শীতকালে গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ায় উদ্বিগ্ন শিল্প উদ্যোক্তারা
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহে কিছুটা উন্নতি হলেও জানুয়ারিতে এ খাতে আবারও সংকট দেখা দিয়েছে।
ফলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে কারখানা চালানোর খরচ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
উদ্যোক্তাদের মতে, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের অধিকাংশ এলাকা এবং মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জসহ অন্যান্য গ্যাস প্রধান শিল্প এলাকায় গ্যাস সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। মানিকগঞ্জের শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ কম থাকায় উদ্যোক্তারা তাদের কারখানা স্থানান্তরের কথা ভাবছেন।
দেশের শিল্পখাতে ব্যবহৃত বেশিরভাগ গ্যাস ব্যবহার করা হয় টেক্সটাইল মিলের স্পিনিং, ডাইং এবং ফিনিশিং ইউনিটে। এছাড়াও, সিরামিক, ইস্পাত, এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানাসহ বেশ কয়েকটি শিল্প রয়েছে দেশে, যা মূলত গ্যাস-প্রধান।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যদি গ্যাস না পাওয়া যায় এবং দাম বাড়তে থাকে, তা হবে শিল্পখাতের জন্য দুঃখজনক ব্যাপার।"
শক্তি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সূত্রের মতে, সাম্প্রতিক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে খুচরা গ্যাসের দামও এই সপ্তাহে প্রায় ১৭ শতাংশ বাড়তে পারে; এমনটি হলে তা গ্রাহকদের জন্য মুদ্রাস্ফীতির নতুন যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়াবে।
দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩,৫০০ এমএমসিএফ গ্যাসের প্রয়োজন; তবে বর্তমানে এর প্রায় এক চতুর্থাংশ ঘাটতি রয়েছে।
গেল বছরের ডিসেম্বরে গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস কর্পোরেশন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হবে। মার্চে গিয়ে আবারও চাহিদা বাড়বে; ওই সময়ে যেন সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে, সেই চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের মতে, শীতকালে ফ্যান ও এয়ার কন্ডিশনার বন্ধ থাকার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা গত বছরের জুন-জুলাই মাসের ১৩,০০০-১৩,৫০০ মেগাওয়াট থেকে কমে ১০,০০০-১০,৫০০ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে।
বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ সময়ে শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বাড়বে বলে আশা করেছিলেন উদ্যোক্তারা। তবে গ্রীষ্ম শুরুর আগেই শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকট উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
শিল্প ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কমেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি সম্প্রতি কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
তবে শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের কয়েক মাসের পরিস্থিতির তুলনায় লোডশেডিং কমেছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের উদ্যোক্তারা জানান, চলতি মাসে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর এলাকায় সোমবার সাড়ে চার ঘণ্টারও বেশি লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে।
রাইজিং গ্রুপের সিস্টার কনসর্ন রাইজিং নিট টেক্সটাইল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু টিবিএসকে বলেন, "মানিকগঞ্জে আমার কারখানায় ১৫ পিএসআই (পাউন্ড প্রতি বর্গ ইঞ্চি) গ্যাসের অনুমোদন রয়েছে, কিন্তু দিনের বেলায় তা শূন্য থাকে। রাতে সর্বোচ্চ ১.৫ পিএসআই পাওয়া যায়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সংযোগ থেকে আমি কিছু ঘাটতি মোকাবেলা করছি, যার জন্য অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।"
"তাছাড়া, বয়লারের জন্য বাষ্প তৈরি করতে আমাদের ডিজেল কিনতে হয়। আগে গ্যাসের বিল আসত মাসে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু এখন ব্যয় বেড়েছে ১ কোটি টাকারও বেশি; এই অতিরিক্ত খরচ উৎপাদন খরচও বাড়িয়ে দিয়েছে।"
"ব্যাংক ঋণ না থাকায় আমি কোনোভাবে বেঁচে আছি। কিন্তু যাদের ব্যাংক ঋণ আছে তারা এ অবস্থায় বাঁচবে না," যোগ করেন তিনি।
তিনি ওই এলাকার শিল্প মালিকদের রক্ষার জন্য বিদ্যুতের রেশনিংয়ের মতো গ্যাসের রেশনের দাবি জানান।
উদ্যোক্তাদের মতে, এলাকায় গ্যাসভিত্তিক প্রায় ৫০টি কারখানা রয়েছে। গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তাদের কেউ কেউ কারখানা অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে শুরু করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের উদ্যোক্তারা জানান, সোমবার বিকেলে মদনপুর এলাকায় গ্যাসের চাপ ছিল শূন্য। সর্বোচ্চ চাপ ছিল ফতুল্লা বিসিক এলাকায় ০.৫ পিএসআই এবং কাঁচপুর বিসিক এলাকায় ১.৫ পিএসআই।
এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম, টিবিএসকে বলেন, "১.৫ পিএসআই চাপে কেবল বয়লার চালানো সম্ভব। ডাইং ইউনিট চালাতে হলে শিল্প মালিকদের বেশি দামে ডিজেল কিনতে হবে।"
তিনি বলেন, ডাইং ও স্পিনিং মিলসহ অন্তত এক হাজার কারখানা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম জানান, দিনের বেলায় তার সাভারের আশুলিয়ার কারখানায় সর্বোচ্চ ২ পিএসআই থাকে গ্যাসের চাপ, যা দিয়ে স্পিনিং সম্ভব হয় না। রাতে চাপ বাড়লে তিনি কারখানা চালাতে পারেন।
এ অবস্থার কারণে দুটি স্পিনিং মিলের একটি বিক্রির কথা ভাবছেন বলে জানান খোরশেদ আলম।
তবে গাজীপুরের মাওনা থেকে ধানুয়া পর্যন্ত এলাকায় সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো বলে জানিয়েছেন সেখানকার শিল্প মালিকরা। কিন্তু ময়মনসিংহের ভালুকায় আবার রয়েছে সংকট।
অন্যদিকে, টেক্সটাইল ছাড়া সিরামিক খাতও ভুগছে তীব্র গ্যাস সংকটে।
মন্নু গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ময়নুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে, একই হারে শ্রমিকের সংখ্যাও কমেছে।
সিএনজি স্টেশনে যেভাবে মজুদ রাখা হয়, সেভাবে দেশের শিল্পখাতেও সিলিন্ডারজাত গ্যাস সংরক্ষণের অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, এটি করা হলে জরুরি পরিস্থিতিতেও উৎপাদন সচল রাখা সম্ভব হবে।
এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
লোকসানের কারণে খেলাপি হওয়ার আশঙ্কায় উদ্যোক্তারা
দেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্প আগামী দুই বছরে ৪ বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগের আশা করছে। তবে একইসঙ্গে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে, লোকসানের কারণে ব্যাংক ঋণ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কাও করছেন উদ্যোক্তারা।
ইসরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিটিএমএর ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, "সুতার দাম কমছে। অর্ডারও কম। এদিকে, আবার বাড়তে চলেছে গ্যাসের দাম।"
"এ অবস্থায় গ্যাস সরবরাহ না হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। কারখানাগুলো লোকসানের মুখে পড়বে। এসব কারণে অনেক উদ্যোক্তাই দেউলিয়া হয়ে যাবেন," যোগ করেন তিনি।