দস্তইয়েফ্স্কি রুশ থেকে বাংলায়
১
দস্তইয়েফ্স্কি-সম্পর্কিত সমালোচনা সাহিত্যের সিংহভাগ দখল করে আছে তাঁর অপরাধ ও শাস্তি, ইডিয়ট, দানবেরা, কারামাজোভ ভাইয়েরা—এইসব অতিকায় উপন্যাস। এইসব মহীরুহের প্রকট ও প্রকাণ্ড উপস্থিতির কারণে তাঁর খুদে কলেবরের গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলো লতাগুল্মের মতো অনাদরের শিকার হয়েছে। এই ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়া, ইংরেজিতে যা অনুবাদ করা হয়েছে নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড নামে। তাঁর এই একটিমাত্র উপন্যাসিকা পণ্ডিত ও সমালোচকদের মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে ওইসব মহীরুহকে অতিক্রম করে গেছে। জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়া দস্তইয়েফ্স্কির সর্বাধিক আলোচিত রচনা, সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত সাহিত্যকর্ম। পাঠকপ্রিয়তার দিক থেকে এর ব্যাপকতা সম্পর্কে আমি যদিও নিশ্চিত নই, তবু এখানে প্রথিতযশা রুশ সাহিত্য বিশেষজ্ঞ, দস্তইয়েফ্স্কির আমেরিকান জীবনীকার, অধ্যাপক জোসেফ ফ্র্যাংককে উদ্ধৃত করা যায়। তাঁর ভাষায়, 'দস্তইয়েফ্স্কির নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড-এর চেয়ে বেশি পড়া হয়েছে, এমন সাহিত্যকর্ম আধুনিক সাহিত্যে খুবই কম আছে। আমাদের যুগের সংবেদনশীলতার রহস্যময় গভীরতা উন্মোচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবি হিসেবে এত বেশিবার উদ্ধৃত বইয়ের সংখ্যাও খুবই কম।'
আমার দৃষ্টিতে এই বইয়ের সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য হলো, এটা পাঠ করা যায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। দর্শন জগতের কেউ কেউ এটাকে আখ্যায়িত করেছেন পৃথিবীর প্রথম 'অস্তিত্ববাদী উপন্যাস' হিসেবে; এর লেখককে আবিষ্কার করেছেন নিৎশে ও কিয়ের্কেগার্ডের পূর্বসূরি রূপে; মনোবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশের কাছে এটা অত্যন্ত আগ্রহব্যঞ্জক রচনা: বৈজ্ঞানিক ডিসিপ্লিন হিসেবে মনোসমীক্ষণের যাত্রা শুরু হওয়ারও অনেক আগে মানব মনের এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ তাঁদের অনেককে বিস্মিত করেছে;অধিবিদ্যার জগতের অনেকে এতে পেয়েছেন সুগভীর চিন্তার খোরাক: ঐশ্বরিক ইচ্ছার অনিবার্য অমোঘতা বনাম মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের বির্তক; রাজনৈতিক দর্শনের অঙ্গনের একটা অংশের কাছে এই বই বস্তুবাদ-ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিকস্বর্গরাজ্য নির্মাণের 'ইউটোপীয়' স্বপ্নের বিরুদ্ধে এক প্রবল আক্রমণ।
আমার বিবেচনায়, পুশকিন থেকে শুরু করে চেখভ পর্যন্ত উনিশ শতকের রুশ কবি ও কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা বিশ্বজোড়া খ্যাতি, মর্যাদা ও গুরুত্ব বহন করেন, তাঁদের মধ্যে ফিওদর দস্তইয়েফ্স্কি (১৮২১-১৮৮১) সর্বাধিক মাত্রায় রাজনীতিমনস্ক, এবং তলকুঠুরির কড়চা (১৮৬৪) কথাসাহিত্যের মোড়কে তাঁর প্রধান রাজনৈতিক রচনা।
২
দস্তইয়েফ্স্কির এই উপন্যাসিকা লেখার পেছনে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক-দার্শনিক উদ্দেশ্য ছিল; এর একটা বাস্তব প্রেক্ষাপট রয়েছে। তা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
১৮৬৩ সালে পিতেরবুর্গে সাভ্রিমেন্নিক (সমসাময়িক) নামের এক সাময়িক পত্রিকায় দিয়েলাৎ (কী করতে হবে) নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির লেখক নিকোলাই চেরনিশেফ্স্কি (১৮২৮-১৮৮৯) তখন কারারুদ্ধ, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ: তিনি একজন সমাজতন্ত্রী, বিপ্লবের পক্ষে লেখালেখি করেন; তাঁর লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাশিয়ার শিক্ষিত যুবসমাজ গোপনে নানা ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে, ইত্যাদি। এতকাল তিনি নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখে এসেছেন, কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রথম একটি উপন্যাস লিখেছেন। কী করতে হবে নামের সেই উপন্যাসে তিনি রাশিয়ায় একটা সুখি সমাজ কল্পনা করেছেন, যা গড়ে উঠতে পারে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের অনুসরণে। স্পষ্টতই একটা 'ইউটোপিয়ান নভেল'। কিন্তু রাশিয়ার শিক্ষিত সমাজে উপন্যাস ব্যাপক ইতিবাচক আলোড়ন সৃষ্টি করে। জোসেফ ফ্র্যাংকের মতে, উনিশ শতকের রুশ সমাজে যে রুশ উপন্যাসটি সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা তুর্গেনিভের পিতাপুত্র নয়, তলস্তোয়ের যুদ্ধ ও শান্তি নয়, দস্তইয়েফ্স্কির অপরাধ ও শাস্তি নয়; সেই উপন্যাস চেরনিশেফ্স্কির কী করতে হবে। ১৯৬৭ সালে 'এন. জি. চেরনিশেফ্স্কি: আ রাশান ইউটোপিয়া' শিরোনামের এক প্রবন্ধে জোসেফ ফ্র্যাংক আরও লিখেছেন, সম্ভবত একমাত্র আংকল টমস কেবিন বাদে সামাজিক প্রভাবের দিক থেকে কী করতে হবের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে এমন কোনো উপন্যাস সমগ্র আধুনিক সাহিত্যেই নেই। কারণ, চেরনিশেফ্স্কির এই উপন্যাস, জোসেফ ফ্র্যাংকের ভাষায়, 'মার্কসের ক্যাপিটাল-এর চেয়েও অনেক বেশি মাত্রায় আবেগীয় গতিশক্তি সঞ্চার করেছিল, যার পরিণতিতে রুশ বিপ্লব ঘটেছিল'।
চেরনিশেফ্স্কির বিশ্বাস ছিল, মানুষ স্বভাবত ভালো এবং সাধারণভাবে যুক্তিবুদ্ধি মেনে চলে। মানুষকে কোনো উপায়ে তার প্রকৃত মঙ্গল সম্পর্কে সচেতন করে তোলা সম্ভব হলে তারা যুক্তিবুদ্ধি ও বিজ্ঞানের সহায়তায় একটি 'সুন্দর ও ন্যায়ভিত্তিক' সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। সংক্ষেপে এটাই ছিল উনিশ শতকের রাশিয়ায় প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের সারকথা। এই ভাবাদর্শ সেই সময়ের রাশিয়ার শিক্ষিত সমাজের বৃহত্তর অংশকে গ্রাস করেছিল। ১৮৬৩ সালে যখন কী করতে হবে প্রকাশিত হয়, তখন নিকোলাই চেরনিশেফ্স্কি এই ভাবধারার অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক। তিনি রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং স্বয়ং কার্ল মার্কসের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।
এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, চেরনিশেফ্স্কি, বোধগম্য কারণেই, যুবক লেনিনকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিলেন, এবং লেনিন পরবর্তী সময়ে (১৯০১) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বাস্তব কর্মপন্থা নির্ধারণের এক পর্যায়ে চেরনিশেফ্স্কির উপন্যাসটির নাম ধার করেই লিখেছিলেন কী করতে হবে নামের সেই বিখ্যাত রাজনৈতিক প্যামফ্লেট, যা রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টির জন্ম দিয়েছিল।
লক্ষ করার বিষয় হলো, পশ্চিম ইউরোপ, বিশেষত ফ্রান্স থেকে আসা ইউটোপীয় সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রবল ও ব্যাপক প্রভাবে ১৮৪০ দশকের রাশিয়ার শিক্ষিত সমাজে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের স্বপ্ন এমনই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল যে, দস্তইয়েফ্স্কি কঠোর অর্থডক্স খ্রিষ্টীয় পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার পরেও তরুণ বয়সে এই বস্তুবাদী, নিহিলিস্ট, নিরীশ্বরবাদী ভাবাদর্শের প্রভাবের বাইরে থাকতে পারেননি। ভূমিদাস প্রথার বিলোপ এবং জারের স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার সাধনের স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন; পেত্রাশেফ্স্কি সংঘ ও দুরোভ সংঘ নামের দুটো গুপ্ত সংগঠনের পাঠচক্রে তিনিও নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছিলেন। এই 'অপরাধে' অন্য বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁকেও ১৮৪৯ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল, দণ্ড কার্যকর করার জন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, বধ্যমঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাইফেল তাক করা হয়েছিল, একদম শেষ মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে প্রাণভিক্ষা দেওয়া হয়েছিল, চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে সাইবেরিয়ার কারাগারে পাঠানো হয়েছিল, এবং কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষে আরও চার বছর সাইবেরিয়াতেই সামরিক বাহিনীর চাকরি করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
লেখক হিসেবেও দস্তইয়েফ্স্কির যাত্রা শুরু হয়েছিল একই রাজনৈতিক ভাবাদর্শের পক্ষের মানুষদের হাত ধরে। তাঁর প্রথম উপন্যাস বেদনিয়ে লুদি (অভাজন, ১৮৪৬) পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই যে বন্ধুরা পড়েছিলেন, অভিভূত হয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন রাশিয়ায় এক 'নতুন গোগলের আবির্ভাব' ঘটেছে, তাঁরা ছিলেন সেই একই প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অনুসারী। তাঁরা বেদনিয়ে লুদির পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিলেন ১৮৪০ দশকের রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্য সমালোচক ভিস্সারিওন বেলিন্স্কির (১৮১১-১৮৪৮) কাছে; তিনি উপন্যাসটি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন রাশিয়ার প্রথম 'সামাজিক উপন্যাস' জন্ম নিল দস্তইয়েফ্স্কির হাতে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার আরেক পথিকৃৎ বুদ্ধিজীবী আলেকসান্দর গের্ৎসেন (১৮১২-১৮৭০) অভাজনকে আখ্যায়িত করেছিলেন 'সমাজতান্ত্রিক উপন্যাস' বলে।
এই ইতিহাস আমরা জানি: বেলিন্স্কির প্রশংসা, তার ফলে দস্তইয়েফ্স্কির রাতারাতি সাহিত্যিক সেলিব্রিটিতে পরিণত হওয়া; পেত্রাশেফ্স্কি ও দুরোভের গুপ্তসংঘে যাতায়াত, গ্রেফতার, বধ্যভূমি, প্রাণভিক্ষা, সাইবেরিয়া—এগুলো দস্তইয়েফ্স্কির জীবনের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা। কম আলোচনা হয়েছে যে বিষয়ে, তা হলো তাঁর তলকুঠুরির কড়চা একটা 'প্রতিক্রিয়া'; এটা তিনি লিখেছিলেন চেরনিশেফ্স্কির কী করতে হবের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়। ১৮৬৩ সালে পিতেরবুর্গের তথাকথিত প্রগতিশীলদের পত্রিকা সাভ্রিমেন্নিক যখন এই 'ইউটোপিয়ান নভেল' ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে, তখনই দস্তইয়েফ্স্কি পরিকল্পনা করেন যে তিনি এর কঠোর সমালোচনা করে একটা প্রবন্ধ লিখবেন, এবং তা প্রকাশ করবেন নিজের পত্রিকায়। কিন্তু সেই সময় তাঁর নিজের কোনো পত্রিকা ছিল না; তিনি বড় ভাই মিখাইলের সঙ্গে যৌথভাবে ভ্রেমিয়া (সময়) নামে যে পত্রিকা প্রকাশ করতেন, সরকার সেটা বন্ধ করে দিয়েছে; দুই ভাই এপোখা (যুগ) নামে আরেকটি নতুন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটাতে সাহিত্য সমালোচনার একটা বিভাগ খোলা হবে, সেই বিভাগেই ছাপা হবে চেরনিশেফ্স্কির কী করতে হবের কঠোর সমালোচনা করে লেখা সেই প্রবন্ধ। কিন্তু এপোখা প্রকাশের প্রস্তুতি নিতে নিতেই তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে যায়, সমালোচনামূলক প্রবন্ধের পরিবর্তে তিনি লিখতে শুরু করেন একটা 'কাহিনি': জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়া, তলকুঠুরির কড়চা। তিনি এটাকে 'রমান' বা উপন্যাস বলেননি, বলেছেন 'পোভেস্ত', ইংরেজিতে যাকে বলা যায় 'টেল' বা কাহিনি। কিন্তু আমার বিবেচনায় তলকুঠুরির কড়চা সব বিচারেই একটা নভেল বা উপন্যাস, এবং রাশিয়ার প্রথম অ্যান্টি-ইউটোপিয়ান নভেল।
৩
তলকুঠুরির কড়চা লেখার সময় দস্তইয়েফ্স্কির মনে নানামুখী চাপ ও উদ্বেগ ছিল, এবং সম্ভবত তাঁর এই লেখায় তার প্রভাব পড়েছিল। তাঁর অন্যতম রুশ জীবনীকার কনস্তান্তিন মাচুল্স্কি উল্লেখ করেছেন, তিনি এই উপন্যাস লিখেছেন গভীর মর্মপীড়া ও নৈরাশ্যের মধ্যে: স্ত্রীর মৃত্যুশয্যার পাশে বসে। দস্তইয়েফ্স্কির প্রথম স্ত্রী মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা ছিলেন ক্ষয়রোগী, এই মরণব্যাধি ইতিমধ্যে তাঁকে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছে; দস্তইয়েফ্স্কি দেখতে পাচ্ছিলেন, তাঁর চোখের সামনে তাঁর প্রিয়তম মানুষটি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শারিরীক অবস্থা ইতিমধ্যে শোচনীয় হয়ে পড়েছে, তিনি 'দেশলাইয়ের কাঠি'র মতো শীর্ণকায় হয়ে পড়েছেন; সার্বক্ষণিক মৃত্যুচিন্তায় তাঁর স্নায়ুতন্ত্র বিপর্যস্ত। দস্তইয়েফ্স্কির সর্বক্ষণ যন্ত্রণাদায়ক ও ভয়ংকর বিভীষিকায় আক্রান্ত।
এই সময় দস্তইয়েফ্স্কি তাঁর বড় ভাই মিখাইলকে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, সেগুলো পড়লে তাঁর শোচনীয় মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করা যায়। তাঁর এই মানসিক অবস্থা যে তাঁর লেখাকে প্রভাবিত করছিল, সে কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। যেমন, ১৮৬৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে তিনি বড় ভাই মিখাইলকে লেখেন, 'তোমার কাছে লুকাব না, লেখাটা ভালোভাবে এগোচ্ছে না। হঠাৎ আমার নিজেরই লেখাটা ভালো লাগছে না, মনে হচ্ছে পুরো কাহিনিটাই একটা আবর্জনা; না, গল্পটা এখনো তৈরি নয়...।' কিন্তু বড় ভাই তাঁকে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে দস্তইয়েফ্স্কি আবার লিখতে শুরু করেন, তারপর ভাইকে চিঠিতে লেখেন, 'আবার লিখতে বসেছি, ওই গল্পটা নিয়ে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা কাঁধ থেকে নামানোর চেষ্টা করছি...এর সুরটা ভীষণ অদ্ভুত হচ্ছে, তিক্ত সুর, অসভ্য রকমের; পাঠক আহত হতে পারে; তাই কাব্যিকতা দিয়ে সুরটা একটু নরম করা প্রয়োজন...।'
তলকুঠুরির কড়চা লেখার সময় দস্তইয়েফ্স্কি আরও যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন তা আর্থিক: তিনি তাঁর বড়ভাই মিখাইলের সঙ্গে যৌথভাবে ভ্রেমিয়া (সময়) নামে যে সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করতেন, সেটিই ছিল দুই ভাইয়ের জীবিকার প্রধান উৎস। সরকার সেটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তাঁদের চরম আর্থিক সংকট দেখা দেয়। তাঁরা ধারকর্জ করে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন; একটার পর একটা নাম প্রস্তাব করে প্রকাশনার অনুমতি চান, কিন্তু কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতে কালক্ষেপণ করে। অবশেষে ১৮৬৩ সালের একদম শেষে যখন অনুমতি দেয়, ততদিনে সাময়িক পত্রিকাগুলোর গ্রাহক সংগ্রহের মওসুম পেরিয়ে যায়। দস্তইয়েফ্স্কি ভ্রাতৃদ্বয়ের নতুন পরিকল্পিত পত্রিকা এপোখা পর্যাপ্ত সংখ্যক গ্রাহক পায় না, তবু, নিস্প্রভ ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়েই তাঁরা পত্রিকাটি পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু উদ্বোধনী সংখ্যা ১৮৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হওয়ার কথা থাকলেও তা প্রকাশিত হতে হতে মার্চ চলে আসে, ফলে পত্রিকাটির প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা একত্র করে যৌথ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করা হয় মার্চ মাসে। এই সংখ্যাতেই প্রথম ছাপা হয় দুই অংশে বিভক্ত উপন্যাস তলকুঠুরির কড়চার প্রথম অংশ।
কিন্তু জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে প্রথম অংশ লেখার পরতাঁর মানসিক অবস্থা আরও সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠে।মার্চ মাসে তিনি ভাইকে লেখেন, 'আমার সংকটগুলো এখন এমনই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে যে সেগুলোর কথা তুলতেই ইচ্ছে করে না। আমার স্ত্রী মারা যাচ্ছে, আক্ষরিক অর্থেই মারা যাচ্ছে। প্রত্যেকটা দিন আমি তার মৃত্যুর আশঙ্কায় তটস্থ থাকি; তার কষ্ট ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, সেটার প্রভাব পড়ছে আমার মনে...আর লেখালেখি তো যান্ত্রিক কোনো কাজ নয়, তবু আমি লিখে চলেছি...কখনো কখনো মনে হচ্ছে লেখাটা যাচ্ছেতাই রকমের বাজে হবে, তবু আন্তরিকভাবেই লিখে যাচ্ছি; জানি না শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে...আরও ব্যাপার হলো, আমার ভয় হচ্ছে, আমার স্ত্রী শিগগিরই মারা যাবে, তখন এই লেখায় অবশ্যই ছেদ পড়বে...'
এবং মার্চ না পেরোতেই মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা মারা যান। যদিও এই মহিলার সঙ্গে দস্তইয়েফ্স্কির বিয়েটা খুব সুখের ছিল না, তবু তিনি তাঁকে অন্তর থেকে ভালোবাসতেন; তাঁর মৃত্যুতে তিনি ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন। ৯ এপ্রিল তিনি ভাই মিখাইলকে লেখেন, 'আবারও বলছি, ভাই মিশা, আমার অবস্থা এতই সঙ্গীন, পরিস্থিতির চাপে আমি এতই বিপর্যস্ত, এখন আমি এমনই কষ্টকর অবস্থায় আছি যে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিখতে পারছি না, আমার শারিরীক সক্ষমতাও...।'
কিন্তু তাঁর থেমে থাকার উপায় ছিল না, তিনি তলকুঠুরির কড়চার বাকি অংশ লিখে যাচ্ছিলেন। এ পর্যায়ে তিনি ভাইকে লিখেছেন, 'জানি না শেষ পর্যন্ত কী বেরিয়ে আসবে, হয়তো একটা আবর্জনা বেরোবে, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই গল্পটার উপর আস্থাবান। এটা একটা শক্তিশালী জিনিস হবে, অকপট হবে; এটা হবে সত্য। লেখাটা যদি খারাপও হয়, হোক, কিন্তু এটা একটা অভিঘাত সৃষ্টি করবে, আমি জানি। হয়তো-বা লেখাটা খুবই ভালো হবে।'
ওই এপ্রিলেই তিনি তলকুঠুরির কড়চা লেখা শেষ করেন; এই দ্বিতীয় অংশ এপোখার এপ্রিল সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়।
এভাবেই চেরনিশেফ্স্কির কী করতে হবে উপন্যাসের শৈল্পিক উত্তর হিসেবে লেখা হয়েছিল দস্তইয়েফ্স্কির তলকুঠুরির কড়চা। গভীর ট্র্যাজেডি, দুর্বহ মানসিক যন্ত্রণা ও নৈরাশ্য, ভগ্নস্বাস্থ্য, বৈষয়িক সংকট ও ভীষণ তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে দস্তইয়েফ্স্কির হাতে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
৪
তলকুঠুরির কড়চা সম্পর্কে আলোচনার বৈশ্বিক ভাণ্ডার এত বিপুল যে সেখানে নতুন কথা যোগ করা আমার মতো অ্যামেচার দস্তইয়েফ্স্কি-অনুরাগীর পক্ষে সম্ভব নয়। আমি শুধু এই উপন্যাসের সঙ্গে আমার পরিচয়, এটা পড়া এবং অনুবাদ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু কথা পেশ করতে পারি।
১৯৮৭ সালে ১৯ বছর বয়সে আমি যখন সাংবাদিকতা পড়ার জন্য মস্কোর পাত্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বাংলা অনুবাদে অভাজন ও বঞ্চিত-লাঞ্ছিত আর ইংরেজিতে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট ছাড়া দস্তইয়েফ্স্কির আর কোনো লেখা আমার পড়া ছিল না। গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার মূল কোর্স শুরু করার আগে এক বছর রুশ ভাষা শিখতে হয়েছিল; তখন ক্রিলোভের রূপকথার বই থেকে ছোট ছোট কাহিনি পড়তে হয়েছে, পুশকিন ও লেরমন্তভের কবিতা মুখস্থ করতে হয়েছে, আরও কী কী পড়তে হয়েছে সে সব আর এখন মনে পড়ে না। সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের প্রথম বর্ষ থেকে একদম শেষ বর্ষ পর্যন্ত রুশ সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্য আলাদা আলাদা কোর্স হিসেবে পড়তে হয়েছে। এই বাধ্যবাধকতায় যেসব রুশ কবি-লেখকের লেখার সঙ্গে আমাদের কমবেশি পরিচিত হতে হয়েছে তাঁদের একটা তালিকা স্মৃতি থেকে দিতে পারি: গান্চারোভ, পুশকিন, লেরমন্তভ, গোগল, তুর্গেনিভ, দস্তইয়েফ্স্কি, তলস্তোয়, চেখভ, গোর্কি, ব্লক, গুমিলিওভ, মানদেলশ্তাম, মায়াকোফ্স্কি, ইয়েসেনিন, বুনিন, পাস্তেরনাক, আখমাতোভা, পাউস্তোফ্স্কি, ব্রদ্স্কি, রাসপুতিন, সিমোনভ, আইৎমাতোভ, প্রমুখ।
দস্তইয়েফ্স্কির যে বইটি আমাদের ক্লাসে পড়ানো হয়েছে, তা তাঁর প্রথম উপন্যাস অভাজন। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি উপন্যাসের কোনোটিই কেন পড়ানো হয়নি, সে প্রশ্ন তখন আমার তরুণ মনে জাগেনি। এখন বুঝতে পারি, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকদের কাছে দস্তইয়েফ্স্কি ছিলেন অপর পক্ষের লেখক (১৮৬০ দশকে জীবদ্দশায়ও যেমন বিপ্লবপন্থীদের বিরাগভাজন ছিলেন 'প্রতিক্রিয়াশীল' হিসেবে)। আমাদের ক্লাসে অভাজন পড়ানোর কারণ ছিল সম্ভবত এই যে, দস্তইয়েফ্স্কির এই একটা উপন্যাসই প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ভিস্সারিওন বেলিন্স্কির প্রশংসা পেয়েছিল, কারণ এটি গরিব মানুষদের পক্ষের লেখা (উপন্যাসের নামটাই ছিল বেদনিয়ে লুদি, মানে 'গরিব লোকজন'।) সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকদের কাছে বেলিন্স্কি-চেরনিশেফ্স্কির মর্যাদা ছিল পর্বতপ্রমাণ। অবশ্য সে দেশের হাইস্কুলে অপরাধ ও শাস্তি পড়ানো হতো বলে শুনেছিলাম। এর কারণও বোঝা যায়: এই উপন্যাস রাশিয়ার পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা হিসেবেও পাঠ করা যায়। অবশ্য ইনস্টিটিউট-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রুশ সাহিত্য বিভাগে দস্তইয়েফ্স্কির অন্য উপন্যাসগুলোপড়ানো হতো, কারণ তাঁকে বাদ দিয়ে তো রুশ সাহিত্যের পাঠ সম্ভব নয়।
এত কথা বলার কারণ, আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের ছয় বছরের ছাত্রজীবনে কখনো কোথাও জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়ার নাম উচ্চারিত হতে শুনিনি। যদিও তখন গর্বাচভের গ্লাসনস্ত-পিরিস্ত্রোইকা চলছিল, নিষিদ্ধ বইগুলো একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছিল, (যেমন, আনাতোলি রিবাকোভের আরবাতের সন্তানেরা, বুলগাকোভের মাস্তের ও মারগারিতা) তবু, জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়া নিষিদ্ধ বই না হওয়া সত্ত্বেও বিস্মৃত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরেও এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন, ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত, আমার নজরে পড়েনি। এর কারণ কী হতে পারে, তা আমি ভেবে পাই না। প্রশ্ন জাগে, রাশিয়ায় সাহিত্যের পাঠকদের মন ও রুচি কি এমন যে জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়ার বিষয়বস্তুগুলোর প্রতি তারা কোনো আগ্রহই বোধ করে না? ১৮৬০ দশকে উপন্যাসটি যখন প্রকাশিত হয়, তখনও সাধারণ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি; আর সাহিত্য জগতের প্রভাবশালী পক্ষটা তো একে প্রতিক্রিয়াশীল বলে খারিজই করে দিয়েছিল। তবে কি রাশিয়ার সাহিত্য পাঠকদের মন ও রুচি দীর্ঘ ২০০ বছরেও বদলায়নি?
দস্তইয়েফ্স্কির এই উপন্যাসের নাম আমি প্রথম শুনি দ্বিজেন শর্মার মুখে। তখন তিনি প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদক হিসেবে সপরিবারে মস্কো থাকতেন। কী প্রসঙ্গে তিনি বইটার কথা বলেছিলেন, আলোচ্য প্রসঙ্গ কী ছিল, সে সব আজ আর মনে পড়ে না। কিন্তু মনে আছে, বইটা তাঁর বাসায় ছিল না। বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বন্ধুদের কাছে খোঁজ করেও বইটা কারো কাছে পাইনি। এখন মনে হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে খুঁজলে দস্তইয়েফ্স্কির রচনাবলির কোনো এক খণ্ডের মধ্যে নিশ্চয়ই পাওয়া যেত, কিন্তু তা কেন করিনি এবং একসময় কখন বইটার কথা ভুলে গেছি সে কথাও আজ আর মনে পড়ে না। ১৯৯২ সালে যখন শেষ বর্ষের ছাত্র এবং উনিশ শতকের রাশিয়ার সাংবাদিকতা নিয়ে মাস্টার্সের থিসিস লেখার কাজে লেনিন লাইব্রেরিতে যাওয়া-আসা করছিলাম, তখন একদিন কী কৌতূহল থেকে দস্তইয়েফ্স্কি ভ্রাতৃদ্বয়ের পত্রিকা ভ্রেমিয়া (সময়) ও এপোখার (যুগ) মূল কপি হাতে নিয়ে দেখার কথা মাথায় এসেছিল কে জানে, তখনই এপোখা পত্রিকায় প্রথম দেখি জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়া। সেখানেই পড়তে শুরু করি, কিন্তু কয়েক পাতা না পড়তেই মাথা চক্কর দিতে শুরু করে। তারপর আর রুশ ভাষায় এই উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করিনি এবং একসময় এটার কথা পুরোপুরি ভুলে গেছি।
১৯৯৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়ি; মস্কো যাওয়ার আগে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা যেটুকু শেখা হয়েছিল, মস্কোবাসের ছয় বছরে তার প্রায় সবই ভুলে বসে আছি। কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করতে হলে, বিশেষত নিউজ ডেস্ক ও সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতে হলে ইংরেজি ছাড়া চলে না। শুরু হলো আবার নতুন করে ইংরেজি শেখা। এটা করতে গিয়ে শুরু করলাম বারট্রান্ড্র রাসেলের আ হিস্টোরি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি অনুবাদ করা। তারপর এক সময় মনে হলো, এত কষ্ট করে রুশ ভাষা শিখেছি, সেই প্রিয় ভাষাটা কি ভুলে যাব? শুরু করলাম রুশ থেকে তলস্তয়, চেখভ, গোর্কির গল্প অনুবাদ করা, এবং এক পর্যায়ে দস্তইয়েফ্স্কিরক থা মনে পড়ল। কিন্তু জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়া হাতে নেওয়ার সাহস পেলাম না, প্রথমে অনুবাদ করলাম তাঁর বিয়েলি নোচি (সাদা রাত), ২০০০ সালে বাংলা একাডেমি সেটা প্রকাশ করল। তারপর দীর্ঘদিন রুশ থেকে আর তেমন কিছু অনুবাদ করা হয়নি। তারপর একসময় যখন ইন্টারনেটে বেশি সময় কাটানো শুরু হলো, তখন রুশ পত্রপত্রিকা ও ওয়েবসাইটগুলোতে ঢুঁ মারতে লাগলাম। রুশ ভাষা সম্পূর্ণভাবে ভুলে না যাওয়ার একটা উপায় পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে রুশরা তাদের ধ্রুপদি সাহিত্য ডিজিটাইজ করে ইন্টারনেট ভরিয়ে ফেলেছে: তলস্তোয়-দস্তইয়েফ্স্কিসহ প্রায় সবারই রচনাবলি ইন্টারনেটে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।
এইভাবে একসময় দস্তইয়েফ্স্কির জাপিস্কি ইজ পাদপোলিয়ার মূল রুশ ভাষ্যটা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে পড়তে লাগলাম, কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে অনলাইন ডিকশানির সহায়তা নিতে হয়। এক পর্যায়ে মনে হলো, এত কষ্ট করে যখন পড়ছিই, তখন অনুবাদ করে ফেললেই তো একটা কাজ হয়।
শুরুটা এভাবেই। এই উপন্যাস রুশ থেকে অনুবাদ করার সময় কয়েকটা ইংরেজি অনুবাদও ঘেঁটে দেখেছি। বিখ্যাত কন্সট্যান্স গারনেটের অনুবাদ ভালো লাগেনি, ভালো লাগেনি রিচার্ড পিভিয়ার ও লারিসা ভালাখোন্স্কির যৌথ অনুবাদও। মনে হয়েছে, এই উপন্যাসের বয়ানের সুরটা সম্ভবত ইংরেজি ভাষায় ঠিকভাবে ধরা সম্ভব নয়। শুধু দস্তইয়েফ্স্কির এই উপন্যাসের বেলায় নয়, সাধারণভাবে আমার মনে হয় ইংরেজি ভাষার চলনটাই এমন যে এ ভাষায় রুশ থেকে কিছু অনুবাদ করলে তাতে রুশিত্বের লেশমাত্র থাকে না। সে তুলনায় বাংলাকে রুশের অনেক কাছের বলে মনে হয়। তবে এই সুবিধা থাকা সত্ত্বেও রুশ থেকে বাংলায় সাহিত্য অনুবাদের কাজ বেশ চ্যালেঞ্জিং বলে আমার মনে হয়। শংকা হয়, বাংলায় অনূদিত ভাষ্যটিতে এমন আড়ষ্ঠতা থেকে যেতে পারে যে সচেতন পাঠকের মনে হবে অনুবাদক মূল ভাষার দাসত্ব থেকে বেরোতে পারেননি। কিন্তু এও তো সত্য যে রুশ ভাষা আমাদের বাংলা থেকে অতি দূরবর্তী একটা ভাষাগোষ্ঠির সদস্য, এবং পশ্চিম ইউরোপের অন্য বড় ভাষাগুলোর সঙ্গে, বিশেষত ফরাসি ও জার্মান ভাষার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের মিথষ্ক্রিয়ার ফলে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকতে পারে, যা ভাষাটিকে বাংলা থেকে আরও দূরবর্তী করে তোলে; যেমন, ইংরেজির মতো রুশ ভাষায়ও অতি দীর্ঘ বাক্য স্বাভাবিকভাবে লেখা যায়, যার দৈর্ঘ্য অটুট রেখে বাংলায় অনুবাদ করলে বোধগম্যতা রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু আবার মূল বাক্যটি ভেঙে অনেকগুলো বাংলা বাক্য লিখলে মূল লেখকের স্টাইলের কিছুই থাকে না। রুশ ও ইংরেজি উভয় ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের সময় আমি এই সমস্যাটির মুখোমুখি হই।
যা হোক, পাঠক এখন বাংলায় পড়বেন ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবাগে একটা বাড়ির বেসমেন্টের বাসিন্দা এক রুশ লোকের লেখা কতকগুলো কচড়া, যার বয়স চল্লিশ, যে মনে করে দুনিয়ায় তার মতো জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান আর কেউ নেই, কিন্তু যে আসলে একজন ব্যর্থ লোক, হিংসুটে অকর্মণ্য, জঘন্য ছোটলোক, অত্যাচারী, কাপুরুষ, আত্মনিপীড়ক, আত্মপ্রেমিক, স্ববিরোধী, অতি মাত্রায় আত্মসচেতন এবং অসুস্থ রকমের সংবেদনশীল মানুষ, যার বকবকানির কোনো আগামাথা নেই।
কিন্তু তার এই দৃশ্যত এলোমেলো কথাবার্তার নির্যাস আসলে একটা গভীর রাজনৈতিক-দার্শনিক ডিসকোর্স, যা পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী দর্শন ও তার একটা ধারা থেকে উদ্ভূত সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শকে এক বিপজ্জনক ইউটোপিয়া হিসেবে খারিজ করে দিতে চায়।