ভালভ ও অক্সিজেনেটরের তীব্র সংকটে ব্যাহত হৃদরোগের চিকিৎসা
হৃদযন্ত্রের কৃত্রিম ভালভ ও অক্সিজেনেটরের তীব্র ঘাটতিতে দেশের হাসপাতালগুলোতে হৃদযন্ত্রের চিকিৎসা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ভালভ ট্রান্সপ্ল্যান্ট এবং ওপেন হার্ট সার্জারিসহ হৃদযন্ত্রে বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচারের জন্য কৃত্রিম ভালভ এবং অক্সিজেনেটর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সংকটের কারণে গত দেড় মাসে কোনো ভালভ প্রতিস্থাপিত হয়নি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিস (এনআইসিভিডি)-এ ভালভের সংকট কিছুটা কমলেও অক্সিজেনেটরের তীব্র সংকটে হাসপাতালটিতে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি, ওপেন হার্ট সার্জারি ও ভালভ প্রতিস্থাপন ব্যাহত হচ্ছে।
অক্সিজেনেটর হল একটি মেডিকেল ডিভাইস, যা ওপেন বাইপাস সার্জারির সময় সাময়িকভাবে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতাকে প্রতিস্থাপন করে।
কৃত্রিম ভালভ ও অক্সিজেনেটর, কোনোটাই দেশে তৈরি হয়না; এগুলো পুরোটাই আমদানি নির্ভর। সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে এই দুটি মেডিকেল ডিভাইসের কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এলসি জটিলতায় আমদানিতেও তৈরি হয়েছে সংকট। যার কারণে রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এক চিকিৎসক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কৃত্রিম ভালভের প্রচণ্ড সংকট। ঢাকার সব হাসপাতাল থেকে ভালভের রোগীকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
"আগে প্রতি মাসে আমাদের হাসপাতালে ৫০ থেকে ৬০টি ভালভ প্রতিস্থাপন করা হতো। ভালভ না থাকার কারণে গত মাসে একটিও প্রতিস্থাপন করা হয়নি। সব হাসপাতালেই প্রায় একই অবস্থা। ভালভের রোগীকে হাসপাতাল থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, "গত তিনমাস ধরে ভালভের সংকট। তবে মাঝখানে একটি কোম্পানি ৮০টি ভালভ এনেছিল, তাতে কিছুটা কাজ হয়েছে। এ মাসে আরেকটি কোম্পানি কয়েকটি ভালভ এনেছে, তবে তা কতজন রোগীকে দেওয়া যাবে জানিনা। আমদানিকারক কোম্পানিগুলো আমাদের জানিয়েছে এলসি জটিলতার কারণে বেশি ভালভ আনা সম্ভব হচ্ছে না।"
ভালভ সংকটের কারণে অপারেশন হচ্ছেনা; রোগীর চিকিৎসা হচ্ছেনা। অনেক রোগী আছেন, যাদের ভালভ প্রতিস্থাপন জরুরি। দ্রুত এই চিকিৎসা না হলে অনেক রোগী আছেন, যাদের আদৌ আর চিকিৎসা করা যাবেনা, হয়তো বাঁচবেন না বলে উল্লেখ করেন এই কার্ডিয়াক সার্জন।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ হাজার ২০০-এর বেশি ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতি মাসে বাংলাদেশে প্রয়োজন হয় গড়ে ১০০ থেকে ১২০টি ভালভের।
অক্সিজেনেটর ও ভালভ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হার্টের ভালভ ও অক্সিজেনেটর আমদানি করা হয় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসব ডিভাইস তৈরির কাঁচামাল বেলারুশ, ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাঁচামাল সংকটে পড়েছে এই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সঙ্গে করোনা মহামারির কারণে প্রস্তুতকারকরা তাদের বহু কর্মী ছাঁটাই করেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না।
বাংলাদেশে ইউনিমেড লিমিটেড, স্পেস মেড এন্টারপ্রাইজ, বায়োকার্ড লিমিটেড, কার্ডিওহেল্প লিমিটেড এবং স্পন্দন লিমিটেড হার্টের ভালভ এবং অক্সিজেনেটর সরবরাহ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভালভ ও অক্সিজেনেটর সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক টিবিএসকে বলেন, তারা আমেরিকার অ্যাবট ল্যাবরেটরিজ থেকে ভালভ আমদানি করেন। কিন্তু কোম্পানিটি এখন চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দিতে পারছেনা।
"হার্টের ভালভের কাঁচামালের মধ্যে পাইরোলেটিক কার্বন অন্যতম; যা ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশে পাওয়া যায়। যুদ্ধের কারণে কাঁচামাল সংকট দেখা দিয়েছে। আবার কোভিডে দুই বছর উৎপাদন বন্ধ ছিল; ফলে সংকট আরও বেড়েছে। আমাদের অনেকগুলো অর্ডার প্লেস করা আছে, কিন্তু সরবরাহ দিচ্ছেনা। এছাড়া, এখন স্বাচ্ছন্দ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী এলসিও খোলা যাচ্ছেনা," যোগ করেন তিনি।
তিনি তিনি আরও বলেন, "ভালভ সংকটের কারণে রোগীদের কষ্ট অনেক বেড়ে গেছে। ডাক্তাররা এখন রোগীদেরকে আমাদের ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছেন ভালভের খোঁজ নিতে। এমন কোনো দিন যায় না, যেদিন ৫০ জন রোগী আমাকে ফোন করেন না।"
ডিসেম্বররের শেষ বা জানুয়ারিতে ভালভ সংকট কাটবে বলে আশা প্রকাশ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা। তবে ভালভ সংকট কাটলেও অক্সিজেনেটারের সংকট আরো ভয়াবহ হবে বলে জানান তিনি। মার্চের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলে জানিয়েছে তাদের কোম্পানি।
এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীর জামাল উদ্দিন বলেন, "কিছু ভালভ এখন আমাদের হাতে আছে, কোম্পানিগুলো মোটামুটি ঘাটতি কাটিয়ে উঠছে। কিন্তু মূল সমস্যা অক্সিজেনেটার নিয়ে। কোম্পানিগুলো এখন এটি দিতে পারছে না। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের লিখিত দিয়েছে, আপাতত তাদের পক্ষে অক্সিজেনেটর সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না।"