ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বীরদর্পে লড়েছিলেন যে বীরাঙ্গনা
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হন। ভারতবর্ষে নারীর ক্ষমতায়নেরও প্রতীক তিনি। তাকে নিয়ে লিখেছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
লক্ষ্মীবাঈ যখন কৈশোরে পদার্পণ করেন, ততদিনে তিনি ভারতবর্ষের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণ, দায়িত্বের অনেকগুলোই ভেঙে ফেলেছেন। তিনি পড়তে ও লিখতে পারতেন। অশ্বারোহণ আর অসি চালনাতেও সুদক্ষ ছিলেন। তাকে কেউ সবক শেখাতে গেলে উল্টো তিনি তাদেরকে দুকথা শুনিয়ে দিতেন।
১৯ শতকের মাঝামাঝিতে ভারতবর্ষে অসংখ্য করদ রাজ্য ছিল। উত্তর ভারতের এরকম একটি করদ রাজ্য ছিল ঝাঁসি। ঝাঁসির রানি ছিলেন লক্ষ্মীবাঈ। তিনি রাজত্ব শুরু করলেন ভারতের রাজনীতিতে এমন এক উত্তাল সময়ে যখন ইংরেজরা ভারতবর্ষে তাদের উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করেছে। এমনই এক পর্যায়ে ঝাঁসিকে নিজেদের অধিভুক্ত ঘোষণা করে লক্ষ্মীবাঈকে সিংহাসনচ্য়ুত করল ব্রিটিশরা।
আলোচনার মাধ্যমে ঝাঁসির ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে চাইলেন লক্ষ্মীবাঈ। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। পরে ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য প্রথম লড়াই হিসেবে সিপাহি বিদ্রোহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
রানি লক্ষ্মীবাঈ নিজের সেনাদের নিজেই প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। সেনাধক্ষ্যের ভারও নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তার সৈন্যদলে নারী ও পুরুষ উভয়েই ছিল। ১৮৫৮ সালের জুন মাসে ইংরেজদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয় হয় ঝাঁসির রানি ও তার সৈন্যদলের।
পরবর্তী দশকগুলোতে ভারতীয়দের কাছে বীরাঙ্গনার মর্যাদা পান লক্ষ্মীবাঈ। অন্যদিকে ইংরেজ শাসকেরা তাকে মতিচ্ছন্ন ও দুশ্চরিত্রা নারী হিসেবে অভিহিত করে। তবে এসবের মাঝে লক্ষ্মীবাঈ প্রতিরোধের নিদর্শনের পাশাপাশি ভারতবর্ষে নারীর ক্ষমতালাভের সঙ্গে তৈরি হওয়া জটিলতাগুলোর প্রতীকও হয়ে ওঠেন।
ব্র্যান্ডিজ ইউনিভার্সিটির সাহিত্য ও উইমেন স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক হারলীন সিং বলেন, 'ঝাঁসির রানির গল্প আমাদের কাছে ইতিহাসের চেয়ে মিথোলজি হিসেবে বেশি উপস্থিত হয়েছে। এটি পরিবার ও জাতির প্রতি নারীর বীরত্বের গল্প।'
একদিক থেকে তাকে অদ্বিতীয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয় — এবং তিনি অদ্বিতীয়া — কারণ তিনি নিজের মাতৃভূমির জন্য লড়েছেন, নিজের চেয়ে বৃহত্তর একটি সত্তার জন্য লড়াই করেছেন, বলেন এ শিক্ষক।
লক্ষ্মীবাঈ তার শরীরে রাজরক্ত নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। জন্মের পর তার নাম দেওয়া হয় মণিকর্ণিকা। ১৮২৭ সালে গঙ্গার তীরে বারাণসীতে মণিকর্ণিকা জন্মগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হয়। ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও পণ্ডিতদের মাঝে বেড়ে ওঠেন তিনি। তার বাবা রাজসভায় অমাত্য হিসেবে কাজ করতেন। এর ফলে সহজেই শিক্ষাদীক্ষা ও ঘোড়ায় চড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন মণিকর্ণিকা।
১৮৪২ সালে মণিকর্ণিকা ঝাঁসির মহারাজা গঙ্গাধর রাও'র সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর তার নাম হয় লক্ষ্মীবাঈ।
বেশিরভাগ তথ্যসূত্র অনুযায়ী রানি হিসেবে লক্ষ্মীবাঈ ছিলেন সম্পূর্ণ প্রথাবিরোধী, তবে একইসঙ্গে তার হৃদয় ছিল করুণার আধার। অন্তপুর প্রথা মেনে চলতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। তার অমাত্য ও ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি সরাসরি কথা বলতেন। পাগড়িও পরতেন লক্ষ্মীবাঈ। তখনকার সময়ে পাগড়ি কেবল পুরুষরাই মাথায় চড়াতেন। একথাও শোনা যায়, তিনি নিজের সহচরী ও আশেপাশের অন্যান্য নারীদের ঘোড়ায় চড়া এবং যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়েছিলেন। গরীব, নিচুজাতের মানুষদের সঙ্গেও তিনি কথা বলতেন, তাদের আর্জি শুনতেন।
লক্ষ্মীবাঈ রানি হিসেবে সিংহাসনে আরোহনের পর থেকেই ব্রিটিশরা ভারতে ভূমি ও সম্পদ দখল করতে শুরু করেছিল। ১৮৪৮ সালে ভারতবর্ষের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ঘোষণা দেন, করদ রাজ্যগুলোর শাসকদের নিজের ঔরসজাত উত্তরাধিকারী না থাকলে সেগুলো ডকট্রিন অব লাপস-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে নিয়ে আসা হবে।
লক্ষ্মীবাঈয়ের একমাত্র সন্তান মারা গিয়েছে। তার স্বামীরও শরীর ক্রমশ খারাপের দিকে। তারা ঠিক করলেন পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলেকে দত্তক নিয়ে তাকে ভবিষ্যতের ঝাঁসির রাজা হিসেবে গড়ে তুলবেন। তারা আশা করেছিলেন ব্রিটিশরা তা মেনে নেবে।
কিন্তু তা হয়নি। ১৮৫৩ সালে ঝাঁসির মহারাজের মৃত্যু হলে লক্ষ্মীবাঈ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাকে পেনশন দেওয়ার প্রস্তাব দেয় ব্রিটিশরা। লক্ষ্মীবাঈ উত্তর দিয়েছিলেন, 'মেরি ঝাঁসি নাহি দুঙ্গি' (আমার ঝাঁসি ছেড়ে দেব না)।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হলে কয়েক ডজন ব্রিটিশ নিহত হয় সিপাহিদের হাতে। এ সিপাহিদের সঙ্গে লক্ষ্মীবাঈর যোগসাজশ থাকার অভিযোগ আনে ইংরেজরা। সত্যিই লক্ষ্মীবাঈ সিপাহিদের সহায়তা করেছিলেন কিনা, তা এখন বিতর্কসাপেক্ষ।
দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। অবশেষে ১৮৫৮ সালে ঝাঁসির দুর্গ আক্রমণ করে ইংরেজ বাহিনী।
তখনকার আর্মি ফিল্ড সার্জন ড. টমাস লো তার ১৮৬০ সালের বইয়ে লিখেছিলন, 'রাজ্যের প্রতিটি অংশে রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ হচ্ছিল। চারদিকে কেবল মৃতদেহ পড়ে ছিল।'
তিনি আরও লিখেন, 'যারা পালাতে পারেনি তারা তাদের স্ত্রী ও বাচ্চাদের কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে তারপর নিজেরাই ঝাঁপ দিয়েছিল।'
শহর পুড়তে থাকল। রানি লক্ষ্মীবাঈ ছেলে দামোদরকে পিঠে বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে সরে যান। তবে কীভাবে তিনি ইংরেজ বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়েছিলেন, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই ইতিহাসবিদদের কাছে।
শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের হাতে ঝাঁসির পতন ঘটে। যুদ্ধে মারা যায় ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ মানুস। ঝাঁসি দখলের পর দুর্গের শীর্ষে ইউনিয়ন জ্যাক টানিয়ে দেয় ব্রিটিশরা।
আর কোনো উপায়ন্তর না দেখে লক্ষ্মীবাঈ সিপাহি বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর গোয়ালিয়রের কাছে একটি সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন তিনি।
১৮৫৮ সালের জুন মাসের এক গ্রীষ্মের দিনে গোয়ালিয়র আক্রমণ করে ব্রিটিশ ফৌজ। ঘোড়ায় চড়ে পুরুষের রণসাজে প্রতি-আক্রমণ পরিচালনা করেন লক্ষ্মীবাঈ। এক পর্যায়ে ইংরেজ বাহিনীর হাতে যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যু হয় এ বীরাঙ্গনার। সিপাহী বিদ্রোহের এটিই ছিল শেষ যুদ্ধ।
শোনা যায়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ব্রিটিশ বাহিনীর সেনাপতি স্যার হিউ রোজ বলেছিলেন, 'ভারতের বিদ্রোহ আর কিছু না করলেও একটি পুরুষের জন্ম দিয়েছে। আর সে পুরুষটি ছিলেন একজন নারী।'