চিড়িয়াখানার বন্দিদশা থেকে মুক্তি, ১৫ বছর পর সাফারি পার্কে বোনদের দেখবে মধুবালা
পাকিস্তানের বন্দর নগরী করাচির সাফারি পার্কে তার জন্য নির্ধারিত শোবার ঘরে ধীর পায়ে প্রবেশ করলেন মধুবালা। তখনও তাকে ঘিরে তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের উল্লাস ও শিস শোনা যাচ্ছে। মধুবালার লেজ এপাশ থেকে ও পাশে দুলছিল। একদম শান্ত ও নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে যাচ্ছিল সবচেয়ে শান্ত হাতি হিসেবে পরিচিত মধুবালা। তার শোবার ঘরে তার জন্য খাবারের আয়োজনও ছিল। শসা, গাজর, কলা, আপেল ও তরমুজ সবই মধুবালার খুব পছন্দের খাবার। নিমিষেই সব সাবাড় করে ফেললো সে।
তার সঙ্গী নূর জাহানের মৃত্যুর পর প্রায় এক বছর ধরে একাকীই জীবনযাপন করছিল ১৭ বছর বয়সী এ আফ্রিকান হাতিটি। গতকাল মঙ্গলবার সে আবারও খবরের শিরোনাম হলো। মাধুবালা এখন পাকিস্তানের দ্বিতীয় এবং শেষ হাতি, যাকে চিড়িয়াখানার বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেওয়া হলো। মধুবালার আগে কাভান নামে আরেকটি হাতিকে ২০২০ সালে ইসলামাবাদ থেকে কম্বোডিয়ার একটি অভয়ারণ্যে অবমুক্ত করা হয়।
মধুবালাকে মুক্ত করার পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালনার দায়িত্বের ছিল একটি আন্তর্জাতিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, ফোর পস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ড. আমির খলিল পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডনকে বলেন, "এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। মাধুবালা, আমাদের এবং পাকিস্তানের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। মাধুবালা জানে না সাফারি পার্কে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। সেখানে সে ১৫ বছর পর তার পরিবারের কাছে ফিরে যাবে।"
মধুবালার তত্ত্বাবধায়কই তাকে ভালোবেসে তার নাম দিয়েছিলেন মধু। ২০০৯ সালে একদম শিশু অবস্থায় মধু ও তার দুই বোন সোনু ও মালাইকাকে করাচিতে আনা হয়। পরে তাদের আলাদা করে দেওয়া হয়। মধু ও নূর জাহানকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। আর সোনু ও মালাইকা সেই সাফারি পার্কেই রয়ে যায়।
২০২৩ সালের এপ্রিলে মারা যায় নূর জাহান। তার মৃত্যু এবং মধুর একাকিত্বের কারণেই তাকে আবার সাফারি পার্কে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য মাসের পর মাস প্রস্তুতি নিতে হয়েছে মধুকে। সাফারি পার্কে তার জন্য নতুন অবকাঠামো নির্মাণসহ তার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মধুর মাহুতরা (হাতির তত্ত্বাবধায়ক) জানান, প্রশিক্ষণে সে খুবই সহযোগী প্রকৃতির ছিল।
এ বছরের শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা ঘোষণা দেন যে সাফারি পার্কে যাওয়ার ২৪ মিনিটের যাত্রার জন্য প্রস্তুত মধু।
গতকাল মঙ্গলবার পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো এ ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেদিন অনেক গণমাধ্যম এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্প্রচার করেছিল। ওইদিন সকালে ৮টায় প্রথমে মধুকে একটি আয়তাকার ধাতব বাক্সে স্থানান্তর করা হয়। ধাতববক্সটির চারপাশে অসংখ্য ছোট ছোট ফুটো ছিল এবং ছাদটি ছিল স্ট্রাইপড লোহার দণ্ড দিয়ে ঢাকা।
নিয়মিত প্রশিক্ষণের ফলে প্রক্রিয়াটি সহজ ছিল। কারণ মধু নিজ থেকেই সেই বাক্সে ঢুকে যায়। ড. খলিল বলেন, "সে প্রস্তুত এবং সুস্থ ছিল, কিন্তু সকাল থেকে কিছুটা অস্থির ছিল।" শুরুতে বাক্সে ঢোকানোর পর তাকে অবচেতন করা হয়। বাক্সের নীচ দিয়ে তার একটি শিকলে বাঁধা অস্থির পা দেখা যাচ্ছিল।
এরপর একটি ক্রেন আসে। এটি মধুকে বহন করা বাক্সটি চিড়িয়াখানার ভেতর থেকে ট্রাকের ওপর নিয়ে আসে। সেসময় মনে হচ্ছিল ট্রাকটি মধুর বার বহন করতে পারবে না। এ পুরো প্রক্রিয়াটি চলার সময় বক্সের ভেতর মধু খালি ডাকাডাকি করছিল ও বারবার দেওয়ালে আঘাত করছিল। তবে প্রতিবার ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মধুর মাহুতরা তার কানে নরম সুরে কথা বলতেন। আবার কখনো খাবার ও পানি দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতেন।
এর মধ্যেই মধুকে বহন করার জন্য বহরটি যাত্রা শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। মাহুতরা তার সঙ্গে ট্রাকেই ছিল। আর মধুকে বহন করা বাক্সটি ট্রাকের সঙ্গে ধাতব শিকল দিয়ে বাঁধে দেওয়া হয়। তার পাশেই রাখাছিল- ফল, শাকসবজি ও পানি ভর্তি কার্টন। আর ক্রেনটিও বহরকে অনুসরণ করছিল। তবে এর চালককে বিশেষভাবে প্যাডলে হালকা চাপ দিতে বলা হয়। এর কারণ হিসেবে চিড়িয়াখানার এক কর্মকর্তা বলেন, "ইঞ্জিনের শব্দ মধুকে উত্তেজিত করে তোলে।"
মধুর সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিল ফোর পসের সদস্যরা, চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা, পুলিশ এবং রেসকিউ ১১২২-এর কর্মীরা। প্রথমে বহরটি লিয়ারি এক্সপ্রেসওয়ের দিকে রওনা দেয়, এরপর সোহরাব গথে চলে যায় এবং অবশেষে সাফারি পার্কে পৌঁছায়। মধুর যাত্রার জন্য ওই দিন রাস্তাটি জনসাধারণের জন্য বন্ধ রাখা হয়।
গাড়িগুলো সরাসরি সাফারি পার্কের হাতির বাঙ্কারে চলে যায়। কিন্তু সেদিন আর সোনু ও মালাইকাকে দেখা যায়নি। ড. খলিল এ বিষয়ে বলেন, "আমরা প্রথমে মাধুবালাকে তার শোবার কক্ষে বিশ্রাম নিতে এবং স্বাভাবিক হতে দিতে চাই। পরে, কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিনের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং সেসময়ই সে তার বোনদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারবে।"
মধুকে যেভাবে বাক্সে ঢোকানো হয়েছিল ঠিক সেভাবেই তাকে তার শোবার ঘরে নিয়ে আসা হয়। শুরুতে তাকে বহন করা বাক্সটিকে ক্রেন দিয়ে তুলে তার ঘরের সামনে রাখা হয় ও দরজা খুলে দেওয়া হয়। কিছু সময় তাকে ডাকাডাকি করার পর, মধু থেকে বের হয়ে ঘরে প্রবেশ করে।
সম্প্রতি সাফারি পার্কের হাতির অভয়ারণ্যটি দুই একর থেকে বাড়িয়ে ৫.৫ একর করা হয়েছে। এটিকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তাছাড়া স্টাফদেরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে মধুকে একটি ভাগে রাখা হবে এবং তার বোন সোনু ও মালাইকাকে আরেকটি ভাগে রাখা হবে। তারা একে অপরকে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় তা পর্যবেক্ষণ করবেন স্টাফরা।
ফোর পসের সভাপতি জোসেফ ফাবিগান ডনকে জানিয়েছেন, হাতিরা অত্যন্ত স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এবং সহজে কিছু ভুলে না, তাই তাদের পুনর্মিলনটি সহজ এবং বিশেষ হবে। তিনি বলেন, "হাতিরা পরিবারে থাকতে ভালোবাসে এবং বেশিরভাগ হাতির দলে নারী সদস্য বেশি।"
তিনি আরও আশা প্রকাশ করেছেন যে সাফারি পার্ক মধুবালা এবং অন্য দুটি হাতির জন্য একটি ভাল আশ্রয় হয়ে থাকবে।