২০২২ সালের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ঘটনা
পরবর্তী প্রজন্মের ভ্যাকসিন
কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন এমআরএনএ (mRNA) প্রযুক্তির ভ্যাকসিন সফলভাবে কার্যকর করার পর একে আরও এগিয়ে নিতে কাজ করছে বেশ কিছু ভ্যাকসিন তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান। জার্মানির মাইঞ্জ শহরে থাকা বায়োএনটেক ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা এবং হারপিসের জন্যও এমআরএনএ ভ্যাকসিনের মানব ট্রায়াল শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। দাদরোগ নিয়ন্ত্রণে আনতেও বায়োএনটেক ফাইজারের সাথে কাজ করছে একটি এমআরএনএ-ভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে। মডার্নাও হারপিস এবং দাদ সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলির জন্য এমআরএনএ ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছে।
নভেম্বরে, বায়োএনটেক এবং ফাইজার একটি এমআরএনএ ভ্যাকসিন ট্রায়ালের প্রথম ধাপ শুরু করেছে, যেটি কোভিড-১৯ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা উভয়ের বিরুদ্ধেই সুরক্ষা দেবে। এই কম্বিনেশন ভ্যাকসিনে সার্স-কোভ-২, অমিক্রম বিএ.৪/বিএ.৫ এবং ৪টি ইনফ্লুয়েঞ্জার ধরনের জন্য এমআরএনএ স্ট্র্যান্ড এনকোডিং বাইন্ডিং প্রোটিন রয়েছে।
মহাকাশ পরিদর্শন
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া ছবিগুলো পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। মহাবিশ্ব কেমন ছিল, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ থেকে তোলা তার বেশকিছু ছবি এই বছর প্রকাশিত হয়েছে, এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সামনের বছরগুলোতেও গ্যালাক্সিগুলোর বিবর্তন নিয়ে টেলিস্কোপটির আবিষ্কারগুলো পুরো মানবজাতির সাথে ভাগ করে নেবে।
ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ESA) তাদের ইউক্লিড স্পেস টেলিস্কোপ তৈরি কাজ করছে, যেটি ছয় বছর ধরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে মহাবিশ্বের একটি থ্রিডি মানচিত্র তৈরি করবে।২০২৩ সালের জুন মাসে এটি মহাকাশে পাঠানো হবে ধারণা করা যাচ্ছে। একই সময় উৎক্ষেপিত হবে জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির এক্স-রে ইমেজিং এবং স্পেকট্রোস্কোপি মিশনের একটি পৃথিবী-প্রদক্ষিণকারী উপগ্রহ, যা দূরবর্তী তারা এবং ছায়াপথ থেকে এক্স-রে বিকিরণ শণাক্ত করবে।
চিলির ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরিও ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে ছবি তোলা শুরু করবে। এই টেলিস্কোপের একটি বিশেষ তিন-আয়নার নকশা এবং তিন বিলিয়ন পিক্সেলেরও বেশি সলিড-স্টেট ডিটেক্টর সমন্বিত একটি ক্যামেরা রয়েছে, যেটি মাত্র তিন রাতে সমগ্র দক্ষিণের আকাশ স্ক্যান করতে সক্ষম হবে। এছাড়াও বিশ্বের বৃহত্তম স্টিয়ারেবল টেলিস্কোপ, চীনের জিনজিয়াংয়ে অবস্থিত জিনজিয়াং কিতাই রেডিও টেলিস্কোপ চালু করা হবে৷ ১১০ মিটার বিস্তৃত এই টেলিস্কোপ যে কোনো সময়ে আকাশের 7৭৫ শতাংশ তারা পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে।
রোগ বহন করা জীবাণু তালিকা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অগ্রাধিকার পাওয়া প্যাথোজেনের (রোগ ছড়াতে সক্ষম এমন ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়া/জীবাণু) একটি সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রায় ৩০০ জন বিজ্ঞানী ২৫টিরও বেশি ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়া পরিবারকে পর্যালোচনা করছেন যাতে প্যাথোজেনগুলোকে শণাক্ত করে ভবিষ্যত প্রাদুর্ভাব গুলকে আগে থেকেই মোকাবেলা করা যায়। প্রতিটি প্যাথোজেনের জন্য গবেষণায় কী কী ফাঁক রয়েছে, কী কী ধরনের গবেষণা করা যেতে পারে, এগুলোর ভ্যাকসিন তৈরির রূপরেখা, চিকিত্সা এবং ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলা থাকবে এই তালিকায়।
চাঁদ অভিযান
নাসার ক্রুবিহীন ওরিয়ন ক্যাপসুলটি যেভাবে ১১ ডিসেম্বর পৃথিবীতে ফিরে আসে, ঠিক একইভাবে চাঁদের উদ্দেশ্যে আরও তিনটি মিশন চলছে: সংযুক্ত আরব আমিরাতের রশিদ রোভার, নাসার লুনার ফ্ল্যাশলাইট এবং জাপানি হাকুটো-আর মিশন ১, যেগুলো ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে চাঁদে অবতরণ করবে।
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তৃতীয় চাঁদ-অন্বেষণ মিশন চন্দ্রায়ন-তিন ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ মেরুর কাছে অবতরণ করবে। ঠিক পরের বছরই চাঁদে প্রথম বেসামরিক ভ্রমণও দেখা যাবে, স্পেসএক্স রকেট স্টারশিপে ১১ জন ব্যক্তি যাত্রা করবে।
ক্রিসপার থেরাপি
ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলোর সফল ফলাফলের পর ক্রিসপার জিন-এডিটিং থেরাপি প্রথমবার অনুমোদন দেওয়া হতে পারে, যেখানে ক্রিসপার-ক্যাস৯ সিস্টেম ব্যবহার করে বিটা-থ্যালাসেমিয়া এবং সিকেল-সেল রোগ নিরাময় করা হবে। এই নিরাময় পদ্ধতিটি নিয়ে কাজ করছে বোস্টনের ম্যাসাচুসেটসের কোম্পানি ভার্টেক্স ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ক্যামব্রিজের ক্রিসপার থেরাপিউটিকস। এই পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তির নিজস্ব স্টেম সেল সংগ্রহ করে ক্রিসপার-ক্যাস৯ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ত্রুটিপূর্ণ জিন ফেলে দিয়ে কোষগুলোকে আবার ব্যক্তির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। বিটা-থ্যালাসেমিয়া বা সিকেল-সেল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য ভারটেক্স মার্চ মাসে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের কাছে আবেদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আলঝেইমারের ওষুধ
জানুয়ারির শুরুতে আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মস্তিষ্কের কোষ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হার কমিয়ে আনতে পারে এমন একটি ঔষধ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারেন, যেটি ইতোমধ্যেই ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপ শেষ করেছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এইসাই এবং বায়োটেকনোলজি ফার্ম বায়োজেন লেকানেমাব নামের এই মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি তৈরি করেছেন, যা মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া অ্যামিলয়েড-বিটা প্রোটিনকে পরিষাক্র করবে। ক্লিনিকাল ট্রায়ালে ১৭৯৫ জন প্রাথমিক পর্যায়ের আলঝেইমার আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর এই ঔষধ পরীক্ষা করা হয় এবং দেখা যায় যে লেকানেমাব একটি প্লাসিবোর তুলনায় ভুলে যাওয়ার হার ২৭ শতাংশ কমিয়ে দেয়। তবে কিছু বিজ্ঞানীরা ঔষধটির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন।
আরেকটি আল্জ্হেইমের ওষুধ, ব্লারকামেসিন নামক - নিউ ইয়র্ক সিটিতে অ্যানাভেক্স লাইফ সায়েন্সেস দ্বারা তৈরি করা - ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে তার পথ তৈরি করতে থাকবে৷ Blarcamesine একটি প্রোটিন সক্রিয় করে যা নিউরনের স্থায়িত্ব এবং একে অপরের সাথে সংযোগ করার ক্ষমতা উন্নত করে।
নিউক্লিয়ার বর্জ্য সঞ্চয়
ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত দ্বীপ ওলকিলুয়োটোতে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বর্জ্য সঞ্চয় শুরু হবে আগামী বছর থেকে। ফিনিশ সরকার ২০১৫ সালে গভীর-ভূগর্ভস্থ এই স্টোরেজ নির্মাণের অনুমোদন দেয়, যেখানে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন করার পর নিউক্লিয়ার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিরাপদ দূরতে রাখা যাবে।
সাড়ে ৬ হাজার টন তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম তামার ক্যানিস্টারে আটকে কাদামাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে এবং গ্রানাইটের ভূগর্ভস্থ টানেলের ৪০০ মিটার ভেতরে রাখা হবে। এই পারমাণবিক বর্জ্য কয়েক লক্ষ বছর ধরে সেখানে আটকে থাকবে, যে সময়ের মধ্যে বিকিরণের মাত্রা কমে আসবে।