প্রাণীরা আছে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, ইংরেজ কর্মকর্তা ও শিকারির রোজনামচায়!
বাংলাদেশের বুনোপ্রাণীর গত একশ বা দুইশ বছর আগের ইতিহাসের জন্য আমাদের ঘুরেফিরে ইংরেজ কর্মকর্তা, শিকারি ও অভিযাত্রীদের রোজনামচা ও রেকর্ডের ওপরে ভরসা করতে হয়। এবং অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে দেখা যায়, খুব বেশিদিন আগে নয়, কেবল ১০০ বছর আগেই তাদের রেখে যাওয়া নানা নথিপত্রে উল্লেখিত অনেক পশু এবং পাখি আমরা কেউই কোনো দিন আমাদের জীবদ্দশায় দেখিনি—কারণ, এগুলো বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে চিরতরে, কেউ আবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে সারা পৃথিবী থেকেই। এই নিকট অতীতের বন্যপ্রাণী ভরা বাংলার যে নিসর্গের আমরা বর্ণনা পাই, তা আজ রূপকথা বলে মনে হয়।
১.
রাজশাহীর, পদ্মার চরে ঘড়িয়াল দেখিনি আমরা কোনো দিনই, আগে গেলেই শুশুকের দেখা মিলত, এখন কালেভদ্রে উঁকি দিয়ে আমাদের ধন্য করে পদ্মার এই ডলফিনরা। বন্যপ্রাণী বলতে দেখেছি কেবল শিয়াল, বেজি, গুইসাপ, বাদুড়, সাপ আর পাখি। [১৯১৬ সালে ছাপা এল এস ও'ম্যালির রাজশাহী গেজেটের বিবরণ।]
এফ বি সিমসন ১৮৫০ সালে জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্র হিসেবে রাজশাহীতে যোগদান করেন। সেই আমলে পদ্মার চর ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি, শুধু নীল চাষের জন্য ব্যবহৃত কিছু পরিষ্কার করা জায়গা ছাড়া নানা ঝোপঝাড়, নলখাগড়ায় ভরা ছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল, অনেক জায়গাতেই জঙ্গল এতটাই দুর্ভেদ্য ছিল যে পালা হাতির পালের সাহায্য ছাড়া সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। চর ভর্তি থাকত বুনো মহিষে।
১৮৬০-এর দিকে ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার হ্যারি ডেভেরেল চর সোনাইকান্দিতে অত্র এলাকার শেষ বুনো মহিষটি শিকার করেন।
বরেন্দ্র ভূমি (বরিন) ছিল শিকারের জন্য আদর্শ, যেখানে বাঘের দেখাও মিলত। জনাব সিমসনের মতে তাল, বাঁশ এবং অন্যান্য স্থানীয় গাছের সমন্বয়ে এইখানে ছিল বিশাল জঙ্গল, এবং জঙ্গলের তলদেশে থাকতো নানা ধরনের ঝোপ, যা ছিল নানা প্রাণীর লুকিয়ে থাকার জন্য যথার্থ জায়গা। তথাপিও এ অঞ্চল এতটাই অগম্য এবং গুলি করার জন্য ঝামেলাপূর্ণ ছিল যে, অধিকাংশ শিকারি এই এলাকাকে সুনজরে দেখতেন না। ফলে শিকারের অধিকাংশ প্রাণীই এখানে নির্বিঘ্নে প্রজনন করত বছরের পর বছর। মাঝে মাঝেই হরিণ, বুনো শুয়োর সেখানে থেকে গ্রামে নেমে আসত, ঘাস এবং ঝোপে আশ্রয় নিয়ে তারা সবুজ ফসলের ওপর হামলা চালাত। আবার পোষা হাতির পালের তাড়া খেলেই ফের বরিন এলাকায় পালিয়ে যেত। জলের উৎস এবং বন এলাকার মাঝেই চরে বেড়াত হরিণ (Hog-deer), যার পিছু নিত বাঘ এবং চিতাবাঘ।
কালা-তিতির (Black Francolin) এবং হরিণেরা ঘাসের জঙ্গলে আস্তানা গাড়ত। চিকোর নামের বাতাই জাতীয় (Patridge) পাখিটি ঝোপে, কাদাখোঁচা এবং সব জাতের বুনোহাঁসেরা জলের কাছেই থাকত। বরেন্দ্র অঞ্চলে যে শিকারের প্রাচুর্য ছিল, তা হচ্ছে চিত্রা হরিণ এবং ময়ূর, যা আমি বাংলার আর কোথাও শিকার করি নাই। এবং জীবনে এখানেই প্রথম আমি বাঘ দেখি। মহানন্দা তীরের অভয়া নামের এক পুরাতন নীল কারখানা ঘুরে দেখার পর জনাব সিমসন সেই পানিপূর্ণ উপত্যকায় ঘুরে দেখেন এবং তার রোজনামচায় শিকারের তালিকা লিপিবদ্ধ করেন—৪টি হরিণ, ৯টি বাতাই, ২ জোড়া চাপাখি, ২টি বুনোহাঁস এবং ১টি আহত বাঘ!
৫০ বছর আগে এই অঞ্চল বুনো মহিষ, বাঘ, চিতাবাঘ, বুনো শুয়োর, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণে ভরা ছিল। খুদে শিকারদের মধ্যে ছিল খরগোশ, ময়ূর, কালোতিতির, বাদাতিতির, বৃষ্টি-বটেরা, পাতিডাহর, নানা জাতের বুনোহাঁস, বনমুরগি, কাদাখোঁচার দল। এতসব প্রাণীর মধ্যে কেবল চিতাবাঘ এবং বুনো শুয়োরেরাই টিকে আছে গ্রামের জঙ্গলগুলোতে, বাকিরা কৃষিকাজের জন্য জঙ্গল কাটার জন্য হারিয়ে গেছে চিরতরে। পাখিদের মধ্যে অবশ্য অবস্থা কিছুটা ভালো, কেবল ময়ূর আর বাদাতিতিরেরাই হারিয়ে গেছে। অল্প কয়েকটি কালোতিতির আর পাতিডাহরের দেখা মেলে মাঝে মাঝে, আর বুনোহাঁস, বনমুরগি, কাদাখোঁচার দল আগের মতোই আছে।
২০ বছর আগপর্যন্তও বাঘেরা টিকে ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবের জন্য গোদাগাড়ীর বরিন অঞ্চলের প্রতিবছর বিট করা হতো এবং ১৮৯৪ পর্যন্ত রাজশাহীর কালেক্টর এবং আরেকজন শিকারি রামপুর-বোয়ালিয়ার ৩ মাইলের মধ্যে বেশ কটি বাঘ মেরেছিলেন। শেষ বাঘটি দেখা গেছিল ১৯০০ সালে খরচাকাতে।
চিতাবাঘের একটি রাজশাহী শহরের কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রাচীরে ওঠার চেষ্টা করার সময় ১৯০৭ সালে গুলি করা হয়, এছাড়া ১৯১৫ সালেও একটিকে শহরে দেখা গেছিল। একবার জানা যায় একটি চিতাবাঘ নরখাদকে পরিণত হয়েছে, এবং রাজাপুর পুলিশ পোস্ট এলাকার চারজন মানুষকে শিকার করেছে। অধিকাংশ চিতাবাঘই ছিল ছোট আকৃতির, যার বাসযোগ্য বনের অভাব এখানে ছিল না। রামপুর-বোয়ালিয়া থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত শিরইল গ্রামে এদের প্রায়ই ফাঁদ পেতে ধরা হতো এবং সেখানে অনেক বনবিড়ালও দেখা যেত। অন্যান্য বুনো বিড়াল, শেয়াল এবং খরগোশ ছিল অগুণতি।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সব শেষে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন, যা গঙ্গা এবং আত্রাই নদীতে, সেই সাথে চলনবিলের গভীর অঞ্চলেও সহজে দেখা যায়।
এখানের শকুনেরা পশ্চিমের শকুনের তুলনার বিশালকায় হয়, যারা গাছের ওপরে বসে খাবারের অপেক্ষায় থাকে দিনমান, এদের ধৈর্যের অভাব নেই আবার এদের খাবার জন্য পচা-গলারও অভাব হয় না। বিল এবং নদীতে মেছো ইগলেরা রাজত্ব করে। কোকিল পরিবারের মধ্যে কানাকুয়ো (এটি মোটেও কোকিল নয়, তখন ভুল ভাবা হত) এবং দেশি কোকিলের ডাকই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। রাতে সবসময়ই শোনা যায় রাতচরার ডাক, বরফের মাঝে পাথর পড়ার মতো শব্দ তুলে অবিরাম অস্তিত্ব জানান দেয় সে।
মূল নদী এবং কয়েকটি জলাধারে দুই ধরনের কুমিরের দেখা মেলে, একটি মাগার কুমির অন্যটি ঘড়িয়াল। মাগার কুমির ১২ ফুটের মতো লম্বা হয়, যেখানে মাছখেকো সরু মুখের অধিকারী ঘড়িয়াল হয় ৮ ফিট। নদীর কচ্ছপ কালি কাইট্ট্যা প্রায় সবখানেই মেলে এবং নিম্নবর্ণের মানুষেরা সেগুলো খেয়ে থাকে।
[উপরের বর্ণনা সেই আমলের ডিস্ট্রিক্ট গেজেটের, উল্লেখিত ১০০ বছরে বর্ণিত প্রাণীগুলোর প্রায় ৯০% হারিয়ে গেছে, বাকিরাও বিলুপ্তির পথে।]
২. পাবনা, ১৮৭৭ সালে স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গলে লেখা হয়েছিল: পাবনা জেলার বড় প্রাণীদের মধ্যে মহিষ এবং হরিণ বিরল, তবে বাঘ, চিতাবাঘ এবং বুনো শুয়োর সবখানে প্রচুর পরিমাণে আছে। পাবনা অঞ্চলের বুনো শুয়োরেরা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং আকারে বড় ছিল, যে কারণে এখানে বসবাসকারী এবং ঘুরতে আসা ইউরোপিয়ানদের মাঝে শুয়োর শিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
কিন্তু বর্তমানে এই অঞ্চল নিয়ে আর সেই কথাটি বলা যায়না। বুনো মহিষ হরিণ এবং বাঘেরা কৃষিকাজ বৃদ্ধির সাথে সাথে উধাও হয়ে গিয়েছে, বলা হয়ে থাকে যে গত শতকের শেষের দিকে একটি মানুষখেকো বাঘ কয়েকজন মানুষকে মেরে পাবনা শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল এবং তাকে শিকার করা হয়। তবে চিতাবাঘ এবং বুনো শুয়োরেরা এখনো অসংখ্য আছে। যদিও চিতাবাঘের সংখ্যা অনেক কমে গেছে তবুও চাটমোহর, দুলাই এবং উল্লাপাড়ার জঙ্গলে তাদের ভালোই দেখা যায়। পাবনার উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমের জঙ্গলে কয়েকটা নেকড়ে দেখার রিপোর্টও আছে। এ ছাড়া শিয়াল, দুই ধরনের বেজি, বনবিড়াল, একাধিক ধরনের খাটাশ, সজারু, খেকশেয়াল, খরগোশ এবং দুই ধরনের ভোঁদড় দেখা যায়।
ভারতবর্ষের দুটি বিশাল নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় অবশ্যই এই অঞ্চলে অনেক ছোট ছোট নদী, খাল, জলাভূমিতে ভরা বলে অজস্র জলজ পাখিকে এই ভূখণ্ড আকৃষ্ট করে। শীতকালে এখানে দাগি রাজহাঁস, মেটে রাজহাঁস এবং নাকতাহাঁসের বিচরণ চোখে পড়ে, তবে এদের শিকার করা বেশ কঠিন। পদ্মা এবং যমুনার চরে ল্যাঞ্জাহাঁস, খুন্তেহাঁস, পিয়ংহাঁস, ভুতিহাঁস, নীলমাথাহাঁস, দেশি মেটেহাঁস এবং জোড়ায় জোড়ায় চখাচখি বেশ দেখা যায়। ছোট হাঁসদের মধ্যে পাতিতিলিহাঁস, সরালি ভালো দেখা যায়, তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ধলাবালিহাঁস। চ্যাগা শিকারের আদর্শ জায়গা এখানে।
[এল এস এস ও'ম্যালী, ১৯২৩ সালে প্রকাশিত বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার]
৩.
ময়মনসিংহ, রেনল্ড বলেছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এখানের চরগুলোর উত্তর-পশ্চিমে ভারতবর্ষের যেকোনো জেলার মতোই বাঘের দেখা মিলত এবং মাঝে মাঝে গণ্ডার শিকারও চলত। মধুপুরের জঙ্গল এবং গারো পাহাড়ের পাদদেশে বাঘ এখনো অনেক আছে কিন্তু অনেক হাতি ছাড়া তাদের পাওয়া মুশকিল। সব থানাতেই চিতাবাঘ মাঝে মাঝেই শিকার করা হয়। কাঁঠালের মৌসুমে ভালুকেরা পাহাড় থেকে নেমে আসে এবং মধুপুরের স্থানীয় শিকারিদের শিকারে পরিণত হয়।
উত্তরের গ্রামগুলোতে বুনো হাতি একসময় ত্রাস তৈরি করত কিন্তু এখন তারা ঘেরের মাঝেই সীমাবদ্ধ। ১৯১৫ সালে সুসং রাজ গারো পাহাড়ের ভেতরে খেদা দিয়ে হাতি ধরার চেষ্টা করে দুই দিন ধরে সেই হাতিদের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং দুর্গাপুর বাজারের কেন্দ্রে তাদের ধরা হয়!
তিন বছর আগে একটি পাগলা হাতিকে থানা থেকে কয়েক মাইল দূরে গুলি করা হয়।
শিকারের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় পাখি হচ্ছে লাল বনমুরগি, যাদের গারো পাহাড়ের পাদদেশে প্রতি সন্ধ্যায় দলে বেঁধে খেতে দেখা যায়, দলে সাধারণত ১০টির বেশি বনমুরগি থাকে। স্বভাবে লাজুক হলেও মধুপুর জঙ্গলের সিঙ্গারচলা, জুগিরকোপা, শালগ্রামপুর এবং অন্য জায়গায় এদের এন্তার দেখা মেলে। সারা জেলার নানা অঞ্চলে কোয়েলেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, বিশেষ করে রাজ-বটেরা এবং মেটেতিতিরের বড় দলকে ঘাসের বনে পাহাড়ের পাদদেশে সদ্য কাটা ধানখেতে খেতে দেখা যায়। অন্য পাখিরা সাধারণত পাহাড়েই থাকে যেমন মথুরা আর বিরল বন-চ্যাগা। বড় বগা দুর্গাপুর জেলার স্থায়ী বাসিন্দা, পাতি বনবাবিল এবং ছোটকুবো সম্ভবত ময়মনসিংহের আর কোথাও মেলে না।
বুনোহাঁস শিকারের জন্য খালিয়াজুরি পরগনা অতিবিখ্যাত। নভেম্বর থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে উষ্ণতাময় দিনগুলোতে ল্যাঞ্জাহাঁসসহ নানা জাতের অগণিত হাঁস সেখানে দেখা যেত এবং লেগুন আকৃতির বিলের জলসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত জঙ্গল শিকারিদের গা ঢাকা দিয়ে শিকার করার জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে গণ্য হত, বিশেষ করে যেখান বড় আকৃতির হাঁসেরা থাকত। মার্চের পর অবশ্য একমাত্র দেশি মেটেহাঁসদের দেখা মিলত। তারা এবং বিরলতর গোলাপিমাথা হাঁস এই জেলায় প্রজনন ছিল। এই হাঁস পৃথিবী থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
[এফ এ সাকসের তত্ত্বাবধানে ১৯১৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ময়মনসিংহ গ্যাজেটিয়ার। এখানে বর্ণিত কিছু পশুপাখি বাংলা তো বটেই, সারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যেমন গোলাপিমাথাহাঁস। এখানকার আরও কিছু পশুপাখি বিলুপ্ত হওযার পথে।]
যমুনার চরে, নানা জাতের হাঁস থাকে, বিশেষ করে বিরল চখাচখি, কিন্তু তাদের কাছে যাওয়া অনেক কঠিন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই গরাদমাথা রাজহাঁসেরা চলে আসে। কেবলমাত্র ফেব্রুয়ারির শেষে যখন তারা প্রিয় চারণক্ষেত্রে চরগুলো ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে, তখনই কেবল স্থানীয় ছোট নৌকার সাহায্যে কাছে গিয়ে বন্ধুকের আওতায় আনা যায়।
রাজহাঁস কেবল মৌসুমের শুরুতে এবং শেষে দেখা যায়, ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এরা এই অঞ্চলে কেবলমাত্র পান্থ-পরিযায়ী।
কোড়া পাখি গ্রামের মানুষদের কাছে লড়াইয়ের জন্য অতি প্রিয়। বিচিত্র পদ্ধতিতে তাদের প্রজনন করানো হয়। বুনো কোড়ার বাসা থেকে ডিম সংগ্রহ করে তুলা দিয়ে মুড়িয়ে নারকেলের খোলার মধ্যে ঢুকিয়ে একজন মানুষের (সাধারণত যে ডিম খুঁজে পায়) কোমরের সাথে বেঁধে রাখা হয়, সেই মানুষের দেহের তাপেই ডিম ফুটে কোড়ার বাচ্চা বের হয়। অনেকেই এইভাবে বাচ্চা ফুটায় এবং তাদের দাম হয় কমপক্ষে ১০ রুপি।
মেঘনায় নভেম্বরে গেওয়ালা-বাটানের বিশাল ঝাঁক চলে আসে। বাঘা-বগলার মাঝে মধ্যে দেখা মেলে এবং পাতি-সারস কেবল শীতের আগন্তক।
দাগি-ঘাসপাখিদের নলবনে গঙ্গাফড়িঙের টোপ দিয়ে ধরে শিকারিরা কলকাতায় পাঠায়, সেখানে নিউমার্কেটে এদের বিকিকিনি চলে। মাছের পুকুরের আশপাশে সবসময়ই শঙ্খচিলদের ঝাঁকের দেখা মেলে, মাঝে মাঝে মেছো ইগলও দেখা যায়। কাছের নদীতে প্রায়ই দেশি গাঙচষার ঝাঁক দেখা যায়। এছাড়া শীত ও বসন্তে বড় আকৃতির গাঙচিলের দেখা মেলে বড় নদীগুলোতে।
ভারতবর্ষে দেখা মেলে এমন আট ধরনের মানিকজোড়ের মধ্যে কেবল ধলামানিকজোড়, ম্যারাবুই (!) এবং কালোমানিকজোড় বাদে সবই যমুনার চরে দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে বড় মদনটাক, রাঙ্গামানিকজোড় এবং ধলাগলামানিকজোড়।
ছোট সৈকতপাখিদের মধ্যে পাকরা-উল্টোঠুটিদের দেখা মেলে। ওপরের দিকে বাঁকা অদ্ভুত চঞ্চু এবং সাদা-কালো বর্ণের পাখিটিকে বিরল মনে করা হলেও চরের এক চিত্তাকর্ষক বাসিন্দা হিসেবে তাকে ধরা যায়। যমুনায় গুলিন্দা এবং নাটাগুলিন্দার দেখা মেলা ভার। পাতিসবুজপা পানি জমে থাকা ছোট ছোট গর্তে থাকে কিন্তু এদের খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। পাতিলালপা, মেটে জিরিয়া মাঝে মাঝে দেখা যায়। হটটিটি সব বড় নদীতেই দেখা যায়। অন্যান্য ছোট পাখিদের মধ্যে আছে ছোটনথজিরিয়া, পাতিবাটান, সবুজবাটানএবং আবাবিলের মতো দেখতে বাবুবাটান ও ছোট-চাপাখি।
পাকরা-উল্টোঠুটির মতো অন্যান্য বিরল পাখির মধ্যে আছে বড় মোটহাটু, যা কিনা যমুনায় অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে বেশি দেখা যায়, এর বড় আকৃতি, বিশেষ ধরনের চঞ্চু, যার সাথে জিরিয়ার চেয়ে কাকেরই মিল বেশি এবং চশমার মতো চোখ যার প্রথম দেখায় রাঙা চ্যাগার চোখ মনে হয়, এতসব ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রাণিবিদদের সঠিক গোত্র ও ক্রম বাহির করতে যথেষ্টই বেগ পেতে হয়েছে।
নানা জাতের চ্যাগা সংখ্যায় অনেক হলেও এদের খুঁজে পাওয়া নেহাত সহজ নয়। আস্তাগ্রাম, ধলাপাড়া এবং মাদারগঞ্জ নানা সময়ে অনেক চ্যাগা শিকার করা হয়েছে। এদের মাঝে ছিল ল্যাঞ্জা-চ্যাগা, জ্যাক-চ্যাগা। এ ছাড়া ভোঁতাভরত বিশাল ঝাঁক নিয়ে এপ্রিল মাসে চষা জমিতে খাবার খেতে আসে। এই জেলার অন্যান্য পাখিগুলো সবচেয়ে ভালো পর্যবেক্ষণ করা যায় মধুপুর জঙ্গলে।
নিচের তথ্যগুলোর জন্য এল আর ফকসের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
৪.
বগুড়া, বড় প্রাণীদের মধ্যে বাঘ একসময় এখানে অসংখ্য ছিল, অথচ এখন একেবারেই নেই। এটা অবিশ্বাস্য যে ১৮৬৪ সালের ডিসেম্বরে শিকারিদের একটি দল ২৫৭টি বাঘ এবং চিতাবাঘের খুলি নিয়ে এসে পুরস্কার হিসেবে ৭০০ টাকা নিয়ে গিয়েছিল।
চিতাবাঘেরা এখনো পাঁচবিবি এবং শেরপুরে ভালোই দেখা যায় এবং সমগ্র জেলার সবখানেই মাঝে মাঝে দেখা যায়। বুনো শুয়োর যে একসময় পাঁচবিবিতে ক্ষতিকর প্রাণী হিসেবে বিবেচিত ছিল, তা এখন অনেক বিরল। বুনো মহিষ এবং হরিণেরা সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। খরগোশ, সজারু এবং বনবিড়াল মাঝে মাঝে দেখা যায়। প্রায় সব গ্রামেই শেয়াল এবং খেঁকশিয়ালের দেখা মেলে। বগুড়া তার বিষধর সাপের জন্য কুখ্যাত, গোখরা এবং ক্রেট সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অন্যান্য অনেক জেলায় ফলের বেশ ক্ষতি করা কাঠবিড়ালি এবং বানরেরা এই জেলায় অনুপস্থিত।
[জে এন গুপ্ত। ১৯১০ সালে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ এবং আসামের ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার থেকে]
৫.
ফরিদপুর, বর্তমান ফরিদপুরের একটা বিশাল অংশকে রেনেলের মানচিত্রে অগম্য কাদাময় জলা হিসেবে দেখানো হয়েছেএবং ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে জেলার পূর্বদিকে গহন সব বন ছিল যেখানে বাঘ এবং বুনো মহিষেরা থাকত। ১৭৯২ সালে মাদারীপুরে দশটি বাঘ হত্যার জন্য পুরস্কার দেয়া হয়েছিল এবং অনেক পরেও এমনকি ১৮৭৫ সালেও স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গলে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় শীতকালে বুনো মহিষদের ভালোই দেখা যেত।
চিতাবাঘদের এখনো জেলার উত্তর এবং পশ্চিমের নানা বনে দেখা যায় এবং মাঝে মাঝে সুন্দরবন থেকে কোনো একটি পথভুলো বাঘ দক্ষিণের জলাভূমিতে আশ্রয় নেয়। বন্য শূকরেরা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং ফসলের ক্ষতিসাধন করে, বিশেষ করে ফরিদপুর এবং ভুসনা থানাতে। এর মাঝে তাদের দেখা মেলেনি কিন্তু ৫০ বছর আগের রিপোর্টে জানা যায় যে তাদের ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অতি তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অনেক গ্রামই ধ্বংস হয়ে জঙ্গলে পরিণত হতো, দূরবর্তী কিছু জমির কৃষিক্ষেত্র এভাবেই তাদের রাগে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
কুমির এবং ঘড়িয়াল, উভয় প্রজাতিকেই সকল বড় নদীতে দেখা যায়।
এ জেলার বিশাল একটি অংশ পানির নিচে থাকার জন্য মৎস্যসম্পদের প্রাচুর্য দেখা যায়, মানুষের খাদ্যের একটা বিশাল অংশের জোগান এই মাছ থেকেই আসে, বিশেষ করে মাছের মৌসুমে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষেরা মাছের ওপরে ভরসা করেই বেঁচে থাকে।
মাগুরের মতোই দেখতে একধরনের মাছ পাওয়া যায়, যার নাম শিঙি অর্থাৎ শিংওয়ালা মাছ এবং এই শিং যদি শরীরে বেঁধে, তবে তা থেকে অসহ্য বেদনার উৎপত্তি হয়।
[এল এস এস ওম্যালি, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার থেকে]
৬.
নোয়াখালী, বন্যপ্রাণী বা বড় আকারের শিকারি প্রাণীরা এখন অত্যন্ত বিরল কিন্তু মাঝে মাঝে ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে বাঘ এবং চিতাবাঘেরা নেমে আসে, জেলার পূর্ব সীমান্তের গ্রামগুলোতে আক্রমণ করে তারা গরু এবং ছাগল ধরে নিয়ে যায়। চিত্রল হরিণ এবং হগ ডিয়ার একই এলাকার শস্যক্ষেত্রে ব্যাপক বিচরণ করে।
এই জেলায় টিকে থাকা সত্যিকারের বড় বন্যপ্রাণী হচ্ছে বুনো মহিষ এবং বুনো শুয়োর। বন্য মহিষ এখন কেবলমাত্র চর মীর মোহাম্মদ আলীতে দেখা যায়, যা হাতিয়া দ্বীপের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত। সেখানে বুনো মহিষের সংখ্যা এতই বেশি যে নতুন করে বসতি স্থাপন করতে যাওয়া মানুষদের জন্য তারা প্রবল উৎপাত হিসেবেই দেখা দেয়। তাদের ধরার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু সে চেষ্টা বড়ই বিপজ্জনক ও কঠিন এবং কোনো সময়ই খুব বেশি বুনো মহিষ ধরা যায়নি। সাধারণত বৃদ্ধ ষাড়গুলো খুবই হিংস্র, তবে নারী এবং বাচ্চা মহিষ ধরার পরে যদি প্রথম কয়েক দিনে মারা না যায়, তবে সাধারণত পোষ মানে। গৃহপালিত প্রাণীদের সাথেও এদের প্রজনন হয়, যারা সেই একই চরে ঘুরে বেড়ায়। লক্ষ্মীপুর থানার মেঘনার চরে বুনো শুয়োরদের বড় এবং ছোট দলে দেখা যায় এবং জেলার অন্যান্য স্থানেও।
মেঘনায় কুমিরদের ভালোই দেখা যায়, বিশেষ করে হাতিয়ার পশ্চিমের বালুচরে। মাঝে মাঝে তারা গবাদিপশু ধরে নিয়ে যায়, তবে এই জেলার মানুষেরা যেহেতু বড় নদীতে স্নান করে না বললেই চলে, তাই কুমিরের আক্রমণে মানুষের মারা যাওয়ার ঘটনা সহজে ঘটে না।
[জে ই ওয়েবস্টার। ১৯১১ সালে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার থেকে নেওয়া]
৭.
বরিশাল (বাকেরগঞ্জ), জেমস চার্লস জ্যাক ১৯১৮ সালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল) জেলার বিস্তারিত বর্ণনা বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে লিপিবদ্ধ করেন। বাকেরগঞ্জ জেলার তৎকালীন আয়তন ছিল ৪৮৯১ বর্গমাইল। বর্তমান পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালি এবং বরিশাল জেলা তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার অংশ ছিল।
অতীতে বাকেরগঞ্জে বৃহাদাকৃতি স্তন্যপায়ী প্রাণীর ঘন বসতি ছিল। কিছুকাল পূর্বেও গৌরনদীতে বাঘের এমন আনাগোনা ছিল যে সেগুলো মারার জন্য বিশেষ পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করতে হয়েছিল। উত্তর-পূর্বের জলাভূমিতে বিরাট বুনো মহিষের পাল অবাধে ঘুরে বেড়াত। পরবর্তী সময়ে বাঘেরা জেলার আরও দক্ষিণে চলে যায় এবং সেখান থেকে তাদের ধারাবাহিকভাবে ফাঁদ পেতে মেরে ফেলা হয়েছে। হিসাবমতে (১৯১৮) সাহাবাজপুরে (বর্তমানের ভোলা) কোনো বাঘ নেই, যদিও ৪০ বছর আগে এখানেই অসংখ্য বাঘের দেখা মিলত। সুন্দরবন এবং সম্ভবত বলেশ্বর নদীর আশেপাশে প্রচুর গন্ডারের দেখা মিললেও অনেক বছর ধরে কোনো গন্ডার দেখতে পাওয়া যায়নি।
সুন্দরবন, মেঘনা মোহনার দ্বীপ এবং ভান্ডারিয়ার বিলগুলো বাদ দিলে অন্য সব জলাভূমিগুলো থেকে বুনো মহিষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চিত্রা হরিণ প্রচুর মেলে সুন্দরবন এবং সাহাবাজপুর দ্বীপে। জলাহরিণ বা বারশিঙ্গা দেখা যায় ভান্ডারিয়ার বিলে। সুন্দরবনে মায়াহরিণও দেখা যায়।
চিতাবাঘের দেখা মেলে জেলার সর্বত্রই এমনকি বরিশাল শহরেও। আরও যেসব প্রাণী জেলার সর্বত্রই পাওয়া যায়, সেগুলোর মাঝে রয়েছে শিয়াল, বনকুকুর, সজারু, ভোঁদড়, বেজি, ইঁদুর, বনবিড়াল, খাটাশ, কয়েক প্রজাতির বাদুড় এবং নদীতে শুশুক। সাহবাজপুর দ্বীপের সবখানেই ভোঁদড় এবং বুনোশুয়োরের দেখা মেলে। ফলখেকো বাদুড় জেলার দক্ষিণে চোখে পড়ে, এছাড়া অন্য বাদুড়ও এখানে আছে।
নদীতে প্রায়ই সাগর থেকে আসা হাঙর দেখা যায়। ১৮৭০-৭১ সালে সাহাবাজপুরে ৪৮ ফিট লম্বা হাঙর ধরা পড়ে, সেটাকে পরে বরিশালে প্রদর্শন করা হয়।
উপরে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার পূর্ববঙ্গে শিকারে আসা ও অভিযাত্রীদের বর্ণনায় যেসব পশুপাখির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সিংহভাগই শুধু এখন নথির প্রাণী। তারা আর নেই। যারা এখনও নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে আছে, তারাও বর্তমান প্রজন্মের জীবদ্দশাতেই হারিয়ে যাবে, এই শঙ্কা সব কীটতত্ত্ববিদ ও প্রাণিবিদরাই করছেন।