এ বছর আসন্ন বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর অর্থ কীভাবে পরিশোধ করবে বাংলাদেশ?
গত বছরের মধ্য-মার্চে শতভাগ বিদ্যুতায়ন উদ্যাপন করছিল গোটা দেশ। এই স্মরণীয় অর্জন এসেছে ২০০৯ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে।
কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার জেরে রাশিয়ার তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞা এই অর্জনকে কীভাবে গুঁড়িয়ে দেবে, তা তখন বাংলাদেশের কল্পনাতেও ছিল না।
জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের অর্জন এসেছে আগ্রাসীভাবে তৈরি করা কয়েকশো বিদ্যুৎকেন্দ্রের হাত ধরে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমদানিকৃত জ্বালানি, কয়লা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ব্যবহার করে। কিন্তু এসব জ্বালানির প্রত্যেকটির দামই অনেক বেড়ে গেছে।
তার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার জন্য বারবার নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। নীতি সুদহার বাড়ানোয় বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও ডলারের দাম গেছে বেড়ে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানি সীমিত করে ফেলে, পাশাপাশি পরিকল্পিত লোডশেডিংও শুরু করে। ব্যয়বহুল স্পট মার্কেট (খোলা বাজার) থেকে এলএনজি আমদানিও বন্ধ করে দেয়। গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি পোষাতে বাংলাদেশ ২০১৯ সালে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে। পাশাপাশি স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি কিনত বাংলাদেশ। ওই সময় মাঝেমধ্যেই স্পট মার্কেটে তুলনামূলক কম দামে এলএনজি পাওয়া যেত।
ফলে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাত উভয়ের জন্যই গ্যাস সরবাহ ঘাটতি তীব্র ও নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
বৃহৎ পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও কয়লা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। গেল ডিসেম্বরেই পরীক্ষামূলক উৎপাদনে গিয়েছিল রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র—সেটিও ডলার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) কাছ থেকে সরকার যে বিদ্যুৎ কিনত, তার মূল্য পরিশোধও ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে হঠাৎ করেই ব্যাহত হতে শুরু করে। আগে যেখানে সরকার বিলিংয়ের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আইপিপিগুলোর অর্থ পরিশোধ করে দিত, সেখানে গত বছরের জুন থেকে অর্থপ্রদান বন্ধ রয়েছে।
বকেয়ার পরিমাণ এখন দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি। যদিও সরকার শীঘ্রই বকেয়া পরিশোধ করবে—এ আশায় আইপিপিগুলো নিজস্ব ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।
চলতি বছর মোট ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র ৪ হাজার মেগাওয়াট।
নতুন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎই উৎপাদন করবে কয়লাচালিত রামপাল, বরিশাল ও চট্টগ্রামের বিদ্যুৎকেন্দ্র—এবং ভারতে আদানির গোড্ডা ১,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র।
আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম এখন চড়া থাকায় আদানির বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের (প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা) দাম পড়বে ১৬ টাকার বেশি। আর রামপালের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৫ টাকা বা তার বেশি। এই ব্যয় প্রাথমিক প্রাক্কলনের দ্বিগুণ এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক বেশি।
এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে সরকারকে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে।
বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সব গ্যাসচালিত। এর মধ্যে বড় বিদ্যুৎকেন্দ আছে তিনটি—সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার, রিলায়েন্সের ৭১৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার এবং ইউনিকের ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানোর জন্য গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে সরকারকে হয় এলএনজি আমদানি করতে হবে, নইলে কয়েকটি পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে সেগুলোর গ্যাস এই বড় কেন্দ্রগুলোকে দিতে হবে অথবা এগুলোকে চালানোই যাবে না। শেষ বিকল্প বেছে নিলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হবে সরকারের।
২০০৮ সালের শেষের দিকে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর জন্য একটি আগ্রাসী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা দৃঢ় করার জন্য তিনি—তেল থেকে শুরু করে পারমাণবিক বা কয়লা কিংবা এলএনজি বা নবায়নযোগ্য—প্রাথমিক শক্তির উৎসগুলোতে বৈচিত্র্য আনার করার ওপর জোর দেন। এমনকি বিদ্যুৎ আমদানিও ছিল তার এ পরিকল্পনার অংশ।
কিন্তু সরকার এই উদ্যোগ নেওয়ার সময় ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কোনো আভাস ছিল না, যে যুদ্ধ এলএনজি, তেল, কয়লাসহ সব ধরনের লেনদেনযোগ্য জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সূত্রপাত করেছে।
বাংলাদেশ যদি নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বাড়াত বা কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ বাড়াত, তাহলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। বাংলাদেশ এখন সবুজ উৎস থেকে অন্তত ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত।
কিন্তু গত এক দশকে অফশোর ও অনশোরে তেল ও গ্যাসের জন্য পর্যাপ্ত অনুসন্ধান হয়নি। বাংলাদেশে বেশ ভালো পরিমাণে কয়লা মজুদ আছে—কিন্তু কৃষি ও পরিবেশ রক্ষার জন্য সরকার তার ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছে।
বাপেক্স ও রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রম ছোট পরিসরে কিছু গ্যাস সন্ধান পেয়েছে ও উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যেভাবে বার্ষিক উৎপাদন কমছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এ পরিমাণ গ্যাস যথেষ্ট নয়। বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে যাতে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়, সেজন্য সরকার এই ছোট উদ্যোগগুলো চালিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রায় এক দশক ধরে থমকে আছে। সর্বশেষ বড় প্রস্তাব আসে, যখন ২০০৮ সালের একটি চুক্তির আওতায় মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস বঙ্গোপসাগরের গভীরে সিসমিক জরিপ সম্পন্ন করে বলে যে ৫ থেকে ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কনোকোফিলিপস চুক্তিটি সংশোধন করতে চেয়েছিল। কারণ তাদের যুক্তি ছিল, গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, বিদ্যমান চুক্তি অনুসারে তা পাওয়া যাবে না। সরকার কনোকোফিলিপসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং কোম্পানিটি চলে যায়।
এরপর থেকে সরকার কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও কোনো তেল কোম্পানিকে বাংলাদেশে আসতে রাজি করাতে পারেনি।
সবুজ জ্বালানি খাতে—যা মূলত সৌরশক্তিনির্ভর—এক দশক আগে সরকার ২০২০ সালের মধ্যে সবুজ উৎস থেকে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এখন পর্যন্ত সবুজ উৎস থেকে মাত্র ৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেছে।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ হাজার মেগাওয়াট অনশোর ও অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্যটি আরও আগে নির্ধারণ করা যেত।
আপাতত বাংলাদেশের জন্য একমাত্র উপায় হলো শিল্প ও সেবা খাতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি নিশ্চিত করা। রপ্তানির জন্যও এখন সময় ভালো যাচ্ছে না—তবে আমাদের এখনও ভালো রপ্তানি আছে যা ডলার নিয়ে আসবে।