দীর্ঘ গ্যাস সংকটে লোকসান গুনছে শিল্পখাত
দেশের শিল্পখাত প্রায় দুই বছর ধরে দীর্ঘ গ্যাস সংকটে ভুগছে এবং এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মুনাফায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট) মেরামতের পর জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে অক্টোবর মাসে এসে উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
দেশের বড় কিছু প্রতিষ্ঠানসহ অনেকগুলো টেক্সটাইল মিলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে যাওয়ার ফলে সেগুলো বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনায় অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল মিল ইসরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেডে গ্যাসের চাপ প্রায় শূন্যে নেমে আসার কারণে উৎপাদন ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে এসেছে। দৈনিক ১৬০ টন উৎপাদন ক্ষমতা থেকে বর্তমানে এটি মাত্র ৬০ টনে নেমে এসেছে।
ইসরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, "আমার কারখানার জন্য ১৫ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কোয়ার ইঞ্চি) গ্যাসের অনুমোদন থাকলেও, এটি এক বা কখনও শূন্যে [পিক সময়ে] নেমে যায়। রাতে গ্যাসের চাপ কিছুটা বাড়লে উৎপাদন পুনরায় শুরু করতে পারি।"
তিনি বলেন, "আমার দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৬০ টন। কিন্তু গড়ে আমি মাত্র ৬০ টন উৎপাদন করতে পারছি। অর্থাৎ, গ্যাস সংকটের কারণে কারখানার মোট ক্ষমতার মাত্র ৬০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে, আমরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি।"
ঢাকার সাভার ও নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় অবস্থিত ইন্টিমেট স্পিনিং মিলস লিমিটেড ও লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডেও একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে। গতকাল বিকেলে এক কারখানায় গ্যাসের চাপ ছিল মাত্র ১.৫ পিএসআই এবং অন্যটিতে ১ পিএসআই।
লিটল গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, "বিদ্যুৎ যোগ করে প্রতি মাসে মোট উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে।"
তিনি গ্যাস সংকটের প্রকোপ বোঝাতে তার একটি কারখানার আগস্ট মাসের গ্যাস বিলের হিসাবও দেখিয়েছেন।
খোরশেদ বলেন, "প্রতি মাসে আমার দুটি মিল থেকে ১.১ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এখন আমি এই ব্যবসা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছি।"
দুই বছর আগে গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল এবং তৎকালীন সরকার জানিয়েছিল, এ বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ছিল নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু এরপর থেকে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং সাভারসহ চারটি এলাকার আটজন শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মধ্যে সাতজনই চলমান গ্যাস সংকটে ভুগছেন।
শিল্পখাত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৭০০টিরও বেশি গ্যাস-নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে সবগুলো কারখানাই বর্তমানে ক্ষতির মুখে পড়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সংকট মে মাসের শেষে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে একটি এফএসআরইউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরে সরকারি কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন, সিঙ্গাপুরে মেরামতের পর এফএসআরইউ ফিরিয়ে আনার সাথে সাথে জুলাই মাসের মাঝামাঝি গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, অক্টোবর মাসেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহে অন্তত ৩০ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক মো. কামরুজ্জামান খান টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে দৈনিক গ্যাস চাহিদা ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফিট (এমএমসিএফডি)। কিন্তু সরবরাহ মাত্র ২ হাজার ৭০০ এমএমসিএফডি।"
তবে তিনি বলেন, গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে। "আগে আমরা দৈনিক ৫০০ এমএমসিএফডি এলএনজি পেতাম। এখন ৭০০ এমএমসিএফডি পাচ্ছি।"
কামরুজ্জামান আরও জানান, ১৫ অক্টোবরের পর স্পট মার্কেট থেকে ক্রয়কৃত এলএনজি দেশে পৌঁছালে সরবরাহ ৯০০ এমএমসিএফডিতে বৃদ্ধি পাবে।
ব্যাংক ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় উদ্যোক্তারা
ইসরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, "মাসে কোটি কোটি টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে। ব্যাংকে ঋণ আছে এক হাজার কোটি টাকার ওপরে। এই টাকা কীভাবে শোধ করবো?"
নিজের হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, "একটা এক্সিট পলিসি পেলে এই ব্যবসা থেকে চিরতরে বের হয়ে যেতাম।"
নারায়ণগঞ্জ ভিত্তিক গার্মেন্টস কারখানা এমবি নিট ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, "আমার কারখানায় একটি ফিনিশিং ইউনিট রয়েছে এবং আরেকটি কারখানা এমএস ডাইং প্রিন্টিং লিমিটেড নামে পরিচিত। গ্যাস সংকটের কারণে দুটি কারখানায় প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমার সামনে ঋণখেলাপি হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।" তিনি আরও জানান, মার্চ থেকে অনেক গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল কারখানার মালিক ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আজহার খান বলেন, "ব্যাংক থেকে টাকা না পেলে আগামী মাসে কীভাবে কর্মীদের বেতন দেবো, জানি না। কর্মী অসন্তোষ দেখা দেবে কি না, তাও বোঝা যাচ্ছে না।"
তিনি বলেন, "গ্যাস সংকটের কারণে আমার কারখানা এখন লাইফ সাপোর্টে আছে।"