দেশে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক সড়ক নির্মাণ কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে
গাজীপুরে প্রথমবারের মতো প্লাস্টিক বর্জ্য মিশ্রিত বিটুমিন দিয়ে সড়ক নির্মাণের পর, এবার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) পরীক্ষামূলক এই কার্যক্রম আরও প্রশস্ত করার দিকে নজর দিয়েছে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে কম খরচে দীর্ঘস্থায়ী সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি নন-বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক বর্জ্যের উন্নত ব্যবস্থাপনার নতুন পথ উন্মোচিত হলো।
এলজিইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাজীপুরের পর এবার কুমিল্লার মনোহরপুর ও লাকসাম উপজেলায় প্লাস্টিক মিশ্রিত বিটুমিন দিয়ে রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।
অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতেই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করে ১ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের লক্ষ্য নিয়েছে এলজিইডি।
এদিকে, বিদেশ থেকে পলিমার বিটুমিন আমদানি করে পরীক্ষা মূলকভাবে তা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ব্যবহারে করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। বর্জ্য প্লাস্টিক ব্যবহার করে টেকসই সড়ক নির্মাণে জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে যৌথ গবেষণা শুরু করছে তারা। আগামী বছর দেশের যেকোনো একটি জাতীয় মহাসড়কাংশে তারা পাইলটিংয়ে যাবে বলে সওজ সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশে বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়ক টেকসই হয় না। বিটুমিন হলো প্রাকৃতিকভাবে অশোধিত তেলের উপজাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিরিক্ত যানবাহানের চাপে সড়কে ফাটল ধরতে দেখা যাচ্ছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও অত্যাধিক হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিটুমিনের সড়ক আগের মতো টেকসই থাকছে না।
প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ সড়কের স্বায়িত্ব বৃদ্ধি ও টেকসই করার পাশাপাশি নির্মাণ খরচও কমাবে। আবার এই ধরনের উদ্যোগ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও সহায়তা করবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
গাজীপুরে ১০০ মিটারের প্রথম প্লাস্টিকের রাস্তার কথা উল্লেখ করে এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, তারা ৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য এবং ৯১ শতাংশ বিটুমিনের মিশ্রণ ব্যবহার করেছেন। কার্পেটিং করার আগে মিশ্রণটি ১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত করা হয়েছিল।
অন্য কথায়, রাস্তায় বিটুমিনের ব্যবহার আগের ১০০ কেজি থেকে কমিয়ে বর্তমানে ৯১ কেজি করা হয়েছে।
"প্রতি কেজি বিটুমিন এখন প্রায় ৮০ টাকা, আর পলিথিন পাওয়া যায় বিনামূল্যেই। আমরা শুধু ল্যান্ডফিল বা ভাগাড় থেকে এটি সংগ্রহ করেছি," বলেন আবু মোহাম্মদ শাহরিয়ার। তার অনুমান, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারে প্রতি ৫ কিলোমিটার সড়কে ২০ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে।
তিনি দাবি করেন, প্লাস্টিকের ব্যবহারে গাজীপুর সড়ক কমপক্ষে ৫ বছর স্থায়ী হবে, যেখানে দেশের যেকোনো সাধারণ সড়ক গড়ে ২ থেকে ৩ বছর স্থায়ী হয়।
"এখন যে পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বিটুমিন পাথর থেকে আলাদ হতে থাকে। কিন্ত পাথরে প্লাস্টিকের প্রলেপ দেওয়া হলে বিটুমিন সরে আসতে পারে না। এক্ষেত্রে ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বিটুমিন টিকে থাকে। এ কারণে আমাদের এই পদ্ধতি খুবই উপযোগী এবং এতে সড়ক টেকসই হয়," যোগ করেন এলজিইডি প্রকৌশলী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাধারণত পারদ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার কাছাকাছি থাকে; তবে যানবাহনের চলাচলের কারণে এই ধাতু ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়।
এটি প্লাস্টিক অ্যাসফল্টের ক্ষয় রোধ করার পাশাপাশি বৃষ্টি-বর্ষা থেকেও সড়কের ক্ষতি রোধ করবে বলে উল্লেখ করেন এই প্রকৌশলী।
বেসরকারী সংস্থা ওয়েস্ট কনসার্নের মতে, বাংলাদেশে বছরে ৮.২১ লাখ টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে, কেবল ৫.২৭ লাখ টন বাতিল প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করা হয়; আর অবশিষ্ট প্লাস্টিক পড়ে থাকে অপরিশোধিত অবস্থায়।
গত বছর বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালের ৩ কেজি থেকে ২০২০ সালে এসে তিনগুণ বেড়ে ৯ কেজি হয়েছে।
প্রতি জেলায় ১ কিমি প্লাস্টিক রাস্তা নির্মাণের জন্য এলজিইডির উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে প্রকৌশলী শাহরিয়ার বলেন, ২৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৫০ থেকে ৬০ কেজি প্লাস্টিকের প্রয়োজন হবে। এটি ধীরে ধীরে ভবিষ্যতে দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনবে।
ভারতের রসায়নের অধ্যাপক রাজাগোপালন বাসুদেবন সর্বপ্রথম প্লাস্টিকের রাস্তার ধারণা দেন। ২০০১ সালে মাদুরাইয়ের থিয়াগারাজার কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ তার কর্মশালা থেকে ধারণাটির জন্ম হয়। ভারত এখন পর্যন্ত প্লাস্টিক মিশ্রিত বিটুমিন দিয়ে আড়াই লাখ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছে।
বিকল্প প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনায় তৈরি এই সড়কের ধারণা ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এলজিইডি বলছে, সংস্থাটি আরও একটি পাইলটিং চালু করতে যাচ্ছে, যেখানে ওপরে এবং নীচে অ্যাসফল্ট কার্পেটিংসহ একটি প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তর থাকবে।
একই পদক্ষেপে সড়ক ও জনপথ বিভাগ বলছে, আগামী বছর তারাও প্লাস্টিক নির্মিত রাস্তার পাইলটিং শুরু করবে। বর্তমানে আমদানি করা পলিমার বিটুমিন দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক মেরামতের কাজ করছে অধিদপ্তর।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ ওয়ালিউর রহমান বলেন, পলিমার বিটুমিনের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি; এটি সড়ককে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করে। আমদানি করা হলেও স্থানীয়ভাবেও এর উৎপাদন সম্ভব।
ওয়ালিউর রহমান আরও জানান, মহাসড়কেও এখন প্লাস্টিকের বিটুমিন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করে দেখছে সড়ক ও জনপথ ল্যাব।
"আমরা এখন টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির সঙ্গে একটি যৌথ গবেষণা পরিচালনা করছি। গবেষণা সম্পন্ন হলে, আমরা প্লাস্টিক-বিটুমিন কার্পেটিং করতে একটি জাতীয় মহাসড়ক বেছে নেব," বাংলাদেশ রোড রিসার্চ ল্যাবরেটরির পরিচালক আহসানুল্লাহ হাবিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক রাস্তা নির্মাণে প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রশংসা করে বলেন, এই মিশ্রণ রাস্তাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আরও কার্যকর সমাধান এনে দিতে সহায়তা করবে।
"প্লাস্টিককে এখন আমাদের বর্জ্য হিসেবে নয়, বরং কাঁচামাল হিসেবে দেখা শুরু করতে হবে," বলেন এই বিশেষজ্ঞ।