গোপনে বের হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য, তৈরী হচ্ছে পশুখাদ্য
উচ্চ ক্রোমিয়াম যুক্ত ট্যানারির বর্জ্য গোপনে পাচার করছে সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটকে ঘিরে ওঠা একটি চক্র, যা দিয়ে তৈরী হচ্ছে পশুখাদ্য।
ফলে মাছ ও মুরগির মাধ্যমে ট্যানারির ক্রোমিয়ামযুক্ত বিষাক্ত বর্জ্য মানবদেহে প্রবেশের মাধ্যমে ক্যান্সারসহ জটিল রোগের শঙ্কা তৈরী করছে।
ট্যানারির বর্জ্যে পশুখাদ্য তৈরী করা মাছ ও মুরগির খামার বন্ধ করতে হাইকোর্ট নির্দেশনা দিলেও মানা হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ট্যানারিকে ঘিরে একটি চক্র ক্রোমিয়ামযুক্ত কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করে সাভার, কেরানীগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে। এসব বর্জ্য গলিয়ে পাঠানো হচ্ছে পশুখাদ্য তৈরী ও মশার কয়েল তৈরীর কারখানায়।
সাধারণত চুক্তি ভিত্তিতে ট্যানারির কঠিন বর্জ্য (শেভিং ক্রাস্ট ও কাটিং) পরিবহন করে নির্ধারিত ডাম্পিং স্টেশনে অপসারণ করে গাড়ির মালিকরা। এক থেকে দেড় টনের একেকটি গাড়িপ্রতি বর্জ্য অপসারণে ব্যয় ১৫০০ টাকা, যা ট্যানারি মালিককে দিতে হয়। তবে চক্রটি বিনা খরচেই কারখানা থেকে এসব বর্জ্য সংগ্রহ করছে।
জানা যায়, চামড়া শিল্প নগরীর হাতে গোনা কয়েকটি ট্যানারি ব্যতীত অধিকাংশ ট্যানারিই ব্যয় কমাতে কঠিন বর্জ্য চক্রটির হাতে তুলে দিয়ে দিচ্ছে। এসব ট্যানারির মধ্যে অন্যতম প্রগতি লেদার, আর.কে লেদার, শাহজালাল ট্যানারি, ইন্টারন্যাশনাল লেদার, রিলায়েন্স ট্যানারি, সমতা ট্যানারি, সমতা-২, হেমকো লেদার, স্বাধীন ট্যানারি, জুলিয়েট ট্যানারি, মার্চারি ট্যানারি ও নিউ কাজল ট্যানারিসহ আরও বেশ কিছু কারখানা।
গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রগতি লেদার থেকে সংগ্রহকৃত প্রায় ৮ টন বর্জ্য পরিবহনকালে দুটি গাড়ি আটক করে বিসিক। পরে গাড়িগুলো আটক করে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে হস্তান্তরের পাশাপাশি একটি মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নং-৯৮)।
মূলত, ট্যানারির বর্জ্য ডাম্পিং ইয়ার্ডে ফেলার নিয়ম থাকলেও নিরাপত্তা কর্মী ও কর্মকর্তাদের যোগসাজসে শিল্পনগরীর বাইরে চলে যাচ্ছে।
ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানির সুপারভাইজার, শিল্প নগরীরর নিরাপত্তাকর্মী, বর্জ্য পরিবহনকারী পিক-আপ মালিক, গাড়ির চালক, শিল্প নগরী সংলগ্ন এলাকা ও হাজারিবাগের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এসব কঠিন বর্জ্য পাচার করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রোমিয়ামযুক্ত শেভিং ক্রাস্ট, চামড়ার বিভিন্ন কাটিং অংশ সংগ্রহের পর তা একটি চুলায় গলানো হয়। এসব গলিত বর্জ্য রোদে শুকিয়ে মেশিনের সাহায্যে অনেকটা গুঁড়ো করে পাঠানো হয় বিভিন্ন মাছ-মুরগীর খাদ্য তৈরির কারখানায়। পরবর্তীতে অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল মিশিয়ে তৈরি হয় পশুখাদ্য পোল্ট্রি ও ফিস ফিড।
এ বিষয়ে ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী সত্যেন্দ্র নাথ পাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আর্থিক সুবিধা নিয়ে এসব বর্জ্য পাচারে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১১ সেপ্টেম্বর সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. কামাল হোসেনকে চাকরিচ্যুত করা হলেও চক্রটির দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যায়নি।"
বিষয়টিকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির মালিক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, "সবাইকে সতর্ক করে ১ কেজি বর্জ্যও যেন ট্যানারি থেকে বের হতে না পারে, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসোসিয়েশনের কারও বিরুদ্ধে বর্জ্য বাইরে পাঠানোর অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
চামড়া শিল্প নগরী বিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান রিজওয়ান টিবিএসকে বলেন, "বর্জ্য পাচার বন্ধে ডাম্পিং স্টেশনে যেন বড় ট্রাক প্রবেশ করতে না পারে সেই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সিইটিপি পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। প্রতিটি গেইট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।"
বর্জ্য পরিবহনে জড়িত একটি গাড়ির চালক মো. নয়ন টিবিএসকে বলেন, ২০১৯ সালে র্যাবের ধারাবাহিক অভিযানের পর কিছুদিন বন্ধ ছিল বর্জ্য পাচার। তবে সম্প্রতি আবারও একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাত ধরে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
সরেজমিন অনুসরণ
গত ১৪ অক্টোবর চামড়া শিল্প নগরী থেকে ক্রোমিয়াম যুক্ত বর্জ্য (শেভিং ক্রাস্ট) বোঝাইকৃত একটি পিকআপ অনুসরণ করে এই প্রতিবেদক।
এতে দেখা গেছে, ধলেশ্বরী নদীর তীরে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া মধুরচর এলাকার একটি কারখানায় যায় পিকআপটি যেখানে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করছে। এই কারখানাটির মালিক নাহিদ। তিনি বলেন, "বর্জ্য গলিয়ে প্রতি মাসে ৪০ থেকে ৫০ টন পরিমাণ আঠা উৎপাদিত হয়, যা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাঠানো হয়।"
তিনি বলেন, "ট্যানারি থেকে শেভিং ক্রাস্ট ও হাজারিবাগ থেকে চামড়ার কাটিং অংশ সংগ্রহ করে গলিয়ে পশুখাদ্য ও মশার কয়েল তৈরীর কারখানায় পাঠানো হয়।"
হেমকো, আর.কে ও প্রগতিসহ কয়েকটি ট্যানারির বর্জ্য পরিবহনের কন্ট্রাক্টর রিপন টিবিএসকে জানান, এই কাজে তার মোট ৩টি পিকআপ ব্যবহৃত হয়।
কামাল নামে একজন গাড়িচালক টিবিএসকে বলেন, "হেমায়েতপুরের ঝাউচর এলাকার উজ্জল, পারভেজ, মান্নান ও হাজারিবাগ এলাকার আরেক ব্যক্তি রয়েছে এই সিন্ডিকেটে। ইন্টারন্যাশনাল ট্যানারির গাড়িচালক কামাল ও নুর আলম নামে একজন কন্ট্রাকটরসহ আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে এই সিন্ডিকেটে।"
কামাল জানান, হেমায়েতপুরের সিন্ডিকেটের কাজ শুধু কারখানার বর্জ্য বের করতে সংশ্লিষ্টদের 'ম্যানেজ' করা। গাড়ি বের করতে সিইটিপি কোম্পানীর সুপারভাইজার হিমেল, আল আমীন, বিভিন্ন গেইটের দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি গার্ড ও পুলিশকে ম্যানেজ করতে হয়।
সাভারের মধুমতি মডেল টাউন ও কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ বালুর চর ও কোনাখোলা এলাকায় ক্ষতিকারক বর্জ্য গলানোর একাধিক স্পটের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখান থেকে প্রতিমাসে শত শত টন বর্জ্য গলিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
সাভারের মধুমতি মডেল টাউনের ভিতরে গড়ে তোলা বর্জ্য গলানোর স্পটটিতে দেখা যায়, ভাকুর্তা মোগড়াকান্দা এলাকার আবুল নামে এক ব্যক্তি এটির দেখভাল করেন।
টিবিএসের কাছে তিনি দাবি করেন মূলত জমিটিসহ এই স্পটের মালিক সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুল বাতেন।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে আব্দুল বাতেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি এই বর্জ্য গলানোর সাথে জড়িত না দাবি করে মুঠোফোনের সংযোগটি কেটে দেন।
এই চক্রের সাথে জড়িত থাকা, গাড়িপ্রতি টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের সুপারভাইজার (কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা) হিমেল ও সুপারভাইজার (ইলেক্ট্রিক) আল আমীন।