সুন্দরবনে শুরু হয়েছে বাঘ গণনা কার্যক্রম
'সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের' আওতায় সুন্দরবনে বাঘ গণনার কাজ শুরু হয়েছে। দেড় বছর পর ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এ গণনার ফলাফল প্রকাশ করবে বন বিভাগ।
বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে সুন্দরবনে পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের কালাবগি ফরেস্ট স্টেশনের আওতাধীন এলাকায় এ কার্যক্রম শুরু হয়।
বন বিভাগ জানায়, বাঘ গণনার জন্য প্রথমে নদী-খাল জরিপ করে বাঘের পায়ের ছাপ দেখে এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে ক্যামেরা বসিয়ে বাঘের ছবি তুলে তা বিশ্লেষণ করা হয়।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ও বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, 'বৃহস্পতিবার থেকে আমাদের একটি দল বনে নদী-খাল জরিপের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ক্যামেরা বসানো শুরু হবে।'
সুন্দরবনের প্রায় ৮০০টি গ্রিডে ক্যামেরা বসিয়ে বাঘসহ অন্যান্য প্রাণীর ছবি তোলা হবে বলে জানান তিনি। পরে ছবিগুলো প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হবে।
ড. আবু নাসের বলেন, 'আগামী তিন মাস এ ধরনের জরিপ ও ক্যামেরা ট্র্যাপিং চলবে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের নভেম্বরে আবারও একইভাবে জরিপ ও ক্যামেরা ট্র্যাপিং করা হবে। ২০২৪ সালের সালের মার্চ মাসের দিকে আমরা এর ফলাফল জানাতে পারব।'
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৩ মার্চ 'সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প' শীর্ষক একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মেয়াদ ছিল চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত। এ প্রকল্পে দুটি অংশ রয়েছে। যার একটি হলো বাঘ গণনা ও অন্যটি হলো বাঘ সংরক্ষণ।
চলতি বছরের অক্টোবর মাস থেকে বাঘ গণনা অংশের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রকল্পটির অর্থছাড় হতে বিলম্ব হয়। পরবর্তীতে অক্টোবরের মাঝামাঝি প্রকল্পের বাঘ গণনা অংশের জন্য ৩ কোটি ২৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ছাড় করে পরিকল্পনা কমিশন।
ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, 'পরিকল্পনা কমিশন থেকে অর্থছাড়ের বিষয়টি অনুমোদনের পর বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছু প্রসেস ছিল। সেগুলো সম্পন্ন করে বাঘ গণনার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।'
বন বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের ১৩টি দেশে ৩ হাজার ৮৪০টি বাঘ প্রকৃতিতে টিকে আছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১৮ সালের জরিপ অনুয়ায়ী বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাঘ আছে ১১৪টি। যা ২০১৫ সালে ছিল ১০৬টি ও ২০০৪ সালের জরিপে ছিল ৪০৪টি।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, 'সম্প্রতি সুন্দরবনে বারবার বাঘ দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, বনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। তবে গণনা না করে বাঘের বর্তমান সংখ্যা বলা তো সম্ভব না।'
তিনি বলেন, 'সুন্দবনের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে বাঘের গুরুত্ব সবথেকে বেশি। এই প্রকল্পটি মূলত বাঘের বংশবৃদ্ধির জন্য নেওয়া হয়েছে।'
কী আছে প্রকল্পে
মিহির কুমার দে জানান, এ প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনে বাঘ গণনা করা, বাঘ গণনার জন্য আবাসন লঞ্চ ও সাপোর্ট বোট চার মাসের জন্য ভাড়া করা, ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে বাঘ গণনার জন্য ২০০টি বিশেষ ক্যাটাগরির ক্যামেরা সংগ্রহ, ব্যাটারি, এসডি কার্ড ক্রয়, জরিপ দলে অনিয়মিত শ্রমিক, ট্রলারচালক ও জরিপের সব কার্যক্রম পরামর্শক বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে পরিচালনা, জরিপ দলের সব সদস্যকে প্রশিক্ষণ প্রদান, উপাত্ত সংগ্রহ ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য ৩ কোটি ২৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল।
এছাড়া প্রকল্পের বাকি টাকার ব্যয় ধরা হয়েছে বাঘ সংরক্ষণের জন্য। তার মধ্যে রয়েছে সুন্দরবনের বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের ৩৪০ জন সদস্য ও চারটি রেঞ্জের কমিউনিটি প্যাট্রল গ্রুপের ১৮৫ জন সদস্যকে প্রশিক্ষণ প্রদান, তাদের পোশাক সরবরাহ ও প্রতি মাসে বনকর্মীদের সঙ্গে মাসিক সভা করা।
মিহির কুমার দে বলেন, 'সুন্দরবনে বাঘের ৮০ শতাংশ খাবার আসে হরিণ থেকে। এই প্রকল্পের আওতায় বাঘের শিকার হরিণ, বন্য শূকর—এ ধরনের প্রাণীর জরিপ করারও উদ্যোগ ছিল।'
এছাড়া বংশবৃদ্ধির জন্য পুরুষ ও নারী বাঘকে কাছাকাছি রাখতে বাঘ হস্তান্তর, তাদের বিচরণ এলাকা জানার জন্য দুটি বাঘে স্যাটেলাইট সংযুক্তি ও মনিটরিং করা, বাঘের পরজীবীর সংক্রমণ ও অন্যান্য ব্যাধি এবং মাত্রা নির্ণয়, উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ কার্যক্রম এ প্রকল্পটির আওতায় করার কথা রয়েছে।
মিহির কুমার দে বলেন, 'বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবনে প্রায় প্রতি বছর আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের যে অংশে আগুন লাগার প্রবণতা বেশি, সে জায়গায় দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ ও সুন্দরবনে আগুন লাগলে যাতে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানো যায়, আগুন নেভানোর যন্ত্রাংশ, পাইপ ও ড্রোন ক্রয় কার্যক্রমও এ প্রকল্পের মাধ্যমে করা হবে।
'সুন্দরবনে গ্রামসংলগ্ন এলাকায় নদী ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বাঘ গ্রামে প্রবেশ করে জানমালের হুমকি হয়ে থাকে। এজন্য ৬০ কিলোমিটার অংশে নাইলনের ফেন্সিং নির্মাণ করে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হবে।'
তিনি জানান, সুন্দরবনে ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা ও ২০২১ সালে ইয়াসের মতো বড় বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বনের সব এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তখন বনের বাঘ ও বাঘের শিকারপ্রাণী আশ্রয়ের জন্য লোকালয়ে প্রবেশ করে। বাঘ ও বাঘের শিকারপ্রাণী ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়ের জন্য সুন্দরবনে ১২টি মাটির কিল্লা স্থাপন করা হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
এ ছাড়া বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের সব কার্যক্রমে পরামর্শক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে বিশেষ প্রশিক্ষণ, জরিপ সম্পন্ন, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, প্রতিবেদন তৈরি কার্যক্রমে স্বল্পমেয়াদি ১২ জন পরামর্শক বিশেষজ্ঞের সংস্থান প্রকল্পে রাখা হয়েছে।