জীবনানন্দ দাশ ও বড়দিন
জীবনানন্দ দাশের যিশুখ্রিষ্ট তথা বাইবেলের প্রতি কতখানি অনুরাগ ছিল তা এই ঘটনা শুনলেই বোঝা যাবে।
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও ভাস্কর মিত্র একদিন জীবনানন্দ দাশের বাড়ি গেছেন। জীবনানন্দের কোলের কাছে বাইবেলের একটা খোলা পাতা। তিনি বললেন, 'জানো আজ ইস্টারের রবিবার? আমি আজ সেন্ট জনের প্রথম চিঠির এই লাইনটা বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, 'যত দিন আমরা পরস্পরকে ভালোবাসব, ঈশ্বর আমাদের মধ্যেই থাকবেন এবং তাঁর ভালোবাসা আমাদের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে থাকবে'।
তারপর দুই বন্ধুর বিমূঢ় চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন, 'না না তোমরা যা ভাবছ তা কিন্তু একেবারেই না, আমি ঈশ্বর-টিশ্বরের কথা ভাবছি না। ভাবছি লাইনটা কবিতা হতে গিয়েও কেন কবিতা হয়ে উঠতে পারল না। বড় স্পষ্ট এই সদুপদেশ। ঈশ্বরের ভালোবাসা এত সহজেই আমাদের মধ্যে পূর্ণ আকার পেয়ে গেছে,তা কেমন করে হয়?'
শেষে অলোকরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি তো সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ছো,আমি তো গ্রীক জানি না,ওখানকার কোনো ফাদারকে জিজ্ঞেস করো তো, এই জায়গাটা মূল গ্রীক ভাষায় কীরকম আছে'।
অলোকরঞ্জন মূল গ্রীক শব্দ 'টেলোস'-এর মানে জেনেছিলেন। ভুল ছিল অনুবাদে। সংশোধন করে মানেটা দাঁড়ায়, 'ঈশ্বরের ভালোবাসা আমাদের মধ্যে ক্রমশুদ্ধ হয়ে চলেছে।'
এই হলেন জীবনানন্দ দাশ। বাইবেলকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে কেউ এমনভাবে ভাবতে পারেন না।
বড়দিন নিয়ে, বিশেষত কলকাতার বড়দিন নিয়ে জীবনানন্দ দাশের একধরনের মুগ্ধতা ছিল। জীবনের অনেকগুলো বড়দিনে তিনি নিশ্চয় কলকাতাতেই ছিলেন। কিন্তু ১৯২৯-এর বড়দিনে জীবনানন্দ দাশ দিল্লির রামযশ কলেজে কর্মরত। ডায়েরিতে আমরা তাই দেখি, জীবনানন্দ আক্ষেপ করে লিখছেন, বড়দিনটা কলকাতার বাইরে কাটছে, যদি ফিরে যাওয়া যেত।
ডায়েরিতে বারবার খ্রিস্টিয় অনুষঙ্গ ফিরে এসেছে। ১৯২৯-এর ডায়েরির একটি এন্ট্রি 'পেল হর্স' বা ফ্যাকাশে ঘোড়া নিয়ে। আমরা জানি বাইবেলের 'বুক অব রিভিলেশন'-এর যষ্ঠ পরিচ্ছেদে অ্যাপোক্যালিপসের চার ঘোড়সওয়ারের উল্লেখ আছে। সাদা,লাল,কালো ও ফ্যাকাশে। এই চারটি ঘোড়া প্রতীকী অর্থে যুদ্ধ, রক্ত,বন্ধ্যা ভূমি ও মৃতের চামড়াকে বোঝায়। অর্থাৎ অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের যুদ্ধ, ফলাফল ধ্বংস, দুর্ভিক্ষ এবং শেষে মৃত্যু।
১৯২৯-এ এমন একটা সময় জীবনানন্দ দাশ এই ডায়েরি লিখছেন, যখন দশ বছর হয়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুূ্দ্ধ শেষ হয়েছে। ১৯২০ থেকে ১৯২৯ বাংলার পক্ষে খুব একটা সুখের সময় নয়। দুর্ভিক্ষ তখন ধারাবাহিক এবং প্রতিদিনের ঘটনা। এভাবে বাইবেল ও অভিজ্ঞতা মিশে গিয়ে জীবনানন্দের লেখায় স্থান করে নিয়েছে।
লাল ইটের তৈরি বলে স্থানীয় মানুষের কাছে এটি 'লাল গির্জা'। বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন গির্জা। মূল ফটকের সামনে বড় করে লেখা 'এপিফ্যানি গির্জা, বাংলাদেশ'। গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর এক অপরূপ নিদর্শন। বরিশাল শহরের বগুড়া রোডের (জীবনানন্দ দাশ সড়ক) পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গির্জাটি। ১১৯ বছরের প্রাচীন এই স্থাপনা বরিশাল ঐতিহ্যের স্মারক। লাল গির্জা কেবল ধর্ম প্রচার ও প্রার্থনার কেন্দ্রই নয়, শিক্ষা বিস্তারে ও মানবসেবায় এই গির্জার অবদান অনস্বীকার্য।
জীবনানন্দ দাশের বরিশালের বসতবাড়ি 'সর্বানন্দ ভবন' ছিল এই গির্জার লাগোয়া একটা অঞ্চলে। কথিত আছে জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রথম প্রেমিকা মনিয়ার দেখা পেয়েছিলেন এই অক্সফোর্ড মিশন গির্জাতেই। মনিয়ার মা ছিলেন এই গির্জারই একজন সেবিকা। জীবনানন্দের অনেক কবিতা এই মনিয়াকে নিয়ে লেখা। 'মনিয়ার ঘরে রাত শীত আর শিশিরের জল।' তাছাড়া বিভিন্ন গল্প উপন্যাস ও কবিতাতেও এই লাল গির্জা স্থান করে নিয়েছে। 'লাল কাঁকরের পথ—রক্তিম গির্জার মুণ্ড দেখা যায় সবুজের ফাঁকে'! এটা ভাবাই যায়, যে বড়দিনগুলোতে জীবনানন্দ বরিশালে থেকেছেন, নিশ্চয় গির্জায় গিয়েছেন।
বাইবেল অনুবাদের ভুল শুধরে 'ক্রমশুদ্ধ'-র কথা বলেছিলেন, হয়তো তাই একদিন কবিতায় লিখবেন 'ক্রমমুক্তি'-র কথা:
'...সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে – এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;–
প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।...'
- লেখক: জীবনানন্দ গবেষক