ভোলা থেকে গ্যাস আনা হবে ব্যয়বহুল, তারপরও স্পট এলএনজির চেয়ে সস্তা
শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহের জন্য দেশের মধ্য-দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ভোলা থেকে উদ্বৃত্ত গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনার পরিকল্পনা করছেন কর্তৃপক্ষ। এতে করে কিছুটা স্বস্তির আশা করতেই পারে অব্যাহত গ্যাস সংকটে থাকা ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের কারখানাগুলো।
তবে শিল্পের জ্বালানি চাহিদার চেয়ে এই সমাধান পরিমাণে কমই হবে, এতে ব্যয়ও হবে বেশি। এই উদ্যোগের সম্ভাব্যতা যাচাইকারী কমিটির প্রস্তাব অনুসারে, গ্রাহকদের এই গ্যাসের দাম ইউনিটপ্রতি ৫১ টাকা দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বাড়িয়ে, চলতি মাস থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, এই মূল্য হবে তার চেয়েও উচ্চ।
ভোলার গ্যাস বেসরকারি জ্বালানি সরবরাহকারীদের মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠানে দেবে রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোবাংলা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক খোলাবাজারে (স্পট মার্কেট) এলএনজির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৩ টাকা হওয়ায়, এটা পেট্রোবাংলার জন্য তুলনামূলকভাবে সস্তাই হবে।
তবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) চেয়ে ব্যয়বহুল হবে ভোলার গ্যাসের দাম। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ যদি প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) গ্যাস ১২ ডলারে আমদানি করে, এতে প্রতি ইউনিট এলএনজি বা এক ঘনমিটারের দাম পড়ে ৩৭ টাকা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ যখন প্রধানত ওমান ও কাতারের সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিগুলো করে, তখন এই দর ছিল ৬-৭ ডলার।
কিন্তু, চাহিদা অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহকারীরাই যথেষ্ট না হওয়ায়, কয়েক মাস পর সম্প্রতি আবার খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা শুরু করেছে বাংলাদেশ।
বুধবারের সভায়, পেট্রোবাংলার প্রস্তাবিত একটি এলএনজি চালান আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর, স্পট এলএনজির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৭ ডলার হলে- এর আমদানি বন্ধ করে বাংলাদেশ, যুদ্ধের আগে এ দর ছিল ৬-১০ ডলার। পরে অবশ্য সর্বোচ্চ ওই পর্যায় থেকে দাম কিছুটা কমে আসে, কিন্তু এখনও যুদ্ধপূর্ব সময়ের চেয়ে উচ্চই রয়েছে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের বরাতে বার্তাসংস্থা ইউএনবি জানিয়েছে, স্পট এলএনজির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ১৯.৭৮ ডলার।
এই অবস্থায়, দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জোর দাবি উঠলে, গত বছরের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে ভোলার গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সংকুচিত (সিএনজি) আকারে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেন।
এরপর দ্বীপ জেলাটিতে উত্তোলনকৃত গ্যাস সংকোচন বা সিএনজিতে রূপান্তর করে এনে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের লক্ষ্যে, প্রায় এক ডজন কোম্পানি পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রস্তাব জমা দেয়।
সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ভোলা থেকে দেশের বিভিন্ন অংশে পাঁচ এমএমসিএফ গ্যাস পরিবহন করা যাবে। আর জুন নাগাদ তা ২৫ এমএমসিএফে উন্নীত করা হবে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরিমাণ যথেষ্ট মনে না হলেও, এতে করেও গ্যাস সংকটে থাকা কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সাময়িক স্বস্তি দেওয়া যাবে। কারণ এই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে ক্যাপটিভ জেনারেটরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. হেলাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভোলার গ্যাসের দাম কীভাবে আরও কম রাখা যায়, সেজন্য পেট্রোবাংলা ও গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো একযোগে কাজ করছে।
ভোলা থেকে গ্যাস পরিবহনে আগ্রহী কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইন্ট্রোকো
ভোলার গ্যাস শিল্প প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে যেসব কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেড। তারা জার্মানির লিন্ডে পিএলসির সাথে যৌথ উদ্যোগে দৈনিক ২৫ এমএমসিএফ গ্যাস সিএনজিতে রুপান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে।
এর পাশাপাশি পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেড ২৩.৩৪ এমএমসিএফ, হাওলাদার বাংলাদেশ লিমিটেড ২৬.৬৭ এমএমসিএফ এবং সুপার গ্যাস লিমিটেড চার এমএমসিএফ গ্যাস সিএনজিতে রুপান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। আরও দুটি প্রতিষ্ঠান ভোলার উদ্বৃত্ত গ্যাস তাদের কারখানায় ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে।
বার্জের মাধ্যমে সিএনজি করা গ্যাস নৌপথে পরিবহনের প্রস্তাব দিয়েছে শুধুমাত্র একটি কোম্পানি।
এদিকে ইন্ট্রাকোর প্রস্তাবে লিন্ডের সাথে যৌথপ্রচেষ্টার কথা উল্লেখ থাকলেও, লিন্ডসের মুখপাত্র সাইকা মাজেদ এ ধরনের কোনো যৌথ উদ্যোগের কথা অস্বীকার করেন। বৃহস্পতিবার তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'না, এ তথ্য সঠিক নয়'।
প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে এবং ভোলার গ্যাসক্ষেত্রগুলো পরিদর্শনের পর সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন কমিটি সুপারিশ করে যে, ক্যাসকেড সিলিন্ডার দিয়ে প্রাথমিকভাবে পাঁচ এমএমসিএফ এবং পরে আরও ২০ এমএমসিএফ গ্যাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা যেতে পারে।
ক্যাসকেড ফিলিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংকুচিত (কমপ্রেসড) গ্যাস ধারক সিলিন্ডারে ভরা হয়। এই পদ্ধতির প্রস্তাব ইন্ট্রাকো-ই দিয়েছিল।
ভোলা, বরিশাল ও খুলনায় গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। কমিটি তাদের থেকে গ্যাস সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছে ইন্ট্রাকো'কে।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, পেট্রোবাংলার নির্ধারিত দরে শিল্প পর্যায়ের গ্যাহকদের থেকে গ্যাস বিল সংগ্রহ করবে। এরপর গ্যাস সংকোচন এবং গ্রাহক প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত তা পরিবহনের খরচসহ অপারেশন চার্জ পরিশোধ করবে।
দর নির্ধারণ
সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন কমিটি, শিল্প পর্যায়ের গ্রাহকের জন্য ভোলা থেকে আনা দাম নির্ধারণে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসের (সিএনজি) বিদ্যমান দর বিবেচনায় নেয়।
বর্তমানে প্রতি প্রতিইউনিট সিএনজির দর হলো ঘনমিটারপ্রতি ৪৩ টাকা, এরমধ্যে ৩৫ টাকা ফিড গ্যাসমূল্যসহ ৮ টাকা পরিচালন ব্যয় যুক্ত রয়েছে।
কিন্তু, ভোলার গ্যাসের ক্ষেত্রে ঘনমিটার প্রতি ৫১.১২ টাকার প্রস্তাব করেছে কমিটি। এরমধ্যে ফিড গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ২৬ টাকা এবং পরিবহন খরচ ১৭.১২ টাকা।
ফিড গ্যাসের জন্য কমিটি বিভিন্ন চার্জ কমিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে উৎপাদন চার্জ, এলএনজি চার্জ, গ্যাস উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের চার্জ। তবে পরিবহনের জন্য যে ১৭.১২ টাকা পরিবহন ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সরাসরি বিতরণকারী পাবে।
'অসম্ভব চিন্তা'?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম ভোলার গ্যাস পরিবহনের পরিকল্পনাকে 'অবাস্তব ও অসম্ভব চিন্তাভাবনার ফসল' বলে আখ্যায়িত করেন।
তিনি বলেন, 'সিলিন্ডারে করে কতটুকু গ্যাস তারা বহন করতে পারবে, আর তার খরচই বা কত পড়বে? এই পরিকল্পনায় শিল্পখাতের সংকট লাঘব হবে না'।
বর্তমানে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৩,৫০০ এমএমসিএফ, সে তুলনায় সরবরাহ মাত্র ২,৬৮২ এমএমসিএফ। ফলে দৈনিক ঘাটতিই রয়েছে প্রায় ৮০০ এমএমসিএফ।
গ্যাসের এই ঘাটতি দেশের বিদ্যুৎ ও শিল্পোৎপাদনে গত গ্রীষ্মে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায়, এসময় গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের কিছু শিল্প কারখানাকে জ্বালানির জন্য ফুয়েল স্টেশনগুলোতে ছুটতে হয়, যাতে তারা উৎপাদনের কার্যাদেশ সম্পন্ন করতে পারে।
জ্বালানি-নির্ভর শিল্পগুলোর ব্যাপক অসন্তোষের ফলেই সরকার ভোলার দুটি গ্যাসক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত গ্যাস ব্যবহারের পরিকল্পনা নেয়। এই দুটি গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন সক্ষমতা ২০০ এমএমসিএফ হলেও, উৎপাদন হয় ৮০ থেকে ৮৫ এমএমসিএফ করে।
একারণে, ভোলা ও শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের আটটি কূপের প্রায় ১২০ এমএমসিএফ বাড়তি সক্ষমতা অব্যবহৃত রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, দরকারি পাইপলাইন ও সঞ্চালক অবকাঠামোর অভাবে জ্বালানি সংকটের ভুক্তভোগী শিল্পাঞ্চলে ভোলার উদ্বৃত্ত গ্যাস আনতে পারছে না সরকার।
ইন্ট্রাকো কতোটা দক্ষ?
শিল্পের অভ্যন্তরীণরা জানান, দৈনিক পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সংকোচনের জন্য কোম্পানিটির ৪৭টি ক্যাসকেড ট্যাঙ্কার এবং প্রায় ১২টি কম্প্রেসর স্টেশন দরকার হবে। আর দৈনিক ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সংকোচনের জন্য দরকার হবে ৬০টি কম্প্রেসর এবং ২৩৮টি ক্যাসকেড ট্যাংকার।
কিন্তু, বর্তমানে কোম্পানিটির মাত্র ১৮-১৯টি রিফুয়েলিং স্টেশন রয়েছে। এছাড়া, গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর কাছে ইন্ট্রাকোর বকেয়া রয়েছে ১০০ কোটি টাকা, যা তাদের ৬০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।
তবে নিজেদের প্রস্তাবে ইন্ট্রাকো গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেড জানিয়েছে যে, কোম্পানির ৩২টি সচল রিফুয়েলিং স্টেশন, চারটি কনভার্সন ইউনিট এবং সিলিন্ডার রি-টেস্টিং ইউনিট রয়েছে। যদিও ইন্ট্রাকোর ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে কোম্পানিটি ৮টি রিফুয়েলিং স্টেশন এবং ১২টি কম্প্রেসর ইউনিট পরিচালনা করছে।
ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেডের কোম্পানি সচিব জিএম সালাহউদ্দিন বলেন, পেট্রোবাংলার কাছ থেকে 'অ্যাওয়ার্ডিং লেটার' পাওয়ার পরে বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে।
'ভ্রাম্যমাণ বোমা-বহনের মতোন'
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা ভোলা থেকে এভাবে গ্যাস পরিবহনের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাকে 'খুবই ঝুঁকিপূর্ণ' এবং 'বিপজ্জনক' বলে মন্তব্য করেছেন।
বুয়েটের অধ্যাপক ম তামিম বলেন, 'উচ্চ চাপে সংকুচিত গ্যাস ক্যাসকেড সিলিন্ডারে বহন করলে তা হবে একেকটা ছোট বোমাকে ভ্রাম্যমান করে তোলার মতোন'।
জ্বালানি বহনের নিরাপত্তার দিকটি দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বিস্ফোরক পরিদপ্তরের।
কিন্তু, এর প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহাম্মদ নায়েব আলী এই পরিকল্পনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।