এই শীতে হয়ে যাক আচারি আলু আর সর্ষের তেলের ঝাঁজে দারুণ স্বাদের তেহারি!
বনানী ই-ব্লকের 'হাউজ অব তেহারি'তে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। বসতে না বসতেই মেন্যু কার্ড নিয়ে হাজির ওয়েটার। রেস্টুরেন্টের নামই যেহেতু হাউজ অব তেহারি, তাই এটাই বেছে নিলাম। তবে যে সে তেহারি না, একদম সর্ষে তেহারি! অনলাইনে বেশ কয়েকবার পজিটিভ রিভিউ দেখেও সময় মিলছিল না। একে তো পৌষমাস, সূর্যের দেখা পাওয়াই ভাগ্যের বিষয়, আগের সব রেকর্ড মিথ্যা প্রমাণ করে এবার পৌষ যখন দেখিয়ে দিলো শীতের কাঁপুনি। তাই বলে আবার কাজকর্ম তো বন্ধ করে রাখারও জো নেই। ঘর থেকে বাইরে যখন যেতেই হচ্ছে, তখন আর রেস্টুরেন্টে গিয়ে তেহারি খেতে দোষ কী! তাই এই শীতে কাঁপাকাঁপির এক ফাঁকে তিন বন্ধু মিলে সময় বের করে তেহারি ভোজের উদ্দেশ্যে চলে যাওয়া হাউজ অব তেহারিতে।
অর্ডার পর্ব শেষ হওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যেই চলে এসেছিল- সর্ষে তেহারি, রীতিমতো ধোঁয়া উড়ছে। কথায় আছে, আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী। আলু আর মাংসতে ভরপুর সেটা তো দেখাই যাচ্ছিল, তবে খেতে বসে বুঝলাম দর্শন নিয়ে ভাবনা মোটেও ভুল নয়। মুখে দিলে প্রথমেই সর্ষের তেলের একটা ঘ্রাণ নাকে আসবে নির্ঘাত। মধ্য এশিয়ার খাবার তেহারি যে সর্ষের তেল আর বাঙালি রান্নারও একটা যোগসূত্র হয়ে উঠেছে, তা বুঝতে খুব ভোজনরসিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। সঙ্গে হাউজ অব তেহারির সিগনেচার আইটেম আচারি আলু। টক-মিষ্টি স্বাদের এ আচার আলু খেতে খেতে আলুবোখরা না আলু দিয়ে তৈরি এনিয়ে ধন্দে পড়ার সুযোগ কিন্তু ষোলআনা। গরম তেহারির এক লোকমা, সঙ্গে একটুখানি আচারি আলু, সবমিলিয়ে দারুণ একটা ব্যাপার। হাউজ অব তেহারির, তেহারির মেন্যু নিয়ে যে বিষয়টি না বললেই নয় তা হচ্ছে, লোডেড সর্ষে বিফ তেহারি! অর্থাৎ, যে তেহারি আপনি খাচ্ছেন, একই জিনিস তবে মাংসের পরিমাণ আরও বেশি। দামে মাত্র ৩০ টাকা বেশি, তবে তেহারিতে যারা ভরপুর মাংস খোঁজেন– তাদের জন্য এই আইটেমটি নিঃসন্দেহে একদম সোনায় সোহাগা।
হাজির বিরিয়ানি যারা পছন্দ করেন তাদের যে এই তেহারি পছন্দ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাজির বিরিয়ানিতে সাধারণত সর্ষের তেলের একটা ঘ্রাণ আসে। কিন্তু তেলতেলে না বলে এক বসায় খাওয়া যায় অনেকটাই।
আচারি বিফ খিচুড়ি
এ তো গেল তেহারি। হাউজ অব তেহারি'র আচারি খিচুড়িও কোনো অংশে কম নয়। আর তা বলে দিচ্ছিল খিচুড়ির চেহারাই। "ঝাল ঝাল স্বাদের খিচুড়ি মুখে দিতেই বেশ চনমনে একটা ভাব ছড়িয়ে পড়ল পুরো মুখে। একে তো ভুনা খিচুড়ি আর সঙ্গে গরুর মাংসের ছোট ছোট টুকরো। এখানেও সর্ষের তেলের বেশ একটা দারুণ স্বাদ। তবে যে বিষয়টি ভালো লাগার মতো সেটা হচ্ছে, এর ভেতরে থাকা আচার। খেতে খেতে হঠাৎ করে যখন এক টুকরো জলপাই মুখে পড়বে, নিঃসন্দেহে তার রেশ রয়ে যাবে অনেকক্ষণ। তবে এই খিচুড়িতে মাংসের পরিমাণ নেহায়েৎ কম নয়।"
বন্ধুর মুখে খিচুড়ির বর্ণনা সম্পর্কে শুনতে শুনতে লোভ আর সামলানো গেল না, অতঃপর তার পাত থেকেই একটু চেখে দেখা। আর স্বাদ! সে যে রেস্তোরাঁটির সুখ্যাত তেহারির থেকে কোনো অংশেই কম নয়, সে তো বলাই বাহুল্য।
বিয়ে বাড়ির কাচ্চি
হাউজ অব তেহারি মানে তেহারির ঘরে যে কেবল তেহারিই থাকতে হবে তা তো নয়, কাচ্চিও আছে বহাল তবিয়তে। আর যে সে কাচ্চি নয় একদম যেন বিয়ে বাড়ির কাচ্চি, ভেতরে আলু আর মাংস সমপরিমাণে; গণিতের ভাষায় একে বলা যেতে পারে সমানুপাতিক হারে, সবমিলে পুরো পোয়াবারো। তবে এই কাচ্চি খেতে কিন্তু 'দ্য হাইভে' যেতে হবে শুক্রবার। এছাড়া দেখা মিলবে না কাচ্চির। একদম পুরান ঢাকার মতো স্বাদ নাকি কাচ্চির, এমনটিই দাবি হাউজ অব তেহারির।
এখানে দ্য হাইভের কথা একটু বলে রাখা ভালো। বনানীর ই-ব্লকের এই ফুডকোর্টটিতেই অবস্থান হাউজ অব তেহারির। পাঁচটি রেস্তোরাঁর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে 'দ্য হাইভ'।
হাউজ অব তেহারিতে আসা নাজমুল হাসান নামক একজন গ্রাহক বললেন, "আগের থেকেই জানা ছিল কেবল শুক্রবারে পাওয়া যায় এই কাচ্চি, তাই আজকের দিনটি বেছে নেওয়া। কাচ্চির ভেতর মাংস আর আলু প্রায় সমানুপাতে হওয়ায় স্বাদ বেড়ে গেছে বহুগুণে। মনেই হচ্ছে না যে এটা বিয়ে বাড়ির কাচ্চি না। অনেকদিন পর এত ভালো কাচ্চি খেলাম"।
কথায় কথায় আরও জানালেন, প্রথম যে বার এখানে আসি, এদের কাচ্চি খেয়ে এত ভালো লেগেছিল যে এখন প্রায়ই শুক্রবারে চলে আসি। বাচ্চাদেরও খুব পছন্দ এ কাচ্চি। শীত একটু বেশি বলে বাচ্চাদের নিয়ে আসিনি। তবে ওদের জন্য পার্সেল নিয়ে যাব। ওরা মাংসের চেয়েও আলুর আচারটা বেশি পছন্দ করে।"
শাহী মোরগ পোলাও
তেহারি, খিচুড়ি, কাচ্চি সবকিছুর স্বাদ দারুণ। তবে চিকেনপ্রেমীদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। শাহী মোরগ পোলাও যে শাহী ভাব আনে– নিঃসন্দেহে তা জানা গেল হাউজ অব তেহারির রিভিউ সেকশন দেখেই। যুহায়ের বারি নামে একজন লিখেছেন, "তেহারি শেষ হয়ে যাওয়ায় মোরগ পোলাও অর্ডার করেছিলাম, সঙ্গে ছিল আচারি আলু। বিয়ে বাড়ির রোস্ট আর পোলাও একদম! পুরো কবজি ডুবিয়ে খেলাম। খাবারের পরিমাণের কারণেও প্রশংসা না করে পারছি না।"
ফজলে রাব্বি নামে আরেকজন, তার রিভিউতেও জানিয়েছেন, 'এপর্যন্ত যত মোরগ পোলাও খেয়েছি, তার মধ্যে হাউজ অব তেহারির মোরগ পোলাও অন্যতম। আক্ষরিক অর্থেই বেশ শাহী একটা ভাব রয়েছে খাবারটিতে।
হাঁসের মাংসের প্ল্যাটার
শীতে হাঁসের মাংস আর খিচুড়ি, এই দুই নাহলে যাদের জমেই না তাদের কথা ভেবে হাউজ অব তেহারির নতুন সংযোজন, হাঁসের প্ল্যাটার। হাঁস খেতে যারা ভালোবাসেন, তাদের মধ্যে একটি বিষয় প্রচলিত আছে, সেটি হচ্ছে সবার হাতে নাকি হাঁসের মাংস রান্না মজা হয় না। তবে এই কথাটা ভুল প্রমাণ করলো হাউজ অব তেহারির, মাখা মাখা হাঁসভুনার চেহারাই বলে দিচ্ছিল স্বাদ সম্পর্কে।
দাম
রেগুলার সর্ষে বিফ তেহারি এবং আচারি বিফ খিচুড়ি মিলবে ৩২০ টাকায়। আর সর্ষে বিফ তেহারি প্ল্যাটারের একটি মজার বিষয় হচ্ছে, একই তেহারি মিলবে ৩৬০ টাকায়ও। অর্থাৎ, মাংসপ্রেমীদের চাহিদা বুঝে আরও বেশি মাংস ও আলু নিয়ে একটি প্ল্যাটার রেখেছে হাউজ অব তেহারির, লোডেড বিফ তেহারি নামে।
শাহী মোরগ পোলাও ৩৮০, বিয়ে বাড়ির কাচ্চি মিলবে ৫০০ টাকায়। হাঁসের মাংসের প্ল্যাটারটি পাওয়া যাবে ৩ হাজার টাকায়। হাঁস ভুনা, ৪ প্লেট ভুনা খিচুরি, ৪ প্লেট জালি কাবাব, ২ বাটি আচারি আলুর এ প্ল্যাটারটি– শীতকালের স্পেশাল! এক প্ল্যাটারে চারজনের কথা বলা থাকলেও অনায়াসে ৬ জনের হয়ে যাবে বলে জানালেন এর স্বাদ নিতে আসা তন্ময় আহমেদ নামের আরেক ভোজনরসিক। আর স্বাদ? এক কথায় অনবদ্য, এমনটিও জানালেন তিনি।
এছাড়া প্লেন পোলাও, দেশি মুরগির রোস্ট, আচারি আলু, শাহি জালি কাবাব, শাহী ফিরনিও চাইলে আলাদা করে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে এ রেস্তোরাঁয়। প্লেন পোলাও ১২০ টাকা, আচারি আলু ১০০ টাকা, শাহী ফিরনি আর শাহী জালি কাবাবে খরচ পড়বে ৬৫ টাকা।
তেহারির স্বাদ নিতে নিতে কিঞ্চিৎ কৌতূহলবশতই জানতে চাওয়া হাউজ অব তেহারির কর্ণধার সম্পর্কে। জানতে পারলাম, ফারিহা চৌধুরী নামে একজন চালান এ রেস্তোরাঁটি। স্কলাসটিকা থেকে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, কলেজ পার্ক থেকে পাবলিক রিলেশনস, ব্যবসায় প্রশাসন, কর্পোরেট কমিউনিকেশনের ওপর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে দেশে চলে আসেন। তবে কারো হয়ে ৯টা-৫টা চাকরি করতে না চাওয়াই বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে ফারিহার ব্যবসায় আসার কারণ। তাই দেশে ফিরেই ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন ফারিহা। হাউজ অব তেহারি ছাড়াও 'সুগার রাশ কাপ কেককেকারি' নামে আরও একটি পেস্ট্রিশপও রয়েছে তার।
জানা গেল, ২০১২ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষে পুরো এক বছর পেস্ট্রি বানাতে শেখার পেছনে সময় দেন ফারিহা। সেই সময় তিনি নিউইয়র্কের ফ্রেঞ্চ কালিনারি ইনস্টিটিউটে পেস্ট্রি তৈরির ওপর কোর্স করেন। এরপর দেশে ফিরে ২০১৩ সালে সুগার রাশ কাপ কেককেকারি খোলেন।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে করোনাভাইরাস লকডাউনের সময়, প্রথম হাউজ অব তেহারি খোলেন তিনি। তবে তেহারির সঙ্গে তার যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালে। তখন তেহারি অন হুইলস- নামে একটি উদ্যোগ নেন, যদিও শেষপর্যন্ত তিনি থাকেননি সেখানে। এর তিনবছরের পর নতুন করে শুরু করেন হাউজ অব তেহারি। বনানীর ই ব্লকের দ্য হাইভে- মোট ৫ জন মিলে রেস্তোরাঁটি দেন ফারিহা। যেহেতু অনলাইন ডেলিভারির ওপরই বেশি জোর দেয় রেস্তোরাঁটি, তাই রান্নাবান্নার কাজ চলে একই ব্লকেরই অন্য রোডে। এমন সব তথ্য জানালেন হাইভে বসা হাউজ অব তেহারির দায়িত্বরত এক কর্মচারীরা।