলেখ্য থাকত। ইউরি গ্যাগারিন, ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা ও সভেৎলানা সাভিৎস্কায়ারা তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় বীর। পাতার পর পাতা ভরা থাকত তাদের জীবন ও রোমাঞ্চকর অভিযানের ছবি ও বিবরণ দিয়ে। সে মুগ্ধতার রেশ আজও রয়ে গেছে পাঠকদের মাঝে।
এভাবেই, রুশ তথা সোভিয়েত সাহিত্য ও সংস্কৃতি দেখতে দেখতে দুনিয়ার ব্যাপক পাঠক সম্প্রদায়ের প্রাণের সম্পদ ও আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত হয়।
তখনি বেজে উঠলো বিদায় ঘণ্টা…
ইতোমধ্যে মস্কোয় 'প্রগতি'র নতুন ভবন নির্মিত হয়েছে, 'রাদুগা'ও পৃথক একটি ভবনে উঠে যাবার প্রস্তুতি চলছে। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা চলছে ঠিক তখনই বেজে উঠলো বিদায় ঘণ্টা।
কাজ শেষ এ কথা হঠাৎ একদিনে বলা হয়নি। অর্থনৈতিক একটা বদ্ধতা তৈরি হয়েছিল তখন। ১৯৮৫ সালে যখন গর্বাচেভ ক্ষমতায় এসে বললেন, সবকিছুকে লাভজনক খাতে পরিণত করতে হবে, তখনি বেজে উঠলো প্রগতি-রাদুগার মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদায় ধ্বনি। ফলে, প্রগতি-রাদুগার মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো আর থাকবে না।
আসলে রুশ বইয়ের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার একেবারে মূল কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া। সবকিছু নতুন করে গড়ে উঠতে উঠতে সেসব অনুবাদক-লেখকদের মধ্যে যোগাযোগের যে বন্ধনটি রচিত হয়েছিল সেটি ভেঙে গেল। সোভিয়েত হয়ে গেলো রাশিয়া। রাশিয়া হওয়ার পর যে ছাপাখানা থেকে বইগুলো ছেপে আসতো, সেখানে বইগুলো ছাপা বন্ধ হয়ে গেলো। পরবর্তীকালে ছাপানো হলেও বাংলাদেশে সহজ উপায়ে আগের মতো আর আসতে পারলো না। তেমন কারো পৃষ্ঠপোষকতাও মিলল না। সমাজতান্ত্রিক থেকে রাষ্ট্রটি হয়ে উঠলো একটা পুঁজিতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়।
সোভিয়েত ভাঙ্গার পর রাদুগা বা প্রগতির যে অজস্র বই ছিল গোডাউনে, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে নাকি আর্কাইভে রেখে দেওয়া আছে সে সম্পর্কেও জানা যায়নি।
ঢাকার বাতাসে তখন রাদুগা আর প্রগতি প্রকশনীর হাত ধরে রুশ কথা সাহিত্যের ঘ্রাণ! পল্টনের সিপিবি অফিসের সামনে, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, জাতীয় স্টেডিয়ামের দোতলায়, নিউমার্কেট লাইব্রেরি দোকানগুলো, সর্বত্রই তখন রুশ সাহিত্যের জয় জয়কার ছিল। এই বইগুলোর জন্য উপচে পড়া ভিড় থাকতো তখন দোকানগুলোতে।
নব্বইয়ের দশকে নিউমার্কেটের দর্জির দোকানগুলোর বিপরীতে বাচ্চাদের কিছু বই বিক্রি করতো কয়েকজন দোকানদার। ফুটপাতে কাঠের একটি চৌকির উপর এই রঙ্গিন বইগুলো পথচারীদের আকৃষ্ট করতো অনেক।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও সামাজিক মাধ্যমে এই বইগুলো নিয়ে এখনও প্রায়ই আলোচনা চলে। 'সোভিয়েত বুকস ট্রান্সলেটেড ইন বেঙ্গলী' নামক একটি ব্লগ বর্তমানে কাজ করছে সোভিয়েত প্রকাশিত বাংলায় অনূদিত জীর্ণ, মলিন, হলদে হয়ে যাওয়া এসব বই ফিরিয়ে আনার। হাতে ধরে সেই বইয়ের স্বাদ না পেলেও, পিডিএফে এই বইগুলোর স্বাদ পাওয়া যাবে সেখানে।
আজ 'প্রগতি' বা 'রাদুগা' কেবলই অতীতের বস্তু। নতুন প্রজন্ম 'প্রগতি' বা 'রাদুগা' থেকে প্রকাশিত সেই সমস্ত অনুবাদের সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নয়, অনেকে হয়তো তাদের নাম পর্যন্ত শোনেনি।
এই প্রকাশনীর একেবারে শেষ দিনগুলোর যে আয়োজন তার পসরা দেখি রাজধানীর ফুটপাতে আর নীলক্ষেতের ফুটপাতে এবং বলাকার আশপাশের ফুটপাতে। আজিজ মার্কেটেও পাওয়া যায় কিছু কিছু। কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু পুরোনো বই বিক্রি করে এমন অনলাইন বুক শপ এবং রকমারীতে কিছু কিছু মেলে এসব বই।
সাহিত্য এবং প্রচারণা এই দুয়ে মিলেই বই
এই বইগুলোর যে বিষয়টি পাঠকদের মনে সবথেকে বেশি জায়গা করে আছে তা হলো, বইয়ের গল্পের চরিত্র আর বইয়ের বর্ণনা। সেই ছোটোবেলায় এই বইগুলো পড়েছেন, কিন্তু সেই কমিউনিজমের আদর্শ আজও তাদের মধ্যে রয়ে গেছে। এমনি একজন আবু সালেহ ফয়সাল। তিনি বলেন, 'অসাধারণ মুদ্রণশৈলী-সম্পন্ন কাগজ আর বাঁধাই! এক একটি বইয়ের কী ভার! বাংলা বই যে কত সুন্দর আর নির্ভুল হতে পারে, তা বাংলা রুশ বই হাতে নিলে বোঝা যায়। ও বই পড়ার চেয়েও যেন বেশি ছিল দেখার।'
শিশুদের বই প্রকাশ করতো মূলত 'রাদুগা' প্রকাশনী। জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলো হতো 'মীর' প্রকাশনীতে। বৈজ্ঞানিক বইগুলো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় সম্পর্কে ধারণা দিতো। এসব বইয়ের লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিউনের বৈজ্ঞানিক অর্জনগুলো তুলে ধরা এবং বৈজ্ঞানিক এবং পরিবেশগত সচেতনতা তৈরি।
আর অন্যগুলো প্রগতি প্রকাশনীর অধীনে হতো। সোভিয়েত সাহিত্যের এই চরিত্রদের কেউ দুষ্টু, কেউ ভালমানুষ গোছের, কেউ ঝগড়ুটে, হিংসুটে, কেউ বা ভিতু। চুক আর গেকের মতো রেলগাড়ি চড়ে বরফের দেশে বাবাকে খুঁজতে যাওয়া, ছোট্ট মেয়ে দারিয়াঙ্কার মতো পোষা বেড়াল লাভালাইকাকে আদর দিয়ে 'মানুষ' করা, গরিব চাষির ছেলের হাতে খারাপ জমিদারের শাস্তি, এই সবের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠত কৈশোরের ভালমন্দের বোধ। 'সাগরতীরে' বইয়ের আলসে ছেলেটা দায়িত্ব নিতে শেখায় আর এফিমকাকার বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় স্বস্তির শ্বাস ফেলত সবাই।
এসব গল্পে সবসময় ক্ষমতাধর আর ধনীরা নেতিবাচকভাবে এবং গরীব অসহায়দের ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হত। সাহিত্য এবং প্রচারণা এই দুয়ে মিলেই মুদ্রিত হতো এই বইগুলো। তবে প্রচারণাগুলো ছিল ইতিবাচকভাবেই। গল্প আর চরিত্রদের মাঝে বার্তা দিতো সাম্যবাদের। শিশুদের সমানুভূতিশীল হতে, শ্রমের মর্যাদা দিতে শেখাতো। মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম, অসহায়-গরীবদের পাশে দাঁড়াতে শেখাতো।
এই সাম্যবাদী চেতনাগুলোই পরবর্তীতে আমাদের দেশের বিল্পব আর স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোতে পরোক্ষ প্রভাব রেখেছে কি না কে জানে!