অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ, তা কি আমাদের দেশের পরিস্থিতির দায়মুক্তি হতে পারে!
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ১৪ তারিখ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সংগঠন 'মায়ের ডাক'-এর আহ্বায়ক সানজিদা ইসলামের শাহীনবাগের বাসায় তার পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সানজিদা ইসলাম ২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন। মায়ের ডাক সংগঠনটি বিভিন্ন সময় নানান প্রতিবাদ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায়, কী অবস্থায় আছেন এবং তাদের প্রকৃত পরিণতি কী, তা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে।
রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দুদিন আগে সানজিদা ইসলামের বাসায় উপস্থিত হয়ে সুমনের পরিবারসহ আরও কয়েকজন নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। পিটার হাসের এই সাক্ষাৎপর্বটি বাংলাদেশের মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো খবরটি প্রচার করেছে, পত্রিকাগুলোও খবরটি ছেপেছে। মিডিয়ার আরও মনোযোগের কারণ হলো পিটার হাস যখন সানজিদা ইসলামের বাড়িতে উপস্থিত হন, তার কিছু পরেই ঐ বাড়ির সামনে মায়ের কান্না নামক আরেকটি সংগঠনের বেশ কিছু মানুষ জড়ো হন এবং তারা একটি স্মারকলিপি দিতে চান রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে।
মায়ের কান্না সংগঠনটি ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার শাসন আমলে বিমান বাহিনীর অভ্যন্তরে সংঘটিত একটি ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়। সেই ঘটনাটি তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি, তবে সমাজে বহুল আলোচিত ছিল। জাপানি এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার দিন একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টায় লিপ্ত বহু বিমানবাহিনী কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করাসহ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। ৪৫ বছর আগের ঘটনা হলেও আমরা এই সংগঠনটির অস্তিত্ব জেনেছি সাম্প্রতিক সময়ে।
সাজেদুল ইসলাম সুমন নিখোঁজ হয়েছেন নয় বছর আগে। এই নয় বছরে মার্কিন অনেক রাষ্ট্রদূত এসেছেন, চলেও গিয়েছেন; কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রদূত কেন নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির বাসায় স্বশরীরে হাজির হলেন সেটিও এক বিরাট প্রশ্ন।
গুম কখনোই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। গুমের অভিযোগ বেশ কিছুকাল ধরেই চলছিল, দেশে সরকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। গত বছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশের র্যাব ও তাদের কয়েকজন কর্মকর্তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এই নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিএনপির ওপর দোষ চাপানো হয় যে, বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করে ভুল তথ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এ ধরনের একটি নিষেধাজ্ঞা আদায় করে নিয়েছে। বহু সরকারি দলের নেতাকে বলতে শোনা গেছে, তারাও লবিস্ট নিয়োগ করবেন এবং বিষয়টাকে মোকাবেলা করবেন। সেইভাবে লবিস্ট নিয়োগ হয়েছে, কিন্তু তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য এখনো আসেনি; বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের এই অতি উৎসাহী পদক্ষেপকে অনেকটা পূর্ববর্তী কিছু ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যেমন- গতবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমাদের সরকারি দলের যারা এখন মার্কিন ভোটার, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে রিপাবলিকান দলের হয়ে কাজ করতে দেখা গেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গুম হওয়া ব্যক্তির বাসায় উপস্থিত হওয়াটা অতি নাটকীয়তা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিষয়টি অবশ্যই আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক প্রশ্ন। এটি কোনভাবেই বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ক দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। তাহলে কেন এটি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এখতিয়ার বর্হিভূত কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে না? সে অভিযোগ বেশ জোরের সাথেই উঠেছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরে যদিও দেশে ক্রসফায়ার ও গুম ইত্যাদির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবেই কমে গিয়েছে।
গত কয়েক মাসের বিরোধী দলের জনসমাবেশ ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার বেড়েছে। গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সময়মত আদালতে হাজির না করার অভিযোগ উঠেছে। আমাদের আইনে আদালতের পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করার বিধান নেই। পরোয়ানা মোতাবেক গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হলে সেটি প্রচলিত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া, উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনাও রয়েছে- কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে প্রয়োজনে ঘেরাও করে রেখে দিবালোকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ, রাতের আধারে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
তবে এবারের বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশনা উপেক্ষিত হতে দেখেছি। আইন ও আদালতের এসব নির্দেশনা ব্যক্তির মানবাধিকারে প্রশ্নের সাথে জড়িত। এসবই মানবাধিকারের দৃশ্যমান লঙ্ঘন।
মার্কিন মুলুকের মানবাধিকার প্রসঙ্গ বা মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ মদতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। হাল আমলে ফিলিস্তিন, আফগান, সিরিয়াসহ নানান দেশে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। আমাদের দেশেও মুক্তিসংগ্রামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বিরোধী অবস্থানে ছিল। স্বাধীনতার পর পি এল ৪৮০ নামক মার্কিন খাদ্য সহায়তার খাদ্য প্রত্যাহার করার ঘটনা ও তার পরিণতির কথা আমাদের জানা আছে।
তবে এটিও ঠিক যে, অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রশ্নে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমরা একমতের ভিত্তিতে অগ্রসর হই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রকাশ্য পদক্ষেপগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। এখন দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির সাথে দেশে আইনের শাসন, আগামী নির্বাচন, নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও সকল দলের অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, আগামী নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য না হলে দেশ অনেক বেশি সংকটের মুখোমুখি হবে। তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানকেই সংকট সমাধানের নির্দেশনা বলে মনে করছেন।
চলমান ডলার সংকট, আগামী বছরের খাদ্য সংকট- সবকিছু মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক পথকে বেছে নেওয়া কোনো সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
২০২৩ সালের সম্ভাব্য মন্দা পরিস্থিতির শঙ্কা যা নিয়ে আমাদের সরকারপ্রধান প্রতিনিয়ত সতর্ক করছেন। আমরা বাধ্য হয়েছি আইএমএফ এর ঋণ গ্রহণ করতে। এমন সময় দেশের সামগ্রিক বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম উৎস পোশাক শিল্পের দিকে গভীরভাবে মনোযোগী থাকতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে নানান অজুহাত সৃষ্টি করে নানান ধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ তৈরি করেছে। ইরানের ওপর বারবার তাই করছে। আমাদের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ো ইউনিয়নের দেশগুলোই আমাদের পোশাক শিল্পের মূল ভিত্তি। সে কারণেই এই দেশগুলোর সঙ্গে সামগ্রিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে সরকার ক্ষুব্ধ হয়েছে সন্দেহ নেই। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ব্যত্যয় ঘটলেও খুব দক্ষতার সাথে বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে। সরকার দলীয় অনেক নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন। আমাদের মনে রাখা দরকার, অন্য কোনো দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হলে সেটি আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির দায়মুক্তি হতে পারে না।