অবশেষে এলওসি শর্ত শিথিলের জন্য আলোচনায় বসতে রাজি ভারত
বাংলাদেশের জোরালো প্রস্তাবের মুখে প্রথমবারের মতো ভারতীয় ঋণের শর্ত পরিবর্তনে আলোচনায় বসতে সম্মতি জানিয়েছে ভারত।
ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) প্রকল্পে ৭৫% পণ্য ভারত থেকে কেনার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ।
দুই দেশের টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি যৌক্তিকীকরণ করতে ভারত সম্মাতি জানিয়েছে। খুব দ্রুত সময়ে টেকনিক্যাল কমিটির সভা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান।
এছাড়া ভারতীয় ঋণের এলওসি ভিত্তিক গ্রেস পিরিয়ডের পরিবর্তে প্রকল্প ভিত্তিক গ্রেস সুবিধা বিষয়ে আলোচনায় বসতে সম্মতি জানিয়েছে।
গতকাল ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) প্রকল্প নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান।
ইআরডির সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় ইআরডি সচিব শরিফা খান এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রভাত কুমার নিজ নিজ পক্ষের নেতৃত্ব দেন।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালে প্রথম এলওসি চুক্তির পর থেকে পণ্য ও সেবা কেনার প্রস্তাব শিথিল করার প্রস্তাব দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে ৭৫% পণ্য ভারত থেকে আনতে হয়। বাকি ২৫% বাংলাদেশ বা অন্য দেশ থেকে ক্রয়ের সুযোগ থাকে।
এ শর্তের কারণে বাস্তবায়নে গিয়ে জটিলতায় পড়তে হয় বাংলাদেশকে। এ জটিলতায় শুধু পূর্ত কাজের কোনো কোনো প্রকল্পে শর্তটি পরিবর্তন করা হয়। অর্থাৎ ভারত থেকে পণ্য কেনার বাধ্যবাধকতা ৭৫% থেকে কমিয়ে ৬৫% এ নামিয়ে আনা হয়।
পণ্য কেনার এই বাধ্য বাধকতার শর্ত ভারত ছাড়া কোনো দ্বিপাক্তিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বা বহুপাক্তিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রকল্পে নেই। বাস্তবায়ন জটিলতার কারণে বাংলাদেশ সব প্রকল্পে ভারত থেকে পণ্য বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
অর্থাৎ ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে যে কোনো দেশ থেকে পণ্য কেনার বিষয়টি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়েছে।
প্রকল্প ভিত্তিক গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, প্রথমবারের মতো ভারত প্রকল্প ভিত্তিক গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
এলওসি টেকনিক্যাল কমিটির সভায় এ বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
ভারতের সঙ্গে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের শর্ত অনুযায়ী এলওসি প্যাকেজের যে কোনো একটি প্রকল্পের অর্থছাড়ের পরপরই পুরো ঋণের প্রেস পিরিয়ড গণনা শুরু হয়। একটি এলওসি প্যাকেজের অধীনে ১৫টি প্রকল্প থাকতে পারে।
একবার একটি প্রকল্প শুরু হয়ে গেলে গ্রেস পিরিয়ড শুরু হয়, এমনকি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত না হলেও।
প্রথম এলওসি ঋণের মাত্র ৪০% ঋণের ওপর গ্রেস সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। একই অবস্থা দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসির ক্ষেত্রেও।
ইআরডির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের সঙ্গে ৮৬২ মিলিয়ন ডলারের প্রথম এলওসি ঋণের চুক্তি সই হয় ২০১০ সালের ৭ আগষ্ট। প্রথম এলওসির অর্থ ছাড় হয়, ২০১২ সালের ২৯ মার্চ, ভারত থেকে বাস কেনার একটি প্রকল্পের মাধ্যমে।
ফলে প্রথম এলওসি গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা ছিল ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ পর্যন্ত।
আর এ সময়ে কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর রেললাইন পুর্নবাসন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজও শুরু করা যায়নি। প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি, অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতির পেতে বিলম্ব হওয়ায় এ প্রকল্পে গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা পাওয়া যায়নি।
ধীরগতির এ প্রকল্পটি এখনও বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
ঠিকাদারদের জন্য যৌথ উদ্যোগের প্রস্তাব
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, ভারতীয় ঠিকাদারের সঙ্গে বাংলাদেশের ঠিকাদারের যৌথ অংশগ্রহণের সুযোগ রাখার (জয়েন্ট ভেঞ্চার) প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টিও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে।
ইআররির কর্মকর্তারা জানান, এলওসি চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে কেবল ভারতীয় ঠিকাদাররাই অংশ নিতে পারে। এতে দেখা যায় অনেক নির্মাণ কাজের দরপত্রে ভারতীয় ঠিকাদাররা অনেক বেশি দর প্রস্তাব করে।
যেমন খুলনা –মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের 'সিংগনালিং ও টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো' প্যাকেজের ভারতীয় ঠিকাদাররা বেশি দর প্রস্তাব করে।
পরে বাধ্য হয়ে এই প্যাকজটি ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, জয়েন্ট ভেঞ্চারের সুযোগ থাকলে এই জটিলতা অনেকটা কমে যাবে। খরচও কমানো যাবে।
এই জটিলতায় পড়ে বেশ কিছু প্রকল্প ইতোমধ্যে ভারতীয় ঋণের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আরো কিছু প্রকল্পও বাদ যাবে।
এর আগে তালিকায় থাকলেও জামালপুরে শেখ হাসিনার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন এবং যশোর, কক্সবাজার, পাবনা, নোয়াখালীতে ৫০০ শয্যার হাসাপাতাল নির্মাণ প্রকল্পও ভারতীয় ঋণের আওতা থেকে সরিয়ে এসেছিল সরকার।
এছাড়া বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পও ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়ন করবেনা বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
১৩ বছরে এলওসি ঋণের অর্থ ছাড় ১৮.২০%
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, এখনো পর্যন্ত ভারতীয় ৭.৩৬২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ছাড় হয়েছে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের ১৮.২%।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় ঋণের অর্থছাড় বেড়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) অর্থছাড় হয়েছে ১৭২.৮৬ মিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৪২ মিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় হয়েছিল।
প্রথম এলওসিতে ৮৬২ মিলিয়ন ডলারের জন্য চুক্তি সই হয়েছিল ২০১০ সালের আগস্টে।
দ্বিতীয় এলওসির ঋণ চুক্তি হয় ২০১৬ সালের ৯ মার্চ। এই এলওসি ভারত ঋণ দিচ্ছে ২ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের তৃতীয় এলওসি হয় ২০১৭ সালের মার্চে ।