বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহ, শহীদুলের আজব শখ!
দেশভাগের বছর কয় আগের কথা। ক্রমে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ার আন্দোলন দানা বাঁধছে। মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা গায়ে শেরওয়ানি জড়িয়ে জিন্নাহ টুপি মাথায় দিয়ে সমাবেশে বক্তৃতা করতেন আর স্লোগান দিতেন, 'হাত মে বিড়ি, মু মে পান— লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান'।
শহীদুল ইসলাম ব্রিটিশ আমল দেখেননি, পাকিস্তান আমলেও তার বুঝ হওয়ার মতো বয়স ছিল না। তবে বাবা এবং দাদাকে দেখেছেন, উভয়েরই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতা ছিল; আর দুজনেই বিড়ি খেতেন।
বরিশালের বানারিপাড়ায় শহীদুলদের বাড়ি। স্বচ্ছল গৃহস্থের বাড়ি যেমন হয়, তেমনি তাদেরও বাড়িতে কাছারিঘর ছিল। সেখানে গ্রামের আরও দশজন এসে ফি সন্ধ্যায় গল্পের আসর বসাতেন। সে গল্পের নির্ঘাৎ অনুষঙ্গ ছিল বিড়ি। তাদের ধানী জমিও ছিল অনেক। ধান কাটার মৌসুমে মজুরদের একটি দল তাদের বাড়িতে এসে ১৫-২০ দিন থাকত। প্রতিদিন এক প্যাকেট বিড়ি না দিলে তারা ঘর্মঘট ডেকে বসত।
নব্বইয়ের দশকেও ২০ শলাকার একটি বিড়ির প্যাকেটের দাম পাঁচ টাকার বেশি ছিল না। বরিশালসহ গোটা দক্ষিণবঙ্গে কারিকর বিড়ির তখন খুব নামডাক। দেদারসে বিক্রি হতো। প্রায় সবার পকেটেই বিড়ির প্যাকেট উকি দিত। এসব দেখে দেখেই শহীদুলের বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহ করার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। অবশ্য সংগ্রহ তিনি বেশিদিন ধরে করছেন না। ২০১৭ সালে সুন্দরবন অঞ্চলের চার বা পাঁচ প্যাকেট বিড়ি দিয়ে সংগ্রহ অভিযান শুরু তার।
বিড়ি ছাড়া গলা খুলত না
শহীদুল নিজে ধুমপান করেন না। এটাও জানেন যে, ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আরও জানেন, পরিশোধিত নয় বলে সিগারেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর বিড়ি। তবে কেন এহেন জিনিস সংগ্রহে সময়ক্ষেপণ ও অর্থ ব্যয় করছেন?
শহীদুলের বললেন, "আমার মনে হলো, বিড়িও ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উপকরণ। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব ব্রান্ডের বিড়ি আছে। কোনো কোনো অঞ্চলের একাধিক আছে। বিয়েতে দেখতাম যারা ব্যান্ড বাজাতে আসতেন, তারা বিড়ি ছাড়া বাদ্যযন্ত্রে বাড়ি দিতেন না; যারা গীত গাইতে আসতেন তারাও গলা খুলতেন না বিড়ি ছাড়া।"
"বিড়ির প্যাকেটের নকশা এবং গড়নও আমাকে আকর্ষণ করে। এগুলো সাদাসিধা কিন্তু বৈচিত্র্যপূর্ণ," যোগ করেন শহীদুল।
এ পর্যন্ত পঞ্চাশের অধিক বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহ করেছেন শহীদুল। দুই উপায়ে সংগ্রহ করেন প্যাকেটগুলো— পরিচিতজনদের মারফত ও অনলাইন মার্কেট থেকে। একজনের পেছনে দুই বছর লেগে থেকে নওগাঁর একটি আঞ্চলিক বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহ করেছেন। দুই বছর লেগে থাকার কারণ আর কিছু নয়, ভুলে যাওয়া। মানুষটি তার সহকর্মী। বছরে দু-তিনবার বাড়ি যান। শহীদুল তাকে ফোনে মনে করিয়ে দেন, তবুও সহকর্মী ভুলে যান। শেষবার রাগের ভান করেই তবে সাফল্য পেয়েছেন।
আত্মীয়-স্বজনেরাও শহীদুলের শখের কথা জানেন। তারা কখনো কখনো নিজে থেকেও দু-চার প্যাকেট এনে দিয়েছেন।
বিভিন্ন অঞ্চলের বিড়ি বিভিন্ন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোক নির্দিষ্ট বিড়ি উপভোগ করে থাকেন। এর কারণ বিড়ি ড্যাম্প (আর্দ্র বা নিরস) হয়ে যাওয়া। আগে যখন যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল না, তখন থেকে এর প্রচলন। সে কারণে শহীদুলের শখের গুরুত্বও তৈরি হয়েছে বেশি।
তিনি অঞ্চলভেদে বিড়ি সংগ্রহে মনোযোগী হয়েছেন। তার কাছে আছে ময়মনসিংহ মুক্তাগাছার নবাব বিড়ি, রংপুর হারাগাছের ৯ নং মাসুদ বিড়ি, সিরাজগঞ্জ কান্দাপাড়ার কিসমত বিড়ি, কুষ্টিয়া ভেড়ামারার করিম বিড়ি, পাবনা সাথিয়ার সিহাব বিড়ি, টাঙ্গাইলের হক বিড়ি, শেরপুর টাউনের রসিদা বিড়ি, পটুয়াখালির পাঞ্জা বিড়ি, জামালপুরের আনছার বিড়ি, কুষ্টিয়া দৌলতপুরের রাজু বিড়ি, সিরাজগঞ্জ বনবাড়িয়ার রতন বিড়ি, যশোর মনিরামপুরের রুপালি বিড়ি, ঈশ্বরদির মামুন বিড়ি।
বিড়ির প্যাকেট তৈরি হয় নরম কাগজ দিয়ে, সরকারের তরফ থেকে একটা লেবেল দেওয়া হয় প্রতিটি বিড়ির প্যাকেটের জন্য, এতে সম্ভবত সরকারের রাজস্ব পেতে সহজ হয়। বিড়ির প্যাকেটে ব্র্যান্ড নেম এবং নির্মাতা বা প্রস্তুতকারকের ছবি থাকে, আর থাকে খাঁজ কাটা নকশা। সাধারণত বিড়ির প্যাকেটের নিচের দিক প্রশস্ত এবং ওপরের দিক সরু হয়। এখন প্রতিটি প্যাকেটে ২৫টি করে বিড়ি থাকে, দাম ১৮ টাকা।
শহীদুলের কাছে আরও আছে— আজিজ বিড়ি, নাসির বিড়ি, মোহিনী বিড়ি, হালিম বিড়ি, বিউটি বিড়ি, লাঙ্গল বিড়ি বা চাষী বিড়ি। ভারতীয় কিছু বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহ করেছেন শহীদুল; একটি হলো— আসামের প্রদীপ বিড়ি, যার গায়ে ইংরেজিতে লেখা, 'স্মোকিং কজেস থ্রোট ক্যানসার'।
বিড়ির নাম 'সোনার চাঁদ'
শহীদুল বললেন, "সাধারণত প্রস্তুতকারকের নাম ধরেই বিড়ির নাম হতে দেখেছি। অল্পই দেখেছি আলাদা, যেমন– চাষী বা লাঙ্গল বিড়ি। সম্ভবত কৃষক ভোক্তার কথা মনে রেখেই এমন নাম দেওয়া হয়েছে।"
"ছবির ক্ষেত্রেও খুব ব্যতিক্রম দেখা যায় না। একটি বিড়ির প্যাকেটে দেখেছি শার্লক হোমসের মতো একজন গোয়েন্দার ছবি, আরেকটিতে একজন নারীর ছবি। দ্বিতীয়টির নাম সোনার চাঁদ বিড়ি, বোঝাই যাচ্ছে বিড়িকে এখানে 'পেয়ারের ধন' বানানোর চেষ্টা করেছেন প্রস্তুতকারক," যোগ করেন শহীদুল।
বিড়ির প্যাকেটে যেসব ট্যাগলাইন বা স্লোগান থাকে, সেগুলোও সাদাসিধা হয়। রূপালি বিড়ির গায়ে যেমন লেখা, 'ধুমপান তৃপ্তিদায়ক'। কারিকর বিড়ির ট্যাগলাইন, 'অতি উৎকৃষ্ট মিঠাকড়া তামাকের তৈরি অমৃতলাল দে'র কারিকর বিড়ি'।
বিড়ির প্যাকেটগুলো প্লাস্টিকের ঠোঙায় পুরে মুখ শক্ত করে এঁটে সংরক্ষণ করছেন শহীদুল। দেশের সব অঞ্চলের বিড়ি সংগ্রহ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ভারতের বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহে আরও মনোযোগী হবেন।
ভারতে বিড়ি চলে সিগারেটের দশগুণ। বিড়ি শব্দটি এসেছে মারওয়ারি (রাজস্থানের মারওয়ার অঞ্চলের লোক, যারা ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেড়ায়) বিড়া থেকে। বিড়া দিয়ে সাধারণত পান পাতার গুচ্ছ বোঝায়। পান পাতায় মোড়ানো ভেষজ উপকরণের শলাকা ভারতের কিছু অঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পাতায় মোড়ানো শলাকা থেকে ধুম সহযোগে পান করাকে স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের এ পরামর্শ বিড়ির প্রচলন ব্যাপক হতে ভূমিকা রেখেছে।
বিড়ির জাত-পাত নেই
ভারতের দক্ষিণ গুজরাটে সতের শতকের শেষভাগে তামাক চাষ শুরু হয়। হুক্কার জনপ্রিয়তা অবশ্য আগে থেকেই ছিল। ফতেহপুর সিক্রিতে সম্রাট আকবরের ইরানী চিকিৎসক আবুল ফাতহ গনিকে হুক্কা বা ওয়াটার পাইপের আবিষ্কর্তা ধরা হয়। ভারত থেকেই হুক্কা পারস্যে যায়, তারপর কিছুটা রূপবদল হয়ে অটোমান সাম্রাজ্যে পৌঁছায়।
তামাক সেবনে নানান সংস্কার ও বিধিনিষেধ থাকার পরেও কিন্তু হুক্কার আদর দিনে দিনে বৃদ্ধিই পেয়েছে। এখনো আদ্যিকালের হুক্কা এশিয়ার কিছু দেশে দেখা যায়, যাতে বিশুদ্ধ বা অপরিশোধিত তামাক ব্যবহার করা হয়।
ভারতে যেহেতু জাত-পাতের বিচার ব্যাপক, তাই হুক্কা কিছু সমস্যা তৈরি করল। যেমন— ভিন্ন জাতের কেউ একই হুক্কায় মুখ লাগাতে পারতেন না, কেবল সমজাতের লোকই নির্দিষ্ট হুক্কায় মুখ রাখতেন। পরে যখন সস্তা ও সহজে বহনযোগ্য হুক্কা (ছিলুম নামে অধিক পরিচিত) বের হলো, তখন অনেকের সাধ্যের মধ্যে এলো এটি, পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হয়ে গেল। বলা বাহুল্য, বিড়ি আসার পর পরিবর্তনটা হলো যুগান্তকারী।
গুজরাটে বিড়ির উদ্ভব
সম্ভবত গুজরাটের খেড়া ও পঞ্চমহল জেলায় বিড়ির উদ্ভব, তামাকের চাষও সেখানে ছিল বেশি মাত্রায়। শ্রমিকরা পরিত্যক্ত তামাক বা গুড়ো অশ্বত্থ পাতায় মুড়িয়ে পান করতে শুরু করলেন। মোড়ানোর পাতা কোনটা ভালো হবে তার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা চলেছে। আমপাতা, কাঠালপাতা, কলাপাতা, শালপাতা এ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে, কিন্তু ভোক্তাদের ফুল মার্কস পায়নি, তাই পরীক্ষা অব্যাহত থেকেছে।
শুরুতে গুজরাটিরা নিজেদের ভোগের জন্যই বিড়ি বানাতেন, পরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে কেউ কেউ একে গৃহস্থালি ব্যবসায় পরিণত করেন। জনপ্রিয়তায় হুক্কাকে দ্রুতই পেছনে ফেলল বিড়ি, কারণ এতে কোনো জাতিকে আঘাত দেওয়ার সুযোগ রইল না, ধর্মীয় আবেগ ব্যাহত করার দরকার পড়ল না। বড় কথা, হুক্কা জ্বালানোর যে আয়োজন– তা অতি ব্যাপক, বিড়ি সেখানে খুব আয়াসসাধ্য।
উনিশ শতকের শেষে ব্রিটিশ কাগজে মোড়ানো সিগারেট উইলস নিয়ে আসে, তবে দামের কারণে এটা পরিগণিত হয় বিলাসদ্রব্য হিসাবে।
বিড়ির ব্যবসা যখন ঘর ছেড়ে বাজারে গেল, তখনও কিন্তু পরিসর ব্যাপক হয়নি। তামাক ক্ষেতের মালিক ও তার শ্রমিকরা থালে বিড়ি সাজিয়ে ম্যাচ নিয়ে হাজির হতেন বাজারে। লোকেরা একটি-দুটি করে কিনতেন আধা পয়সা বা সিকি পয়সায়। পরে যেসব গুজরাটি পরিবার মুম্বাইতে গিয়ে বসতি গড়েছিল, তারা দেখল এর বিস্তৃত বাজার আছে। শীঘ্রই তারা বেশি বেশি বিড়ি বানাতে থাকল, এক সময় মুম্বাইয়ের বাইরেও বিড়ির চাহিদা দেখা গেল। কিন্তু ১৯০০ সাল পর্যন্ত বিড়ি উৎপাদন কেবল মুম্বাইয়ে এবং দক্ষিণ গুজরাটেই সীমিত ছিল।
টেণ্ডু পাতা আবিস্কার
১৮৯৯ সালে গুজরাট এক মহাদুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে, যা অগুনতি লোককে জীবিকার খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। তখন বিভিন্ন জায়গায় বিড়ির অনেক ছোট ছোট কারখানা গড়ে ওঠে। তবে আধুনিক বিড়ির জনক বলা হয় আহমেদাবাদের মোহনলাল প্যাটেলকে— যিনি স্থানান্তরিত হয়েছিলেন জব্বলপুরে।
গোড়ার দিকে তিনি বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের ছোটখাটো যোগানদার ছিলেন। কিছুদিন পরে তার ভাই হরগোবিন্দ তার সঙ্গে এসে যোগ দেন। তারা দেখেন বাজারে বিড়ি কেবল দুর্ভিক্ষতাড়িত ভাটিয়া মোরারজির দোকানেই পাওয়া যায়। মোরারজি সেগুলো আনেন মুম্বাই থেকে, আর চড়া দামে বিক্রি করেন। প্যাটেল ভাইরা দেখলেন বড় সুযোগ, তারা জব্বলপুরেই বিড়ি বানানো শুরু করলেন এবং তাদের বানানো বিড়ির বাজার তৈরি হলো।
তবে জনপ্রিয়তা হু হু বেড়ে গেল, যখন তারা মোড়ানোর জন্য টেণ্ডু পাতা আবিস্কার করলেন। জব্বলপুরের বনাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে টেণ্ডু পাতা পাওয়া যেত, অশ্বত্থ পাতার চেয়ে তা ছিল হাজারগুণে ভালো। র্যাপার বা মোড়ক হিসাবে টেণ্ডুর গুণের শেষ ছিল না; কারণ এটি বড় হতো, নমনীয় ছিল এবং শুকনো পাতা মোড়ানোর সময় ভেঙে যেত না। এর বহির্গাত্রের চামড়াজাতীয় মসৃণতাও আদরণীয় ছিল।
মধ্য ভারতে ১৮৯৯ সালে রেলপথের দ্রুত সম্প্রসারণ প্যাটেল ভাইদের তামাক পরিবহন ও বিড়ি বিক্রি সহজ করে তুলেছিল।
স্বদেশী আন্দোলনেরও অবদান আছে
মুম্বাইয়ে ১৯০১ সালে বিড়ির প্রথম ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করেছিলেন হরিভাই দেশাই। প্যাটেল ভাইরা নিবন্ধন করেন পরের বছর। রেলপথ যত বেড়েছে, বিড়ির প্রসারও তত বেড়েছে। ১৯১২ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে তেলেঙ্গানা, হায়দ্রাবাদ, ম্যাঙালোর আর মাদ্রাজে রেলপথ বিস্তৃত হয়, সেই সঙ্গে পৌঁছে যায় বিড়ি।
বিড়ি সম্প্রসারণের আরেক অণুঘটক স্বদেশী আন্দোলন। ১৯২০ সালের দিকে ব্রিটিশ তথা বিদেশি পণ্য বর্জনের এ আন্দোলন ভারতীয় কুটির শিল্পের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। বিড়ির ক্ষেত্রে ঘটনাটি ঘটল যখন শিক্ষিত ও ধনীক গোষ্ঠী সিগারেট ছেড়ে বিড়ি হাতে তুলে নিলেন। পকেটেও মজুদ করলেন। অনেকের জন্য নিজেকে স্বদেশি প্রমাণের একটি উপকরণ হয়ে উঠল বিড়ি।
জওয়ানরা বিড়ি রেশন পেতেন
পরের পর্বটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের। বিড়ি কারখানা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হল। ভারতীয় যেসব জওয়ানরা বিদেশভূমে যুদ্ধ করতে গেলেন, তারা রেশন হিসেবে বেশ পরিমাণে বিড়ি পেতেন। এ সময়ে বিড়ির চাহিদা এতো বেড়ে গিয়েছিল যে, বলতে গেলে প্রতিদিনই নতুন নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠা পেতে থাকল।
ষাটের দশকে যখন বিড়ি কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা বেড়ে গেল, তখন অনেকে এমনকি তামাকের ওষুধি গুণাগুণ প্রচার করতে থাকলেন, তরুণদের আকৃষ্ট করতে টেলিফোন, ট্রেনের নামে ব্র্যান্ড নেম রাখা হলো। এসঙ্গে চলচ্চিত্র তারকা, খেলোয়াড় এমনকি মুষ্টিযোদ্ধাদের বিড়ির মডেল বানানো হলো।
সত্তরের দশকে ভারতে ৮০০ বিলিয়ন থেকে ১.২ ট্রিলিয়ন বিড়ি উৎপাদিত, যা বর্তমানের প্রায় কাছাকাছি।
বাংলাদেশে আশির দশক
বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে গড়ে তামাক পাতার উৎপাদন ছিল সাড়ে ৪০ হাজার টন। বিড়ি ও তামাকজাত অন্যান্য জিনিসের গড় উৎপাদন ছিল প্রায় ১১ হাজার টন। আশির দশকের শুরুতে পাতার ও তামাকজাত জিনিসের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৪৬ হাজার টন ও ১৫ হাজার টন।
১৯৮৩ সালে বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন) এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশে ১৩৩০টি বিড়ি প্রস্তুতকারী কুটির শিল্প ছিল— যেগুলোতে স্থায়ী বিনিয়োগ ছিল ১৫ মিলিয়ন টাকা এবং ৫,০৭৫ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছিল সেগুলোতে।
ফকিরচাঁদ বিড়ি ফ্যাক্টরি, ভান্ডারি বিড়ি ফ্যাক্টরি, আবুল বিড়ি ফ্যাক্টরি এবং আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি এই শিল্পে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
বিড়ি জ্বালাইলে
শেষ করা যাক বলিউডের ওমকারা ছবির একটি গান দিয়ে। ছবিটির নির্মাতা বিশাল ভরদ্বাজ। অজয় দেবগন, কারিনা কাপুর, সাইফ আলী খান, বিবেক ওবেরয় ছিলেন এর পাত্র-পাত্রী। এর একটি আইটেম গানে উপস্থিত হন বিপাশা বসু। এই গানটিই আমাদের লেখায় জায়গা পাচ্ছে, কারণ বিড়ি আছে গানটিতে।
এতে বলা হচ্ছে, 'আমার লেপ নেই, কাঁথা নেই, অথচ ঠান্ডা খুব। তবে আমার জিগার বা অন্তর খুব গরম। এতোই গরম যে, সেখান থেকে আগুন নিয়ে তুমি তোমার বিড়ি জ্বালাতে পারো।'
বিবেক ওবেরয় এনডিটিভিকে বলেছেন, "একটি হিট গান চাইছিলেন বিশাল ভাই। তিনি গিয়ে ধরলেন গুলজারকে। বললেন, 'আমি একটি হিট গান চাই, আপনি কথাগুলো লিখে দেন।' গুলজার সাব বেশি দেরি করলেন না, তিনি কথাগুলো লিখে দিলেন, আমরা পড়ে নিয়ে বললাম, বাজিমাৎ হবে।"
"গানের শুটিং শুরু হয়েছিল সন্ধ্যায়, যত রাত বাড়তে থাকল শীত জাকিয়ে বসল, আক্ষরিক অর্থেই সেটা ছিল বরফগলা রাত। তবে গান শুরু হতেই দেখি শীত গায়েব, সবাই নাচছে, পাত্র-পাত্রীরা তো বটেই, শত শত এক্সট্রা আর্টিস্টরাও। গানটি এতোই হিট হয়েছিল যে, বছরের পর বছর এটি ছিল পার্টি সংগীত হিসাবে এক নম্বর," বলেন বিবেক।
শহীদুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলাম, গানটি শুনেছেন কি-না। তিনি বললেন, "রাস্তা-ঘাটে শুনে থাকতে পারি, তবে নিজে আগ্রহ করে শুনিনি। সংগ্রহ তো করি নিজের আনন্দের জন্য, গানের বিড়ি আমার অতো দরকার পড়ে না।"
ছবি: সালেহ শফিক/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড