বাস্তবায়নে অগ্রগতিহীন কিংবা ধীরগতির প্রকল্প বাতিল করা হবে: পরিকল্পনা কমিশন
দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নের কাজ চললেও অগ্রগতিহীন প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে সেগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অর্থাৎ এসব প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রাপ্ত ১৫টি মন্ত্রণালয় / বিভাগের চলমান প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের সভাপতিত্বে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছাড়াও ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনেক প্রকল্পে রয়েছে যেগুলো দীর্ঘদিনে ধরে চলমান থাকলেও বাস্তবায়ন কাজ বন্ধ রয়েছে, বা বাস্তবায়ন কাজ শুরুই করাই সম্ভব হয়নি। এতে প্রকল্পগুলোর কোনো বাস্তবায়ন অগ্রগতি নেই।
প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকলেও এ ধরনের প্রকল্পে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। প্রকল্পে নিয়োজিত জনবলের বছর বেতন-ভাতা পাচ্ছে। অফিস ভাড়ায় অর্থ ব্যয় হচ্ছে, বিদ্যুৎ বিলও দেওয়া হচ্ছে প্রকল্প থেকে। এতে সরকারি অর্থেরও অপচয় বাড়ছে।
আবার এমনও কিছু প্রকল্প রয়েছে- যেগুলোর কাজ বন্ধ হলেও জাতীয় উন্নয়নে কোনো প্রভাব পড়বে না। এ ধরনের প্রকল্প দ্রুত চিহ্নিত করতে বলেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী।
পরিকল্পনা মন্ত্রী বৈঠকে বলেন, "অগ্রগতিহীন প্রকল্প তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হলে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে।"
সংশ্লিষ্টরা জানান, দরপত্র জটিলতায়, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, বৈদেশিক অর্থায়ন জটিলতা ছাড়াও বিভিন্ন কারণে অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা সম্ভব হয় না।
এ ধরনের একটি প্রকল্প সভায় উপস্থাপন করা হয়। প্রকল্পটি হলো বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭০ মিটারগেজ (এমজি) ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন দেওয়া হয় এ প্রকল্পের। কিন্তু এক যুগেও প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি হয়নি।
প্রকল্পটির প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় দরপত্রের বিপরীতে দরদাতা পাওয়া যায়নি। পরে দরপত্রের টেকনিকাল স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
৩য় দফার দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান হিউন্ডাই রোটেমের সাথে ২০১৮ সালের অক্টোবরে চুক্তি করে রেলওয়ে। কিন্ত তাদের দাখিল করা ক্রেডিট প্রোপোজাল অনমনীয় হওয়ায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এ ঋণ নিতে রাজি হয়নি।
এ বছরের আগেষ্ট মাসে ঠিকাদারের সঙ্গে ক্রয় চুক্তি বালিত করে রেলওয়ে। গত সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্পটি বাতিল না করে সরকারি অর্থায়নে অথবা সহজ শর্তে বৈদেশিক অর্থায়নে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. মামুন-আল-রশিদ টিবিএসকে বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়ন কাজ হলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প সমাপ্ত করা হবে কেইস টু কেইস ভিত্তিতে।"
"৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে, এমন প্রকল্প সমাপ্ত করা হতে পারে যদি তার অগ্রগতি না থাকে। যেমন ভারতীয় ঋণের কোনো কোনো প্রকল্পে তাদের কারণে বাস্তবায়ন বিলম্ব হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যদি মনে হয় প্রকল্প বাদ দেওয়া উচিত, তবে তা ই করা হবে।"
আবার দরপত্র জটিলতার কারণে অনেক প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। এ ধরণের প্রকল্প তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে বলা হয়েছে। পরে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করবে বলে জানান পরিকল্পনা বিভাগের সচিব।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়ন কাজ হলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ এবং প্রশাসনিক অনুমোদন দিতেও অনেক সময় নেয়।
মঙ্গলবারের সভায় প্রকল্প অনুমোদনের ৫ দিনের মধ্যে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্প একনেকে অনুমোদনে পর, পরিকল্পনা কমিশনের চিঠি পাওয়ার একদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্পের প্রশাসনির অনুমোদন দিতে হবে।
এদিকে, সভায় অনুমোদন ছাড়া ডেলিগেটেড ওয়ার্ক পরিবর্তন করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
কোনো মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের কাজ যদি অন্য কোনো সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন করে তাকে ডেলিগেটেড ওয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- দেখা যায় স্বাস্থ্য বিভাগ বা কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোনো ভবন নির্মাণের কাজ বাস্তবায়নের জন্য গণপুর্ত অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অনেক নির্বাহক এজেন্সি (গণপুর্ত অধিদপ্তর) অর্পিত ক্রয় কার্যের স্থান, নির্মাণসামগ্রী, বা ডিজাইন পরিবর্তন করে স্বত্তাধিকারী মন্ত্রণালয়/ বিভাগের অনুমোদন না নিয়ে। এতে উন্নয়ন প্রকল্পের অপচয় বাড়ে।
এ কারণে স্বত্তাধিকারী মন্ত্রণালয়/ বিভাগের অনুমোদন ছাড়া প্রকল্প কাজের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। এক্ষেত্রে কোনো ব্যতয় হলে সরকারি ক্রয় বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মঙ্গলবারের সভায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সভায় গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প (বিআরটি, গাজিপুর-এয়ারপোর্ট) বাস্তবায়নকালে জনদুর্ভোগের বিষয়টি আলোচনা উঠে হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সপ্তাহে মাত্র দুই দিন প্রকল্পের কাজ করা যায় বলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্ব হচ্ছে।
এই প্রকল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরুর আগেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিষয়টি চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। যাতে প্রকল্প বাস্তবায়নকালে জনদুর্ভোগ না হয়।
তাছাড়া, যদি ভুমি অধিগ্রহণ জটিলতার পড়ে কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনিশ্চিয়তায় পড়ে, তাহলে সেই প্রকল্প সমাপ্ত করা হতে পারে বলে জানান পরিকল্পনা বিভাগের সচিব।
সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে মোট ৮২.৬৫% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন খুবই কম।
অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া সেতু বিভাগ ৩৭% অর্থ ব্যয় করলেও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ব্যয় করেছে মাত্র ৪.৫৪% অর্থ।
সর্বোচ্চ বরাদ্দের তালিকায় থাকা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫.৭৩%, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ৬%, বিজ্ঞাপন ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ৮.০৩%, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ৮.৬৭%, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ৮.৭৫% অর্থ ব্যয় করেছে।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সেতু বিভাগ ছাড়াও বিদ্যুৎ বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগের এডিবি বাস্তবায়ন হারে কিছুটা গতি রয়েছে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।