বসের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি না করে যেভাবে মাইনে বাড়াতে বলবেন
কর্মক্ষেত্রে বসের সঙ্গে যতই ভালো খাতির থাকুক না কেন, নিজের মাইনে বাড়ানোর কথা বলতে গিয়ে একটু-আধটু ইতস্তত সবাই করেন। বস বিষয়টা কীভাবে নেবেন, এ নিয়ে ভাবনার অন্ত থাকে না। বস যদি রেগে গিয়ে দুটো কথা শুনিয়ে দেন! এসব এড়িয়ে যেভাবে নিজের বেতন বাড়ানোর কথা বসের কাছে পাড়বেন, সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
প্রথম যৌবনে প্রিয় মানুষকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়াটা যেরকম কঠিন কাজ, প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে মাইনে বাড়ানোর আবেদন করাটাও একই রকম চাপের। এক্ষেত্রে মানুষ সবচেয়ে বড় ভুলটা করেন আজ বলব-কাল বলব করে। আর এ দেরি করার পেছনে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা কাজ করে বলে জানিয়েছেন কর্মক্ষেত্র ও আচরণ নিয়ে একাধিক বইয়ের প্রণেতা ড্যানিয়েল পিংক।
'বসের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কর্মীরা বিশেষ ভরসা রাখেন না, এবং বেতন বাড়ানোর প্রসঙ্গটা নেতিবাচক হবে বলেই তারা বেশি ধরে নেন,' বলেন এ বিশেষজ্ঞ লেখক।
এ প্রসঙ্গ তোলার আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্য বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টি অনুশীলন করার পরামর্শ পিংকের। এক্ষেত্রে এমন বন্ধুকে বেছে নিতে হবে, যিনি কড়া বসের ভূমিকায় দিব্যি অভিনয় করতে পারবেন। এর ফলে বাস্তবে আলাপের সময় বসের কাছ থেকে যেকোনো নেতিবাচক প্রত্যুত্তর শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবেন আপনি।
বেতন বাড়ানোর প্রশ্নে খুব বেশি কী ক্ষতি পারে? সাধারণত, বসের কাছ থেকে যদি নেতিবাচক উত্তর আসে, তাহলে আপনি কর্মক্ষেত্রে আবার আগের স্থিতাবস্থায় ফেরত যাবেন। অন্যদিকে বস যদি একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া দেখান, তাহলে আপনি জেনে যাবেন, এ চাকরিতে আর ভবিষ্যৎ নেই, নতুন চাকরির সন্ধান করতে হবে। বলা যায়, এটাও এক প্রকার উন্নতি।
ড্যানিয়েল পিংক এ প্রসঙ্গে কর্মীদের আরেকটি ভুলের কথা উল্লেখ করেন। 'কর্মীরা বস বা সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি ভাবেন না,' বলেন তিনি। এক্ষেত্রে বড়কর্তারা কীভাবে ভাবছেন, তা বুঝতে হবে বলে জানান তিনি।
বেতনবৃদ্ধি বিষয়ক আলোচনায় আপনি নিজের কাজগুলোর কথা, কর্মী হিসেবে কেমন ছিলেন ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরবেন, তা-ই স্বাভাবিক। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ যা করতে ভুলে যান, তা হলো তারা অফিসের জন্য ভবিষ্যতে নিজেদের কী ধরনের কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে চান, সে বিষয়ে কোনো কিছু বলেন না।
কিন্তু এটি করলে বসের কাছে কর্মীর আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ও সচেতনতাবোধের বিষয়টি প্রকাশ পায়। তাছাড়া আপনার বেতন বাড়ানোর অনুরোধ সচরাচর দুজন বসের মাধ্যমে কার্যকর হয় — আপনার নিজের বস ও তার বস। আর আপনি যখন নিজের কাজ নিয়ে এমন পরিকল্পিত ধারণা প্রদর্শন করেন, তখন আপনার অনুরোধ ওপরমহলে পাঠানো আপনার বসের জন্যও সহজ হয়।
তবে বসের সঙ্গে এ ধরনের আলোচনা সবসময় আপনার কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে এখানে না জড়ানোই উচিত।
মানবীয় আচরণবিদ রবার্ট কিয়ালডিনি আপনার কাজের প্রতি বসের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে আরেকটি উপদেশ দিয়েছেন। তার পরামর্শ, আপনার বস যদি আপনাকে অফিসের কোনো কাজের জন্য ধন্যবাদ দেয়, তাহলে আপনি স্রেফ 'স্বাগতম' বলে থেমে যাবেন না।
বরং আপনাকে বলতে হবে, 'অবশ্যই। কাজটি করতে পেরে আমি খুশি। এখানে একে অপরের জন্য আমরা এটাই তো করি।'
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষ বিরল, অসাধারণ সুযোগ বিষয়ে বেশি আকর্ষণ বোধ করে। তাই আপনি যদি আপনার প্রতিষ্ঠানের একজন অতি-মূল্যবান কর্মী হন, তাহলে আপনার বেতন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আর এর সুযোগ নিতে আপনাকে চিন্তা করতে হবে, আপনি কীভাবে অফিসে অন্যদের চেয়ে আলাদা। যেমন, আপনি হয়তো অফিসের বিভিন্ন বিষয়ে সবচেয়ে কম অভিযোগ করা ব্যক্তি অথবা আপনি কাজে কখনো দেরি করে প্রবেশ করেন না।
ড্যানিয়েল পিংকের মতে, বসেরা তাদের কর্মীদের সাধারণত দুই কাতারে ফেলেন। এক, যারা তাদের জীবনকে সহজ করে তোলে। আর দুই, যারা কঠিন করে তোলে। একজন কর্মী হিসেবে আপনাকে প্রথম কাতারে অবস্থানের চেষ্টা করতে হবে।
বসের সঙ্গে বেতনবৃদ্ধি প্রসঙ্গে কথা বলার আগে বসের খানিকটা প্রশংসা করে নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন রবার্ট কিয়ালডিনি। এ ধরনের আলাপ একজন ম্যানেজারকে ন্যায্য আচরণ করতে প্রেষণা জোগায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আপনি যে পদে কাজ করছেন, আপনার আশেপাশে একই ধরনের কোম্পানিতে সমমানের পদে একই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অন্যরা কী পরিমাণ বেতন পাচ্ছেন, এ বিষয়ে খবর রাখার চেষ্টা করুন। সেক্ষেত্রে আপনার বেতন যদি তাদের চেয়ে কম হয়, তাহলে আপনি সহজেই বসের কাছে আপনার আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবেন।
এক্ষেত্রে আপনি ন্যায্যতার প্রশ্নও তুলতে পারেন। 'অন্যায্য কোনো বিষয়ে সমর্থন জানানো মানুষের পক্ষে কঠিন,' বলেন পিংক।
ইতস্ততবোধ না করে বসের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বেতন বাড়ানোর বিষয়ে আলাপ করুন। কারণ আপনাকে মনে রাখতে হবে, বসদের কাজের একটি অংশ হচ্ছে কর্মীদের কাছ থেকে এ ধরনের আলোচনা শোনা।
জ্যাজমিন রিড নামক একজন ক্যারিয়ার কোচ তার কাজের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, সাধারণত নারী ও অন্তর্মুখী ব্যক্তিদেরকেই তিনি সবচেয়ে কম বেতন বাড়ানোর অনুরোধ করতে দেখেছেন।
'আমার মনে হয়, বেশিরভাগ ব্যবস্থাপক — বেশিরভাগ, সবাই নয় — যদি কোনো জাদুদণ্ড ঘুরিয়ে আপনাকে বেশি অর্থ দিতে পারতেন, তাহলে তারা সেটা করতেন,' রিড বলেন।
নিজের আরেকটি মজার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন রিড। কর্মজীবনের এক পর্যায়ে তিনি বার্ষিক ৪০,০০০ ডলার থেকে ৪৫,০০০ ডলার বেতন পাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার বস ভুলক্রমে ভেবেছিলেন, তিনি ১০,০০০ ডলার বেশি চেয়েছেন। তখন তার বেতন বেড়ে ৫৫,০০০ ডলার তো হয়ই, একইসঙ্গে তার বস এর চেয়ে বেশি বেতন বাড়াতে পারেননি বলে দুঃপ্রকাশও করেছিলেন।
সে অভিজ্ঞতা থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়েছিলেন জ্যাজমিন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বেতন বেশি চাওয়াটা স্বাভাবিক এবং এতে দোষের কিছু নেই।
'দিনশেষে আপনাকে কেউ শুধু শুধু বেশি বেতন দেবে না। এটা একটা খাঁটি সত্য কথা,' তিনি বলেন। 'তাই, সেদিক থেকে দেখতে গেলে, বেশিরভাগ মানুষই কম বেতন পান।'