জলচর পরিযায়ী পাখিদের শিকার বন্ধে চাই আমাদের সুস্থ মানসিকতা
কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে বাংলায় এসে পড়েছে শীত। আর বাংলার বুকে আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখিরা। যদিও সারা বছর ধরে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি আসে, কিন্তু শীতকালে সব থেকে বেশি সংখ্যায় এই পাখিদের আগমন ঘটে। বাংলাদেশর পাখিদের মধ্যে ২০৮ প্রজাতির পাখি শীতকালে এই দেশে পরিযান করতে আসে। সারা দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে এই পাখিদের আগমন ঘটলেও জলাশয়কেন্দ্রিক প্রতিবেশ ব্যবস্থায় এদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। কিন্তু শিকার, আবাসস্থল ধ্বংসসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে আজ তারা হুমকির মুখে।
বাংলাদেশের জলাশয়গুলোতে আসা পরিযায়ী পাখিগুলোর মধ্যে বুনোহাঁস, ডুবুরি, মানিকজোড়, কস্তেচোরা, বিভিন্ন প্রজাতির সৈকত পাখি, গাংচিল, পানচিল, পরিযায়ী পেঁচা, শিকারি পাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গায়ক পাখির প্রাধান্য থাকে। আমাদের জলাশয়ের সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাসহ দেশের অর্থনীতিতে রয়েছে এই পাখিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে অবগত নয় কিংবা অবগত হলেও আইন পালনে আগ্রহী নয়। এর অন্যতম কারণ শখ বা সাময়িক আনন্দ লাভ।
বিগত বছরগুলোতে গবেষণার একটি বড় অংশ ছিল জলচর পাখিদের শিকার ও এদের শিকারের ধরন, কারণ ইত্যাদি নিয়ে। বর্তমানে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করতে ছুটে বেড়াতে হয় দেশের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে জলাভূমিগুলোতে। কথা হয় প্রত্যন্ত এলাকার নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। শুনি বন্যপ্রাণীর অতীত, বর্তমানের কথা, তাদের সমস্যার কথা। বন্যপ্রাণী বিশেষ করে পাখিদের গল্পের কথা। জলচর পাখিদের দুর্দশার কথা।
আমাদের জলশয়ের সংখ্যা তো ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছেই, তার সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে এখানকার গুণগত মানও। প্রবীণ ব্যক্তিরা যখন তাদের ছোটবেলার পাখির গল্প করেন, তখন বোঝা যায় আসলেই আমাদের জলাভূমিগুলো অনেক সমৃদ্ধ ছিল একটা সময়ে।
অবৈধ পাখি শিকার জলচর পাখি বিশেষ করে জলচর পরিযায়ী পাখিদের কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত। শীত এলে এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কতিপয় ব্যক্তির রসনার শিকার হচ্ছে পাখিরা। বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিসহ বক, বগা-বগলা, বুনো হাঁস, ডাহুক, কালেমের, শামুকখোলের মতো পাখি বেশি ঝুঁকিতে। বিষটোপ, এয়ারগান, ফাঁদ ব্যবহার তো ব্যবহার করা হয়ই। তবে এখন পাখির ডাক নকল করে, বাঁশি বাজিয়ে ও মোবাইল বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমেও হচ্ছে পাখি শিকার। এয়ারগান সম্প্রতি নিষিদ্ধ করা হলেও তা কতজন মেনে চলছে এটা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।
কিন্তু এই যে বর্তমানে জলচর পাখি শিকার হচ্ছে, এটা কি আমাদের যে প্রোটিন এর চাহিদা বা মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য হচ্ছে? আমার পর্যবেক্ষণ যা বলে, শুধুমাত্র প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য মোটেই না। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট, বিভিন্ন সংগঠন, সেচ্ছাসেবী সংস্থা, সরকারি অফিসের বরাতে এখন জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ জানে যে, এসব পাখি ধরা, বিক্রি করা ও খাওয়া বেআইনি।
তাহলে? একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, জলচর পাখিদের শিকার, বিক্রির জায়গাগুলোর অধিকাংশই পর্যটন বা বিনোদনকেন্দ্রগুলোর আশপাশেই অবস্থিত।
দিন দিন আমাদের পর্যটন খাত উন্মুক্ত হচ্ছে, যা আমাদের জন্য আশীর্বাদসূচক। কিন্তু পাশাপাশি আমাদের জীববৈচিত্র্যের ওপর অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের জন্য যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে সেটি হয়তো আমাদের সামনে প্রকট হতে কিছুটা সময় লাগবে, কিন্তু ততদিনে কিছু করার হয়তো থাকবে না।
উদাহরণস্বরূপ আসি সিলেট অঞ্চলে। বাংলাদেশের এই অঞ্চল, হাওড় বা জলাভূমির জন্য বিখ্যাত, যা পরিযায়ী জলচর পাখিদের জন্য আদর্শ আবাসস্থল। প্রতিবছর হাজার হাজার পাখির আগমন ঘটে এসব হাওড় বা জলাশয়ে।
সিলেট শহরের পর হরিপুর নামক একটি জায়গা রয়েছে। গুগলে 'পাখিশিকার', 'হরিপুর', 'সিলেট' এই তিনটি শব্দ দিয়ে সার্চ করলে ওখানকার পাখি শিকার নিয়ে প্রচুর খবর আপনার সামনে আসবে। ওখানে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালত, কিংবা স্থানীয় সচেতন মানুষের সহায়তায় বারবার দমন করার চেষ্টা করা হলেও এখনো ডেকে ডেকে পাখির মাংস বিক্রি করা হয়। কিছুদিন আগে স্বচক্ষে বিষয়টি দেখার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে।
এখন যদি খবরগুলো খেয়াল করি, কিংবা নিজের মাঠ পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, এরকম জায়গাগুলোতে পাখির মাংস বিক্রির অন্যতম প্রধান কারণ হলো ক্রেতাদের আগ্রহ। পাখির মাংস খাওয়ার বিকৃত ইচ্ছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এদের একটি বড় অংশ কিন্তু শিক্ষিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ কিন্তু এসব জায়গায় ভ্রমণে আসেন না। দলগতভাবে ঘুরতে গিয়ে, বিশেষ করে তরুণ কিংবা পেশাজীবীরা এই কাজের সাথে জড়িত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তো পাখির মাংস খাওয়া আলাদা বাহাদুরি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং দুঃখজনক হলেও একে তারা গর্বের কাজ হিসেবে বিবেচনা করে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং মো. মাহাবুব আলমের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাওড়, বিল অঞ্চলে জলচর পাখিদের নিয়ে কাজ করার সময়েও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের শিকারের চেয়ে ঘুরতে আসা লোকজন কর্তৃক শিকারের হার অনেক বেশি।
তাই বলে কি আমাদের পর্যটনকে আমরা এখন সব দোষ দেব? অবশ্যই না। কারণ আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ওপর। পাখিদেরও বেঁচে থাকার গুরুত্ব আছে। আর পাখিরা মানুষের কল্যাণের জন্য বেঁচে থাকে এটা শুধু বোঝা নয়, উপলব্ধিও করতে হবে। মন থেকে পাখি সংরক্ষণে আগ্রহী হতে হবে।
প্রয়োজন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। তাহলেই বেঁচে থাকবে আমাদের জলচর পাখিরা।
-
আশিকুর রহমান সমী: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিস, সিইজিআইএস, বাংলাদেশ