মরুর দেশ কাতার কিভাবে বিশ্বকাপের জন্য বিপুল পরিমাণ পানির যোগান দিচ্ছে?
রবিবার কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে মাঠে নামবে লাতিন আমেরিকান পরাশক্তি আর্জেন্টিনা এবং ইউরোপের দল ও বর্তমান ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে এই দিনটিতেই নির্ধারণ হয়ে যাবে কার হাতে উঠছে বিশ্বসেরার ট্রফি। গত এক মাস যাবত বিশ্বকাপকে ঘিরে যে উন্মাদনা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ ফুটবলপ্রেমীদের, তার অবসান ঘটবে রবিবারেই(১৮ ডিসেম্বর)। আর টুর্নামেন্ট শুরুর দিন থেকেই লুসাইল স্টেডিয়ামকে খেলার উপযুক্ত রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে ৩০০ টন পানি!
কাতারের রুক্ষ-শুষ্ক জলবায়ুর মধ্যে মূল স্টেডিয়াম ও অনুশীলনের মাঠের ঘাসগুলোকে সজীব ও সতেজ রাখতে মাঠের দায়িত্বরত স্টাফরা দৈনিক ১০,০০০ লিটার করে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপুল পরিমাণ পানি কোথা থেকে পাচ্ছে মরূর দেশ কাতার? বিশ্বকাপ উপলক্ষে এত এত টন পানি জোগাড়ের জন্য যে কাতার হিমশিম খাচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হয় বড় ধরনের ক্রীড়া ইভেন্ট আয়োজন করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা করতে কতখানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে কাতারকে।
মরুভূমির দেশ কাতার
বিশ্বকাপের গ্রাউন্ড স্টাফ বা মাঠের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যেসব কর্মীরা রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটি আরও গুরুতর হতে পারতো। সচরাচর যে সময়ে বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়, অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে; সে সময় যদি কাতারে তা আয়োজন করা হতো তাহলে ১৩৬টি অনুশীলন মাঠসহ স্টেডিয়ামগুলোতে প্রতিদিন ৫০,০০০ লিটার করে পানি ছিটাতে হতো!
অন্যান্য দেশের তুলনায় কাতারে 'এলিট প্লেয়িং সারফেস' তৈরি করার কাজটিকে 'ভিন্ন মাত্রার এক চ্যালেঞ্জ' বলে অভিহিত করেছেন স্টাফরা। তারা জানিয়েছেন, টুর্নামেন্ট চলাকালে ব্যবহারের জন্য দোহার উত্তরাঞ্চলে ৪২৫,০০০ বর্গমিটার জরুরি ঘাস রিজার্ভ রাখা হয়েছে এবং সেগুলো জন্মাতে রিসাইকেল করা পানি ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে, ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে যেসব স্টেডিয়ামগুলোতে এবং অনুশীলনের মাঠগুলোতে ব্যবহারের জন্য 'ডিস্যালাইনেশন' (বিশুদ্ধকরণ বা নির্লবণীকরণ) নামক কৃত্রিম উৎস থেকে পানি আনা হচ্ছে।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেদোয়ান বেন-হামাদু বলেন, "আপনি যদি শুধুই প্রাকৃতিক পানির উৎসের ওপর নির্ভর করেন- যা আসলে এখানে সহজলভ্যই নেই; তাহলে দেখা যেত কাতারে মাত্র ১৪,০০০ মানুষ বসবাস করতে পারছে! আর তা দিয়ে একটা বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামের চারভাগের এক ভাগও ভরতো না।"
বলে রাখা ভালো যে, কাতারে কোনো নদী নেই এবং প্রতিবছর দেশটিতে ১০ সেন্টিমিটারেরও কম বৃষ্টিপাত হয়।
ক্রমবর্ধমান সমস্যা
মরুভূমির দেশ কাতারের শান-শওকত দেখে এবং বিশেষ করে এবারের বিশ্বকাপে তাদের আয়োজনের বাহার দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে শুধু পানির সমস্যাই এখানে কতটা প্রকট হয়ে উঠতে পারে। কাতারে এই মুহূর্তে ২.৯ মিলিয়ন মানুষের বসবাস; তাই প্রাকৃতিক পানির উৎস এবং জনসংখ্যার মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান তা লক্ষ্য করলে সহজেই বোঝা যায় যে বাড়তি পানির চাহিদা অন্য কোনো উৎস থেকে পূরণ করতে হয়।
ইউকে সেন্টার ফর এনভার্নমেন্ট, ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার সায়েন্সের মিডল ইস্ট প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ডা. উইল লি কুয়েন্স বলেন, "কাতারে পানির একটি বড় অংশ আসে নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং দেশের জনসাধারণের ব্যবহৃত পানির প্রায় শতভাগই এই প্রক্রিয়া থেকে আসে।"
নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য আগে সমুদ্র থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেই পানি থেকে সব লবণ এবং অপদ্রব্য দূর করে এটিকে পান করা ও কোনোকিছু ধোয়ার জন্য উপযুক্ত করে তোলা হয়।
নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কাতার বিপুল পরিমাণ পানির যোগান দেয়। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো বড় ইভেন্ট আয়োজন করতে গেলে খুব দ্রুত অনেক বেশি পরিমাণ পানি এভাবে বিশুদ্ধ করতে হবে। টুর্নামেন্ট চলাকালীন প্রায় এক মিলিয়ন পর্যটক কাতারে জড়ো হওয়ায় পানি গ্রহণের পরিমাণ ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে কাতারের পানি নির্লবণীকরণ বা বিশুদ্ধকরণ ক্ষমতা চারগুণ বেড়ে দৈনিক ৮০ বিলিয়ন লিটার হতে পারে।
যদিও কাতারে সামুদ্রিক পানির কোনো অভাব নেই এবং তাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদও প্রচুর; কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ পানি বিশুদ্ধকরণের জন্যও প্রচুর অর্থসংস্থান প্রয়োজন... আর পানি নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় পিছুটান হলো- এটি খুবই শক্তি-নিবিড় একটি প্রক্রিয়া।
ডা. লি কুয়েন্স বলেন, "সমগ্র উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত শক্তির ৯৯% শতাংশই আসে খুবই সস্তা হাইড্রোকার্বন জ্বালানির সরবরাহ থেকে।"
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, হাইড্রোকার্বন জ্বালানি, যেমন- তেল ও গ্যাস অতিমাত্রায় পরিবেশ দূষণকারী। কাতার এরই মধ্যে তাদের পরিবেশগত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তারা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ২৫% কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে। কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি জানিয়েছে, এবারের বিশ্বকাপ হবে কার্বন নিরপেক্ষ একটি আয়োজন- যদিও কার্বন মার্কেট ওয়াচের মতো পরিবেশবাদী গোষ্ঠীরা কাতারের এই দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে।
এছাড়াও, পানি উৎপাদন প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন কাজের ধারায় পরিবর্তন এনে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর উদ্দেশ্য কাতারের। ডা. লি কুয়েন্স বলেন, "এ বিষয়ে কিছু কাজ হাতে নিয়েছে কাতার। তারা পানি নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য সৌরশক্তি ব্যবহারের উপায় খুঁজছে। এটি হতে পারে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা সূর্যের তাপে সরাসরি পানি বাষ্পীভূত করার মাধ্যমে।"
সৌর শক্তি, সেইসাথে নতুন এবং আরও ভালো এনার্জি এফিশিয়েন্ট ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট আনার মাধ্যমে কাতার তাদের দেশের মানুষের পানির চাহিদা মেটানোর প্রত্যাশা করছে। সত্যি বলতে, বিশুদ্ধ পানির উৎসের অভাব কাতারে একটি জাতীয় নিরাপত্তা সমস্যা হিসাবেও দেখা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক নানা দ্বন্দ্বে প্রতিবেশী দেশগুলোর দেওয়া অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে খাদ্য সংকটে ভুগতে হয়েছে কাতারকে।
ফলস্বরূপ, কাতার এখন দেশে দুগ্ধ ও কৃষি খামারের সংখ্যা দ্রুত সম্প্রসারণ করছে। তবে এর ফলে তাদের সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ মজুদের ওপর আরও চাপ পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডা. বেন-হামাদু বলেন, "কাতারের পানির উৎসের এক-তৃতীয়াংশ কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয়, অথচ এটি দেশের জিডিপিতে ১ শতাংশেরও কম অবদান রাখে"।
কাতারে খাদ্য উৎপাদনের পেছনে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের একটি বড় অংশ ব্যয় করা হলেও, তাদের উৎপাদিত খাদ্য রপ্তানি করা হয় না; ফলে আর্থিকভাবে দেশটি লাভবান হতে পারে না; যদিও কাতার জানে যে জরুরি কোনো পরিস্থিতিতে দেশের জনগণকে খাওয়ানোর মতো সক্ষমতা তাদের আছে।
ডা. লি কুয়েন্স মনে করেন, পানি সম্পদ নিয়ে কাতার যে ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছে তা অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে একটু আলাদা। তার ভাষ্যে, "শুষ্ক দেশগুলোতে পানি প্রয়োজন, আবার ঠাণ্ডা জলবায়ুর দেশে নিজেকে গরম রাখাই মূখ্য। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ অঞ্চল ও দেশটি যে তাদের পানি সংকট মোকাবিলা করবে এবং অনেক শক্তি ব্যয় হয় এমন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনবে, সে ব্যাপারে আমি আশাবাদী। কারণ পানি ছাড়া কেউই বাঁচতে পারবে না।"
এদিকে গুজব শোনা যাচ্ছে, ২০৩৬ অলিম্পিক আয়োজনের জন্যেও নিলামে অংশ নেবে কাতার। তাই আরও একটি বিশাল ক্রীড়া ইভেন্ট আয়োজন করার আগে যে তাদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ পার করে যেতে হবে তা বলাই বাহুল্য।
সূত্র: বিবিসি