মুরাদ টাকলার এক দশক, ভাষা বিকৃতি রোধে যার শুরু; এখনো কি প্রাসঙ্গিক?
'মুরোদ থাকলে যুক্তি দিয়ে কথা বল। ফালতু পিক দিছস কেন'- এ বাক্যটির সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা 'মুরাদ টাকলা'কেও বেশ ভালোভাবে চেনেন। নামবাচক শব্দ মুরাদ, আর টেকো শব্দের অপ্রভ্রংশ রূপ 'টাকলা'; এ দুই জুড়ে বাংলাদেশের অনলাইন জগতে বাংলা লেখার ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া একটি সত্তা মুরাদ টাকলা। ইন্টারনেটে বিশেষত ফেসবুকে যারা বাংলা লিপিতে বা লাতিন স্ক্রিপ্টে 'ভুল' বা 'বিকৃত' করে বাংলা লেখেন, তাদেরকে ইন্টারনেটেরই আরেকটি গোষ্ঠী 'মুরাদ টাকলা' হিসেবে সম্বোধন করেন। এই তথাকথিত মুরাদ টাকলারা শুরু থেকেই অনলাইনে বিচরণ করতেন, কিন্তু তাদেরকে উদ্দেশ্য করে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার কাজ করেছে মুরাদ টাকলা নামক একটি ফেসবুক পেজ।
এ পেজটি ও পরে একই নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অনলাইন পরিমণ্ডলে বিকৃত বাংলা লেখা ঠেকানোর বিরুদ্ধে 'যুদ্ধ' করে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে এ পেজের বয়স ১০ বছর পার হলো। ১৮ নভেম্বর মুরাদ টাকলার জন্মবার্ষিকী। দিনটিকে স্মরণ করার জন্য পেজটির পরিচালকেরা ঢাকার লালবাগের একটি ক্যাফেতে ছোট্ট এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন।
সেখানে কথা হয় মুরাদ টাকলা'র প্রতিষ্ঠাতা শান্ত কৈরীর সঙ্গে। উপস্থিত ছিলেন সেই শুরু থেকেই পেজটির সঙ্গে যু্ক্ত আরও কয়েকজন। কেক কাটা, স্মৃতিচারণ, খুনসুটি আর হাসি-আড্ডায় কেটে যায় মুরাদ টাকলার জন্মদিনের সন্ধ্যা। মানুষ এতদিন মুরাদ টাকলার শুরুর গল্পই বেশি জানতেন। শান্ত কৈরীর কাছে এবার জানা গেল মুরাদ টাকলার অনেক অজানা বিষয়। উত্তর পাওয়া গেল সামসময়িক কিছু সমালোচনারও।
১০ বছরের 'যুদ্ধ'
২০১২ সাল থেকে শুরু হয় মুরাদ টাকলা পেজের যাত্রা। মোবাইলে বাংলা লেখার সুযোগ তখন অনেক কম ছিল। আর মানুষের হাতে-হাতেও সে সময় স্মার্টফোন ছিল না। যারা ভুল বানানে বাংলা লিখতেন, তাদেরকে 'টাকলা' হিসেবে চিহ্নিত করতেন অন্য নেটিজেনরা। আর এ ব্যঙ্গোক্তিই আনুষ্ঠানিক রূপ পায় মুরাদ টাকলা পেজটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। ওই বছরের নভেম্বর মাসে একদিন হুট করেই 'মুরাদ টাকলা' নাম দিয়ে পেজ খুলে ফেলেন শান্ত কৈরী।
ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে এটি। পেজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন অনেকে। এক দশকে পেজের অ্যাডমিন প্যানেলে অনেকেই যুক্ত হয়েছিলেন, আবার ছেড়ে গিয়েছেন ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে। বর্তমানে মুরদা টাকলার পেজ ও গ্রুপ দুটোতেই চার-পাঁচজনের মতো অ্যাডমিন বা মডারেটর রয়েছেন।
তথাকথিত টাকলা ভাষায় লেখা কনটেন্ট শেয়ারই মুরাদ টাকলা পেজের মূল কার্যক্রম। ফেসবুকে একটি পোস্ট শেয়ার করার পরপরই হেসে লুটিয়ে পড়েন অনুসরণকারীরা। তারপর তাদের অনেকেই আবার ভুল বানানে ওই বানান ভুলকারীদের কটাক্ষ করেন। মাঝে কিছুদিন ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার পাশপাশি পডকাস্টও শুরু করেছিলেন মুরাদ টাকলার অ্যাডমিনেরা। অনিয়মিত এ আয়োজনে প্রায় রবিবার তারা আড্ডার ঢঙে যেকোনো সমকালীন সামাজিক বিষয় নিয়ে কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে উঠতেন।
কিন্তু এতকিছু করে আদৌ কোনো 'লাভ' আছে? হাস্যরসের বাইরে আর কী পাওয়া যাবে এটি দিয়ে? 'আমার চাই এ দুর্বোধ্য শব্দগুলো মানুষ বুঝতে পারুক। আমরা অন্যদের জন্য বিষয়টি সহজ করার চেষ্টা করছি। তাদেরকে যেন সামাজিকমাধ্যমে যোগাযোগ নিয়ে অকূল পাথারে পড়তে না হয়,' বলেন শান্ত কৈরী। কিন্তু এর মাধ্যমে ভুলভাবে লেখার ব্যাপারটিকে আরও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে কৈরী বলেন, 'ভুলগুলোকে যদি স্বীকৃতি দেওয়া হতো তাহলে ১০ বছর ধরে আর পেজ পরিচালনা করতে পারতাম না।'
২০১৫ সালে ভিন্নধর্মী এক ধারণার ওপর কাজ করতে চেয়েছিলেন মুরাদ টাকলার অ্যাডমিনেরা। তাদের লক্ষ্য ছিল নিদেনপক্ষে উপজেলা পর্যায়ের মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে গিয়ে ওপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে বাংলা লেখা ও অনলাইনের আদবকায়দা শেখানো। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যস্ততার দরুন কারও পক্ষে আর এটি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। 'এটি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছেটা এখনো মরে যায়নি। সামনে কখনো সুযোগ হলে মাঠে নেমে পড়ার ইচ্ছে আছে। আমাদের মূল লক্ষ্য থাকবে যে স্কুলগুলোতে প্রযুক্তির ছোঁয়া খুব একটা প্রবেশ করে না, সেগুলো নিয়ে কাজ করার। আর এ কাজে আমরা তরুণদের সামিল করতে চাই,' বলেন শান্ত।
১০ বছরের দীর্ঘযাত্রায় মুরাদ টাকলা নিজস্ব কিছু পরিচিতি তৈরি করে ফেলেছে। পেজটির কাল্ট ফিগার জয়ন্ত কুমারকে এখন অনেকে চেনেন। ১০ বছরে অনেকবার তার গল্প শুনেছেন মানুষ। তথাকথিত টাকলা ভাষার একটি অভিধানও রচিত হয়ে গেছে। ফেসবুকভিত্তিক কমেডি পেজ 'ইয়ার্কি' মুরাদ টাকলার সহযোগিতায় ২০২০ সালে রোমান হরফে লেখা দুর্বোধ্য সব শব্দের বাংলা অর্থসমৃদ্ধ এ মুরাদ টাকলা অভিধান প্রকাশ করে। তবে ভবিষ্যতে অর্থের সংস্থান হলে মুরাদ টাকলা স্বাধীনভাবে আরও বড় অভিধান নিজেই বের করার পরিকল্পনা করছে। পেজের জন্য প্রতীকী একটি মাসকটও তৈরি করেছে তারা। খোসা ছড়ানো নারিকেলের এ মাসকটটি মুরাদ টাকলার পেজে গেলেই দেখা যাবে।
মানুষ কেন বিকৃত বাংলায় লেখে?
বিকৃত বাংলার আওতায় পড়তে পারে বাংলা বানান ভুল করা (যেমন 'চাই' বা 'ছাত্র'-এর স্থলে যথাক্রমে 'চায়' ও 'ছাএ'), রোমান হরফে বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে তাল বজায় না রেখে লেখা (যেমন 'কেমন'-এর বদলে 'Kaman'), বাংলা লিপিতে বানান বিকৃতি ও বিরামচিহ্ন ভুল করে লেখা (যেমন 'চোটো বাই মাতা থানডা করো, তানাই কেচ করো'), রোমান হরফে সংক্ষেপে বাংলা লেখা (যেমন 'আমার'-কে 'amr') ইত্যাদি। কিন্তু ২০২২ সালে এসে অনলাইনে বাংলা লেখা অনেক সহজ হয়ে গেলেও এখনো মানুষ কেন ভার্চুয়াল জগতে বাংলাভাষাকে বিকৃতভাবে লিখছেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজা ইয়াসমীন এর পেছনে দুটো কারণের কথা উল্লেখ করেন। 'ইন্টারনেটে বর্তমানে বাংলা লেখার সুবিধা বাড়লেও অনেকে তা এখনো ব্যবহার করেন না। বাংলা লিখতে গেলে তারা ফন্ট ভেঙে যাওয়া, যুক্তবর্ণ লিখতে না পারা ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হন। সেজন্য বাংলা লেখা তাদের কাছে সহজ বলে মনে হয় না। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, তারা নিজেদের মতো করে লিখতেই পছন্দ করেন। এখানে কেউ তাদের ভুল ধরছে না। যিনি লিখছেন তার কাছেও খারাপ লাগছে না, যার কাছে লিখছেন তারাও এ ধরনের লেখা স্বচ্ছন্দে পড়তে পারছেন। এ কারণেই বানান ভুল বা বিকৃত হওয়ার চিন্তাটাই মানুষের মনস্তত্ত্বে কাজ করছে না,' ব্যাখ্যা করেন তিনি।
মুরাদ টাকলার জন্মদিনে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুজহাত জাবীন। "ভাষাবিজ্ঞানে বলা হয়, ভাষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করা। গ্রামের কোনো ছেলে আর মেয়ে যখন তথাকথিত 'টাকলা ভাষা'য় একে অপরের সঙ্গে অনলাইনে আলাপ করছে, তারা কিন্তু নিজেদের মনের ভাব বুঝতে পারছে। তাদের মধ্যে যোগাযোগটা ঠিকই হচ্ছে। কারণ যোগাযোগ না হলে, এ ধরনের লিখন পদ্ধতি আপনার অব্দি পৌঁছাতোই না," বলেন নুজহাত।
বাংলাদেশের ফেসবুক মিমকে জনপ্রিয় করা অন্যতম গ্রুপ র্যান্টাজেস-এর প্রতিষ্ঠাতা রুম্মান কালাম বলেন, 'ইন্টারনেটের আগে আমরা এসএমএস ব্যবহার করে মেসেজ পাঠানোয় (টেক্সটিং) অভ্যস্ত ছিলাম। তখন কিন্তু আমরা সবাই মুরাদ টাকলার মতো করেই লিখতাম। টেক্সটিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের নির্দিষ্ট শব্দসীমা বাঁধা ছিল বলে টেক্সট ছোট করার একটা প্রবণতা ছিল। ইন্টারনেটে আসার পরেও লেখার ক্ষেত্রে অনেকের আগের এ টেক্সটিং শৈলীটা রয়ে গেছে।'
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন আসামের নভোস্মিতা দাশ। তিনি বলেন, 'ব্যাপারটা ধ্বনিবিজ্ঞানের (ফোনেটিক্স) সঙ্গে কিছুটা সম্পর্কিত। বেশিরভাগই খেয়াল করেন না, বাংলা লেখার সময় ইংরেজি শব্দের বর্ণগুলোর উচ্চারণ কী হচ্ছে। এটাই প্রধান সমস্যা বলে আমার মনে হয়।' একই অনুধাবন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী সিফাত সারোয়ারেরও। তার মতে, তার সহপাঠী বন্ধুটি যখন বিকৃতভাবে লিখছেন, তখন তার কাছে উপযুক্ত অক্ষর ব্যবহারের চেয়ে মনের ভাব প্রকাশ করাটাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
শান্ত কৈরী বলেন, "উচ্চবিত্ত বা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মানুষদের মধ্যে বাংলা নিয়ে একপ্রকার 'হীনমন্যতা' কাজ করে। অনেকে আবার বাংলার বদলে ইংরেজি হরফে লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর না শেখার একটা প্রবণতাও আছে। বাংলা কিবোর্ডের ব্যবহার শেখার কষ্ট করতে চান না অনেকে।" নভোস্মিতাও মনে করেন, ইন্টারনেটে বাংলা লেখাটা বেশ সময়সাধ্য। যারা প্রমিত বাংলাতে কথা বলেন, তারা রোমান হরফে বাংলা লেখার সময় সচরাচর ভুল কম করেন। আর বাংলা লেখার জন্য ভারতে সহজে ব্যবহারযোগ্য খুব বেশি অ্যাপ্লিকেশন নেই।
শিক্ষিত মানুষেরাও বাংলা লিখতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে ইংরেজিতে ফিরে আসেন। কিন্তু তারা কেন তাদের সেই ভাষাকেও 'স্পষ্টভাবে' ফুটিয়ে তুলতে পারেন না? যেমন, তারা 'কেমন' বোঝাতে 'kemon'-এর বদলে 'kaman' লেখেন কেন? ড. ইয়াসমীন ব্যাখ্যা করেন 'রোমান হরফে বাংলা কীভাবে লেখা হবে, তার তো কোনো প্রমিত নিয়মকানুন নেই। তাই যিনি যেভাবে লিখছেন, তার কাছে মনে হচ্ছে সেটাই সঠিক। তবে এ ধরনের কোনো নিয়ম তৈরির চিন্তা করাও ঠিক নয়। পাকিস্তান আমলে রোমান হরফে বাংলা লেখার অপচেষ্টা হয়েছিল। এটা কখনোই ভাষার জন্য ভালো কথা নয়। কারণ আমার নিজস্ব লিপি আছে, আমি কেন রোমান হরফে বাংলা লিখব।'
ইন্টারনেটে বাংলা কিবোর্ডে লেখা রপ্ত করতে কিছুটা সময় দিতে হয়। অনেক মানুষই এখনো 'ত্র'-এর স্থলে 'এ' দিয়ে চালিয়ে যান স্রেফ কিবোর্ডে যুক্তবর্ণ লিখতে পারেন না বলে। শেখার পেছনে এ সময় আর প্রচেষ্টাটুকু কি তারা দিতে চান না তাহলে? রুম্মান কালামের মতে, (শিখতে) না চাওয়াটা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, 'আমরা ভাষার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি। তাই নিজের মতো করে লেখাটাও ব্যক্তির স্বাধীনতা।' এটাকে তিনি ঠ্যাকায় পড়ে শেখা হিসেবে দেখছেন। 'আমরা আমাদের কাজের প্রয়োজনে ইংরেজি শিখেছি, জটিল সব সফটওয়্যার শিখছি। এখন যারা বিকৃত বাংলা লিখছেন, তাদের তো প্রমিত বাংলা লেখার প্রয়োজন হচ্ছে না। যতক্ষণ না কেউ তাদের সামনে এ প্রয়োজনটা হাজির করতে পারছে, ততক্ষণ তারা শিখবেন কেন?'
তবে মুরাদ টাকলা যে কেবল বাংলায় ভুলের জন্য, তা নয়। ভুল ইংরেজিতে লিখলেও তা অনেকসময় মুরাদ টাকলার রাডারে ধরা পড়ে। ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা নয়, তাহলে ভুল লেখার দায়মোচন কি এমনিই হয়ে যায় না? কৈরী বলেন, 'আমরা স্রেফ ট্রলের জন্য ট্রল করিনা। আমরা সেসব পোস্টের ট্রল করি, যেগুলোর আধেয় ট্রলের উপযুক্ত—যেগুলোতে কোনো ব্যক্তি বা বিশ্বাসকে আক্রমণ করে কথা বলা হয়; যেমন নারীবিদ্বেষী পোস্ট, ধর্মবিদ্বেষী পোস্ট। এ ধরনের পোস্ট যে সবসময় মুরাদ টাকলা ভাষাতেই হতে হয়, তাও নয়।'
'খণ্ডসময়ের দলিল'
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক, গবেষক, ও তোপসের নোটবুক বইয়ের লেখক কৌশিক মজুমদার মুরাদ টাকলার একজন পাঁড়ভক্ত। তিনি নিয়মতি পেজটি অনুসরণ করেন। প্রায়ই মুরাদ টাকলার বিভিন্ন স্ক্রিনশট নিজের প্রোফাইলে পোস্ট করেন তিনি। তার সঙ্গে কথা হলো মুরাদ টাকলা নিয়ে।
মুরাদ টাকলাকে প্রবাহমান বাংলা ভাষার একধরনের দলিলের মতো করে দেখছেন কৌশিক মজুমদার। 'আমার যারা ৮০'র দশকে জন্মেছি, তারা এখন একটি অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা ডায়াল করা ফোন ব্যবহার করে এসে এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করছি। এসবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া আমাদের অনেকের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।'
কৌশিক মজুমদার টাকলা অভিধানও সংগ্রহ করেছেন। তিনি এটিকে বলছেন 'খণ্ডসময়ের দলিল'। তার মতে, আজ থেকে ২০ বছর বাদে কেউ আর মুরাদ টাকলা ভাষায় লিখবেন না। কারণ যেসব 'ডিজিটাল মাইগ্রেন্ট'রা নিজেদের অজান্তেই এ ভাষায় লিখছেন, তারা আর থাকবেন না। তখন যদি কেউ মুরাদ টাকলা ভাষায় লেখে, সেটা হবে স্রেফ ইয়ার্কির ছলে লেখা। 'বাংলাদেশ ও ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে উত্থান ঘটেছে বিগত দশকের শুরুতে, তার কারণে বাংলা ভাষাটাও এক প্রকার ভাঙাচোরার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। আর এ পরিবর্তনের ক্রান্তিকালের দলিল হিসেবেই রয়ে যাবে মুরাদ টাকলা,' বলেন এ সাহিত্যিক।
কৌশিক মজুমদার যেসব মুরাদ টাকলার স্ক্রিনশট শেয়ার করেন, সেগুলোর বেশিরভাগই বাংলাদেশের। তবে কি পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা বিকৃত বানানে বাংলা লেখেন না? মজুমদার বলেন, 'এখানেও মিশ্র ভাষায় বাংলাটাকে লেখা হচ্ছে। আমার পরিচিত অনেকে শিক্ষিত মানুষই আছেন যারা রোমান হরফে বাংলা লিখতে গিয়ে বিকৃতভাবে লেখেন। এ ধরনের ভুল করার ক্ষেত্রে শিক্ষাদীক্ষার চেয়ে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবই বেশি প্রভাব রাখে।'
মজুমদার জানান, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখন মোবাইলে বাংলা লিখতে রিদমিক বা অন্য বাংলা কিবোর্ড ব্যবহার করেন। আর কম্পিউটারের ক্ষেত্রে মোটামুটি ৯৫ শতাংশ মানুষ অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করছেন। তবে ওপারে বাংলাকে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় না বলেও আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন এ সাহিত্যিক।
সমালোচনা ও জবাব
রুম্মান কালাম জানান, বাংলাদেশে ২০১০-এর পরে ফেসবুকের ব্যবহার বাড়তে থাকে। ওই সময়ের ফেসবুক হাস্যরসের উৎস ছিল লিখিত কৌতুক, ছবির শীর্ষে ও নিচে লেখা বসিয়ে তৈরি করা মিম (ইমেজ ম্যাক্রো) ইত্যাদি। ওই দশকের প্রথমদিকে মুরাদ টাকলার কনটেন্টকে গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন আপামর ফেসবুক ব্যবহারকারী। কিন্তু এখন একটি পক্ষ মনে করছেন, মুরাদ টাকলা আদতে হাস্যকর কিছু নয়। বরং এখানে মানুষের অনভিপ্রেত অজ্ঞতা নিয়ে কৌতুক করা হয়। নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে সম্প্রতি এ ধরনের একটি 'অজনপ্রিয় মতামত'ই ব্যক্ত করেছেন কালাম।
এ বিষয়টি শান্ত কৈরী কীভাবে দেখছেন? 'এখানে একাধিক ব্যাপার আছে। মানুষের আচরণ, অনলাইনের কার্যকলাপকে আমার আটকাতে পারব না। এক দশকে প্রজন্মের পরিবর্তন হয়ে গেছে। মুরাদ টাকলার শুরুর দিকের যে কিশোর বা তরুণ প্রজন্ম ছিল, তারা এখন আর নেই—বড় হয়ে গেছে। আর যারা মুরাদ টাকলাকে এখন সমালোচনার চোখে দেখছেন, এরা বেশিরভাগই মোটামুটি উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন। ফলে শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তিতে এদের সুযোগ ছিল বেশি।'
যারা জন্মের পর থেকেই ইন্টারনেট, ডিজিটাল ডিভাইস, তথ্য-প্রযুক্তি ইত্যাদির সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, তাদেরকে 'ডিজিটাল নেটিভ' হিসেবে অভিহিত করা হয়। শান্তর মতে, 'এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বের হওয়া বা আড্ডার চেয়ে ফোন, কম্পিউটারের সঙ্গে বেশি সময় কাটিয়েই বেড়ে উঠেছে। এরা আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে বড় হয়েছে। আর এ ডিজিটাল নেটিভেরাই বর্তমানে মুরাদ টাকলা ধরনের রসবোধের সবচেয়ে বড় সমালোচক।'
রুম্মান কালামের দাবি, মুরাদ টাকলার মতো পেজগুলো যেকোনো নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর জন্য একটি 'বৈরীভাবাপন্ন' পরিবেশ তৈরি করে ফেলে। "বেশিরভাগক্ষেত্রে যেসব স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়, সেগুলো কিশোরবয়স্কদের; কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের। এতে তাদের ভুলের চেয়ে তার 'মাশুল' বেশি হয়ে যায়। স্রেফ বানান না পারার কারণে কেউ তো এত মানুষের কাছ থেকে হাসির পাত্র হতে পারেনা। এসবের প্রভাবটা কিন্তু ওই প্রকাশক ভোগেন না।"
শান্ত কৈরী জানান, মুরাদ টাকলার পোস্টগুলোতে ব্যক্তির পরিচয় মুছে দেওয়া হয়। এর ফলে কোনো অশিক্ষিত ব্যক্তি আর উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য করা যায় না। অনেক শিক্ষিত মানুষও কিন্তু রোমান হরফে ভুলভাবে লেখেন। 'আমরা যদি দেখি কোনো শিক্ষিত মানুষও বিকৃতভাবে ইন্টারনেটে বাংলা লিখছেন, তাহলে সচরাচর সেটাকে আমরা এড়িয়ে যাইনা। তবে যা-ই আমাদের পেজ বা গ্রুপের মাধ্যমে প্রকাশিত হোক না কেন—কোথাও কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয় না, বুলিংকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না।'
ফেসবুকে বর্তমানে মূলধারার মিমগুলোর বেশিরভাগের জন্ম বিদেশে। বিশেষত রেডিট বা টুইটারে তৈরি হওয়া কোনো মিম বা মিম ট্রেন্ড পরে ফেসবুকে জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশি মিম ক্রিয়েটরেরা ওগুলোর ছাঁচে এখানকার প্রসঙ্গে নতুন মিম তৈরি করেন। অন্যদিকে মুরাদ টাকলার কনটেন্টগুলো স্থানীয়ভাবেই জাত। এগুলোর উৎপত্তি বাংলাভাষী মানুষদের কাছ থেকেই। তাহলে মুরাদ টাকলা কি হিউমারের দিক থেকে মূলধারার মিমভিত্তিক হিউমারের চেয়ে বেশি মৌলিক কিনা তা জানতে চাই রুম্মানের কাছে। তিনি অবশ্য ব্যাপারটাকে এভাবে দেখছেন না, 'একটা বিদেশি মিমকে সম্পাদনা করে সেখান থেকে নতুন একটা তৈরি করতে যেটুকু সময় দিতে হয়, তার সঙ্গে একটা স্ক্রিনশট তুলে পোস্ট দেওয়ার মধ্যে বিস্তর তফাত রয়েছে। আর হিউমারের বৈশিষ্ট্য হলো একজনের কৌতুক আরেকজন নিয়ে একটু পরিবর্তন করে নতুন অডিয়েন্সের সামনে উপস্থাপন করবে।'
ইংরেজ জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে তার দ্য সেলফিশ জিন বইয়ে সর্বপ্রথম মিম শব্দটি ব্যবহার করেন। তার মতে, ইন্টারনেটের কোনো কনটেন্ট মিম হতে হলে এটির নকল করার সম্ভাব্যতা তথা এটি থেকে অনুরুপ সমধর্মী মিম তৈরি হওয়ার ক্ষমতা (কপি ফিডেলিটি) থাকতে হবে এবং একইসঙ্গে এটিকে দ্রুতহারে ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে (ফিকান্ডিটি) পড়তে হবে।
মুরাদ টাকলাকে নিয়ে হালসময়ের সমালোচনাকে কৌশিক মজুমদার কীভাবে দেখছেন? 'বাংলাদেশে বাংলা ভাষাট যতটা গুরুত্ব পায়, পশ্চিমবঙ্গে বাংলার ক্ষেত্রে ততটা হয় না। আর আপনি যে ধরনের সমালোচনার কথা বলছেন, আমি বলব সেখানে মানুষ বাংলাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে বলেই এমন সমালোচনার উদ্ভব ঘটছে। তা নাহলে মুরাদ টাকলা স্রেফ হাস্যরসের পরিধির বাইরে কখনো বের হতে পারত না,' বলেন তিনি।
মুরাদ টাকলা ও ইন্টারনেটে বাংলার ভবিষ্যৎ
নুজহাত প্রশ্ন রাখেন, মুরাদ টাকলা ভাষাকে আপনি হয়তো নিম্নস্তরের ভাষা হিসেবে দেখতে পারেন, কিন্তু সেটার মানদণ্ড নির্ধারণ করবে কে? ১৯৭১-এর আগে বাংলাও কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে নিচুস্তরের ভাষা ছিল। মুরাদ টাকলা কি এখনো হাস্যকর? নুজহাত অকপটে স্বীকার করলেন, 'একজন ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে কারও ভাষাগত অদক্ষতাকে আমি এখন আর হাস্যরসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিনা।'
১০ বছরে আপনাদের এ প্রচেষ্টায় কী পরিবর্তন দেখলেন বলে আপনার কাছে মনে হয়? শান্ত কৈরী বলেন, 'পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো রোমান হরফে ভাষা লেখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বাংলায় লেখার প্রবণতা দেখা যায়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও এত বেশি মানুষ বাংলা অক্ষরে বাংলা লেখেন না। এটি কিন্তু ২০১২ সালে ছিল না। গত ১০ বছরে এখানে বড় একটি পরিবর্তন এসেছে। যতবেশি বাংলা লেখার পরিমাণ বেড়েছে, আমাদের পেজের কনটেন্টও তত কমে গেছে।'
মুরাদ টাকলার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? শান্ত জানান, এ পেজটাকে চালিয়ে নিতে থাকবেন আপাতত। 'যদি কখনো তহবিলের যোগান হয় বা তরুণেরা আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে আমরা সারা দেশেই সংগঠন তৈরির উদ্যোগ নেব। সেগুলোর সদস্যরাই চেষ্টা করবেন নিয়মিত স্কুলগুলোতে গিয়ে বাংলা শিক্ষা নিয়ে কাজ করার।' শান্ত নিজেই এখন উচ্চশিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। সত্যিই কোনো একদিন মুরাদ টাকলাকে কেউ তার মতো ভালোবেসে এটিকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যেতে এগিয়ে আসবেন কিনা তা নিয়ে তিনিও কি একটু সন্দিহান নন?
মুরাদ টাকলার এক দশক বয়স হয়ে গিয়েছে, এতগুলো মানুষ এখনো এটিকে অনুসরণ করছেন; সেক্ষেত্রে এটির কি কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা আছে কিনা—জানতে চাই কৌশিক মজুমদারের কাছে। তিনি বলেন, 'সামাজিক দায়বদ্ধতার কিছু জায়গা মুরাদ টাকলার রয়েছে। বাংলা ফোনেটিক পদ্ধতিতে লেখার নিয়ম সুনীতিকুমার বা সুকুমার সেনও লিখে গিয়েছেন। কিন্তু এ যুগের ছেলেমেয়েরা তো তাদেরকে পড়ে ফোনেটিক বাংলা লেখা শিখবে না। তাই তাদেরকে আনন্দের সঙ্গে, নিজস্ব পদ্ধতিতে শেখানোর ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে মুরাদ টাকলা।'
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোনেটিক্সে ডিপ্লোমা ও ১৯২১ সালে ডিলিট ডিগ্রি লাভ করেন। বেঙ্গলি ফোনেটিক্স (১৯২১), এ বেঙ্গলি ফোনেটিক রিডার (১৯২৮), এ রোমান আলফাবেট ফর ইন্ডিয়া (১৯৩৫) ইত্যাদির প্রণেতা এ ভাষাবিদ। সুনীতিকুমারের ছাত্র সুকুমার সেন লিখেছেন অ্যান ইটিমোলজিক্যাল ডিকশনারি অব বেঙ্গলি, সি. ১০০০-১৮০০ এ.ডি. (১৯৭১)।
এভাবে বিকৃতভাবে অনলাইনে বাংলা লেখা চালিয়ে গেলে তা-তে কী আর এমন হবে? ড. ইয়াসমীন বলেন, 'বাংলাদেশের অধিকাংশ আদিবাসী ভাষাগুলোর ইন্টারনেটে ব্যবহারের জন্য নিজস্ব লিপি নেই। তাই তারা বাংলা বা রোমান হরফে বাধ্য হয়ে নিজেদের ভাষাটা লিখছেন। কিন্তু বাংলার লিপি থাকা সত্ত্বেও যদি এভাবে বিকৃতভাবে লেখা হয়, তাহলে লিখিত বাংলা ভাষার জটিলতা আরও বাড়বে।'
প্রসঙ্গত, বর্তমানে কেবল চাকমা ভাষা মোবাইলে ও কম্পিউটারে নিজস্ব লিপিতে লেখা যায়। তবে তা বাংলা লেখার মতো সহজ নয়, প্রয়োজন হয় কিবোর্ডের সঙ্গে প্লাগ-ইন সংযোগ দেওয়ার।
ফিরোজা ইয়াসমীনের পরামর্শ, 'কম্পিউটারে বাংলা লেখাকে সহজলভ্য করার নিরন্তর চেষ্টা করতে হবে। বাংলাকে আরও সহজলভ্য করে এ সমস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যেমনটা হয়েছে চীনা, জাপানি ভাষার ক্ষেত্রে। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে এখনো অতখানি উন্নয়ন ঘটেনি।'
ইন্টারনেটে প্রযুক্তিগতভাবে বাংলার আরও উৎকর্ষ সাধন করে ভাষাটিকে ব্যবহারকারীর জন্য আরও উপলব্ধ করা এবং মাতৃভাষার প্রতি মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও সচেতনতার মনোভাব তৈরি করা; এ দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলেই বাংলা ভাষার বিকৃতির পরিমাণ কমানো যাবে বলে মনে করেন ড. ইয়াসমীন।