তেহারী কি পোলাও নাকি বিরিয়ানী?
প্রথমে প্রশ্ন—তেহারী কি পোলাও নাকি বিরিয়ানী? এর উত্তর খোঁজার সহজ পদ্ধতিটা হচ্ছে এখানে কি পানি বিরিয়ানীর মতো আস্রাবণ করা হয় নাকি পোলাওয়ের মতো শোষণ করা হয়? যেহেতু এখানে আস্রাবণের কোন ব্যাপার নেই তাই তেহারী হচ্ছে এক প্রকারের পোলাও, এটা বিরিয়ানী নয়।
তেহাড়ি > তেহারী > তেহারি–নামটার বিবর্তন নাকি এভাবে হয়েছে, আমি 'তেহারী' লিখতে পছন্দ করি। বাংলা 'হাড়ি' শব্দের সাথে ফার্সী 'তে' উপসর্গ যোগ করে নাকি এই শব্দের উদ্ভব। সত্য/মিথ্যা জানি না, তবে যেহেতু জিনিসটা রান্না করতে তিনটা হাড়ির (চাল, মাংস, আলু) দরকার হয় তাই নামের বিবর্তনটা এভাবে হয়েছে বলে মানা যায়।
এখান থেকে বোঝা যায় এখনকার খুব কম দোকানে বা আয়োজনে সত্যিকারের তেহারী রান্না করা হয়। বেশির ভাগ জায়গায় আলু ছাড়াই রান্না করে সেটাকে তেহারী বলে চালিয়ে দেয়া হয়। পোলাও/বিরিয়ানীতে আলু নিয়ে লোক্জনের এমন অহেতুক কৃপণতা আমাকে ব্যথিত করে।
তেহারীর ইতিহাস ও উৎপত্তি নিয়ে বিশেষ খোঁজখবর করিনি, আমি শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে এটা বোঝার চেষ্টা করেছি। যেহেতু ভাতের সাথে মাংস মিশিয়ে আইটেম তৈরি করার সংস্কৃতি সারা দুনিয়ায় আছে তাই তেহারী দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় আবিষ্কৃত হওয়া সম্ভব। একবার গণচীনের ফুজিয়ান প্রদেশের নিঙদি নামের একটা শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে এক দোকানদার আমাকে দেখে বলেছিলেন তিনি তাঁর সারা জীবনে আমার মতো চেহারার (মানে ভারতবর্ষীয়) কোন মানুষ কখনো দেখেননি।
সেই শহরেই এক সন্ধ্যায় আমি একটা বিশুদ্ধ চীনা খাবারের দোকানে তেহারী খেতে পেয়েছিলাম। চাল, ছোট করে কাটা মাংস, ছোট আলু একসাথে মাখন, পনীর, কাঁচামরিচ, আদা, লবণ, পানি দিয়ে মাখিয়ে পাথরের বোলে করে উনুনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেই তেহারী খেতে অসাধারণ লেগেছিল। জীবনে ভারতবর্ষীয় চেহারার মানুষ না দেখা শহরের স্থানীয় খাবারের দোকানে যদি গরম গরম তেহারী পাওয়া যায় তাহলে তেহারী দুনিয়ার যে কোন দেশে আবিষ্কৃত হওয়া সম্ভব।
তেহারী রান্না করতে যেহেতু আলু লাগে তাই ধরে নেয়া যায় তেহারীর উৎপত্তি ষোড়শ শতকের আগে নয়। অবশ্য এ'কথা খুব জোর দিয়ে বলা যায় না। প্রচুর তুর্কীস্তানী খাবার (তুর্কী খাবার নয়) আছে যেখানে নানা প্রকারের বাদাম আর কিশমিশের মতো নানা প্রকারের শুকানো ফল ব্যবহৃত হয়। সেসব খাবার ভারতবর্ষে বা ইউরোপে যাবার পরে সেখানে বাদাম আর ফলকে আলু বা অন্য সব সবজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তেহারীর ক্ষেত্রে অমন কিছু ঘটা খুবই সম্ভব। আপাতত আলু দিয়ে রান্না করা তেহারীকেই সত্য ও সঠিক বলে ধরে নেয়া যাক।
কালিজিরা, চিনিগুঁড়া ধরনের সুগন্ধি, সরু, ছোট দানার, আতপ চাল দিয়ে তেহারী রান্না করা সঙ্গত। যাদের কাছে বাসমতি চাল ছাড়া পোলাও/বিরিয়ানী পোষায় না তারা তেহারী এড়িয়ে যেতে পারেন। যাদের পক্ষে কালিজিরা, চিনিগুঁড়া ধরনের চাল জোগাড় করা কঠিন তারা অপেক্ষাকৃত ছোট দানার বাসমতি চাল ব্যবহার করতে পারেন।
তেহারীর মাংস দেড়-দুই সেন্টিমিটারের ঘনকাকৃতির টুকরো হলে ভালো। সেই টুকরোতে মাংস-চর্বি-হাড়ের স্তর থাকলে আরও ভালো। অর্থাৎ, চতুষ্পদ প্রাণীর (গরু/মহিষ/ছাগল/ভেড়া) সিনা-পাঁজরের (rib) মাংস হচ্ছে তেহারীর জন্য সবচেয়ে ভালো। এছাড়া সামনের রান (brisket), করলি (shank-shin), চাপ (chuck), থানের (round-rump-loin) মাংস দিয়েও ভালো তেহারী হওয়া সম্ভব। তেহারীর মাংস ছোট হলেও জ্যুসি হওয়া আবশ্যক তাই হাড় এবং চর্বির উপস্থিতি প্রয়োজন।
তেহারীর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত আলু হচ্ছে লটকা/লটকন/ভুবি সাইজের গোল আলু। এই সাইজের আলু আস্ত অথবা ঠিক দুই টুকরো করে দিতে হবে। অমন সাইজের আলু না পাওয়া গেলে এর চেয়ে একটু বড় আলু অমন সাইজে টুকরো করে নিতে হবে। আলু যেহেতু আলাদা রান্না করা হবে তাই আলু একটু শক্ত-পোক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। নতুন, ভসভসে, খুব আঁঠালো অথবা জলেভরা আলু চলবে না। রান্না করার সময় আলু ভেঙে-চুরে একাকার বা ভর্তা বানানো যাবে না।
ঘি, সাদা তেল, সর্ষের তেল যে কোন কিছু দিয়েই তেহারী রান্না করা যায়। প্রত্যেকটা তেল ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ-গন্ধ তৈরি করে। বাজারে সর্ষের তেলের তেহারীর কাটতি বেশি হলেও ঠিকঠাক ঘিয়ের তেহারীর তুলনা হয় না। তবে তেল বা ঘি যাই দিন না কেন তেহারী কখনো তেল চপচপে হতে পারবে না।
তামার ডেকচিতে কাঠের চুলায় তেহারী রান্না করতে পারলে ভালো। না পারলেও অসুবিধা নেই। তেহারীর ঠিকঠাক স্বাদ পেতে বিরিয়ানীর মতো একশ' জনের জন্য রান্না করার দরকার নেই। তবে মোট তেহারীর পরিমাণ দশ কেজি বা তার বেশি হলে স্বাদ খোলতাই হয়।
অন্যসব পোলাও বা বিরিয়ানীর সাপেক্ষে তেহারীতে বেশি মশলা লাগে না। খুব তীক্ষ্ণ স্বাদ বা গন্ধের মশলা এড়িয়ে চলুন। মশলা বেশি দিয়ে তেহারী কালো বানিয়ে ফেললে মশলা টিকে থাকে, আর তেহারী মাঠে মারা যায়। যথারীতি এখানেও হলুদের ব্যবহার পুরোপুরি বর্জনীয়। তেহারীর মাংসে দই/টক দই/দুধ না দেয়া বাঞ্ছনীয়, কারণ তেহারীর মাংসের স্বাদ-গন্ধ বিরিয়ানীর মতো হবে না। মাংস যদি বেশি শক্ত বলে বোধ হয় তাহলে মাংসে অল্প পেঁপে বাটা ব্যবহার করুন। তেহারীতে আলুর মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কাঁচামরিচ (কাঁচালঙ্কা)। বিপুল পরিমাণে কাঁচামরিচ ব্যবহার করতে হবে, তবে সবই আস্ত – চেরা/ফাড়া/টুকরো করা যাবে না।
চাল-মাংস-আলু একসাথে মেশানোর পরে তেহারী দমে দেয়া আবশ্যক। দোকানে আমরা যেমন দেখতে পাই বিশাল একটা হাড়িতে একটু কালচে সাদা পোলাও রান্না করা, তার একপাশে এক গাদা মাংস স্তুপ করে রাখা, পরিবেশনের সময় খাবার স্যালাইন বানানোর মতো করে দুই খাবলা পোলাওয়ের সাথে এক খাবলা মাংস মিশিয়ে তেহারী বানিয়ে দেয়া হয় – এটা একেবারেই তেহারীসুলভ ব্যাপার হলো না। দম থেকে নামানোর পরে তেহারী আর কোন মাখামাখি চলবে না। তবে বেশি ভেজা ভাব কমানোর দরকার হলে মাঝখানে গর্ত করে দেয়া যেতে পারে।
তেহারীর হাড়ি বিরিয়ানীর মতো কাত করে রাখার দরকার নেই কারণ এখানে তেল-ঘিয়ের ব্যবহার কম। তবে তেহারী বিরিয়ানীর মতোই চামচের বদলে ছোট হাফ প্লেট দিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
কাঁচা সালাদ, লেবু, পেঁয়াজ, বা কাঁচামরিচ সহযোগে তেহারী খাওয়ার চর্চা আছে। এগুলো কোনটাই ভুল নয়, তবে লক্ষ রাখতে হবে এগুলোর তোড়ে তেহারীর মূল স্বাদ যেন চাপা না পড়ে যায়। আমার কাছে তেহারীর সাথে বোরহানী বা লাবাং-এর চেয়ে কার্বনেটেড ড্রিংক বেশি ভালো লাগে।
তেহারী এমন একটা খাবার যেটা সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত, মাঝরাত যে কোন সময় খাওয়া যায়। কিন্তু এই খাবারটা কোনো এক কারণে জাতে উঠতে পারেনি। দোকানে দেখবেন ৭০০ টাকা/কেজি গরুর মাংস দিয়ে রান্না করা তেহারীর প্রতি প্লেটের দাম, ৩০০ টাকা/কেজি মুরগীর মাংস দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানীর প্রতি প্লেটের চেয়ে কম।
খেয়াল করলে দেখবেন বিয়ে বা বৌভাতে কখনো তেহারী পরিবেশন করা হয় না। বিশেষ কাউকে নিমন্ত্রণ করলে, বা গুরুত্বপূর্ণ পার্টিতেও তেহারী পরিবেশন করা হয় না। গায়ে হলুদের গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কম বলে সেখানে তেহারী পরিবেশিত হয়। 'হালদি', 'সাঙ্গীত', 'মেহেন্দী নাইট' ইত্যাদি ধরনের অনুষ্ঠানে আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ নিমন্ত্রণ করেনি বলে সেসব অনুষ্ঠানে কী পরিবেশন করা হয় তা জানি না। তেহারী বেশি পরিবেশিত হয় কুলখানি, চেহলাম, মৃত্যুবার্ষিকী, মিলাদ, কাঙ্গালী ভোজে। এতো সুস্বাদু একটা খাবারকে মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে ফেলার কারণটা বুঝতে পারিনি।
একবার গুলশান এলাকার একটা দোকানে তেহারী খেতে বসেছি। দেখি তারা এক প্লেট সাদা ভাত এনে দিলেন যেটার গায়ে অল্প সয়াবিন তেল মাখানো আছে। সেই ভাত নাড়া দিয়ে দেখি তাতে কোন মাংস বা আলু নেই, কাঁচামরিচও নেই। বিস্মিত আমি বললাম, ভাই মাংস কই? তখন একজন আরেকজনকে বললেন, ঐ ভাইয়েরে তেহারীর মাংস দে! এরপর একজন ছোট প্লেটে করে এক টুকরা 'তেহারীর মাংস' নিয়ে আসলেন যেটা আসলে একটা বড় হাড়ের টুকরাতে লেগে থাকা পর্দা, চর্বি, রগ, তরুনাস্থি। তাতে না আছে রস, না আছে স্বাদ।
এটা আসলে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, দেশের বহু জায়গায় তেহারী মানে এই। এমনকি নীলক্ষেতের বিখ্যাত রয়্যাল তেহারীর দোকানে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখতে পাবেন ভাতে মাংস মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। রয়্যাল তেহারী কে কত টাকা প্লেট করে প্রথম খেয়েছেন সেটা দিয়ে তাঁর বয়স এবং নীলক্ষেত অঞ্চলে যাতায়তের প্রাচীনত্ব বোঝা যায়। আমি ১০ টাকা প্লেট করে খাওয়া শুরু করেছি সুতরাং আমার বয়স কত তা বোধগম্য।
এককালে ঢাকার দিলকুশার নান্না, নসর উদ্দিন সরদার লেনের মাখন হাজীর দোকানে ভালো মানের তেহারী পাওয়া যেতো। এখন সোবাহানবাগ, কলাবাগানের 'তেহারী ঘর' বা লালমাটিয়ার 'স্বাদ' ছাড়া ঢাকাতে ঠিকঠাক তেহারী প্রায় পাওয়াই যায় না। অথচ এই শহরে তেহারীর দোকানের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে।
একটু ভেজা ভেজা, কিন্তু গলে যাওয়া নয় আবার শুকনো ঝুর ঝুরে নয় এমন তেহারী যেটাতে সঠিক মানে ও সঠিক পরিমাণে চাল-মাংস-আলু (মাংস : চাল : আলু = ৩ : ২ : ১) দেয়া, যেটা রান্না করা হয়েছে ঠিক নিয়ম মেনে এমন তেহারী মোটামুটি বিরল। বিখ্যাত বাবুর্চ্চী যারা আছেন তাঁদের কেউ তেহারী রান্না করতে চান না। অথচ তাঁরা যখন তেহারী রান্না করেন তখন মনে হয় এর কাছে তাঁদের অন্য পোলাও কিছু না! আমি বিশেষ আয়োজনে মকবুল, ইব্রাহিম, আজিজ সাহেবের মতো এক কালের ভালো বাবুর্চ্চিদের রান্না করা অসাধারণ তেহারী খেতে পেয়েছি।
তেহারী খুব কম আয়োজনে, কম আয়াসে খাওয়া যায় বলে এটি কাজের সময়ে বা বড় জনসমাগমে ভালো খাবার হতে পারে। ঠিক মতো বিপণন করতে পারলে বাংলার তেহারী সারা দুনিয়াতে বিক্রি করা সম্ভব। একটু স্টিকি করলে তেহারী চপস্টিক দিয়েও খাওয়া যাবে। তাতে তেহারী পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাজার পাবার কথা। অনেক কাঁচামরিচ থাকলেও খাবারটি অত ঝাল নয় বলে এটি সারা দুনিয়ায় জনপ্রিয় হবার কথা। বার্গারের দোকানের মতো সারা দুনিয়ায় তেহারী চেইন করা সম্ভব। এসব এখনো হয়নি, তবে কেউ উদ্যোগ নিলেই সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্যগত সমস্যা না থাকলে তেহারী আসলে প্রতিদিন খাওয়া যায় এমন একটি খাবার। আনন্দের সাথে তেহারী খান – এক খাবারেই দৈনিক পুষ্টি চাহিদার অনেকটা মিটে যাবে।
হস্তিনাপুর, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২