যেভাবে আইডিয়াশূন্য হয়ে পড়ছে গুগল
মাইক্রোসফট এখন পর্যন্ত তাদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন বিং-এ কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু তা-তে আখেরে বিশেষ লাভ হয়নি, খুব বেশি মানুষ কখনোই এ সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহারে আগ্রহ দেখায়নি।
বর্তমানে আরও বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিংয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন চ্যাটবট যুক্ত করেছে মাইক্রোসফট। কোম্পানিটির প্রত্যাশা এবার হয়তো গুগল সার্চ ছেড়ে ব্যবহারকারীরা বিংয়ের দিকে ঝুঁকবেন।
মাইক্রোসফটের এ পদক্ষেপের কারণ অনুধাবন করা কঠিন নয়। কোম্পানিটি বিংকে জনপ্রিয় করতে সব ধরনের চেষ্টা করেছে, আর প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু গুগল কেন এর সবধরনের সেবায় চ্যাটবট সংযুক্ত করে মাইক্রোসফটের অনুকরণ করতে চাইছে, তা অনুমান করা দুরূহ।
তবে গুগলের এ সিদ্ধান্তের কারণ বুঝতে সহায়তা করতে পারে কোম্পানিটির ইতিহাস। অতীতে গুগলেরও অনেক ভুল সিদ্ধান্তের নজির রয়েছে।
২০১০ সালে চীনে জিমেইল হ্যাকিংয়ের জ্বালায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে দেশটি থেকে বেরিয়ে আসে গুগল। চীনের কম্যুউনিস্ট পার্টির সঙ্গে চার বছর ধরে সার্চ ফলাফল সেন্সর করা নিয়ে কাজ করেছিল গুগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, গুগলের হ্যাকিংয়ের শিকারের বিষয়ে ওই সরকারের মৌনসম্মতি ছিল।
১৯৯৮ সালে চীনে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করেছিল ইন্টারনেট জায়ান্ট ইয়াহু। সে বছরই গুগলের জন্ম হয়। ২০০৬ সালে চীনের বাজারে প্রবেশ করে গুগল। এরপর অনেক নাটকীয়তার পর প্রতিযোগিতায় গুগলের কাছে হেরে যায় ইয়াহু।
গুগল কেন চীনে এর সার্চ ফলাফলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, ২০০৬ সালে তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন গুগলের একজন প্রতিষ্ঠাতা বোর্ড সদস্য। তার যুক্তি ছিল, ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করতে এমনটা করেছিল গুগল।
কিন্তু সত্যি কথা হলো, গুগল সবসময় অবিশ্বাস্যরকম অনিশ্চয়তা বোধ করত, এখনো করে। প্রযুক্তি জগতের এ জায়ান্টটি প্রযুক্তি দুনিয়ার মূলস্রোত থেকে দূরে সরে যাওয়ার নিরন্তর আশঙ্কায় থাকে।
ফেসবুক উন্মুক্ত হওয়ার পর গুগল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দুনিয়ায় পা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ এটি ভয় পেয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহারকারীদেরকে সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করা থেকে বিমুখ করবে। চীন থেকে বেরিয়ে আসার এক বছর পর গুগল প্লাস তৈরি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।
নিজেদের এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরির পর গুগল তার প্রোডাক্ট ম্যানেজার ও প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিয়েছিল গুগলের সবধরনের প্রকল্পে গুগল প্লাসকে পুরোপুরি একীভূত করে দিতে। কর্মীরা এ কাজটি কতটুকু করতে পারত তার ওপর নির্ভর করতে শুরু করল তাদের বোনাস, বেতনবৃদ্ধি, কাজের মূল্যায়ন ইত্যাদি।
কিন্তু গুগল এসব বোকা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এত সিদ্ধহস্ত কেন? ধারণা করি, কোম্পানিটির এসব উৎকণ্ঠা এটির নিজেকে একটি 'আইডিয়া ফ্যাক্টরি' হিসেবে কল্পনা করা ও প্রকৃত ব্যবসার বাস্তবতার মাঝখান থেকে জন্ম নিয়েছে। প্রায় ২৫ বছরের ইতিহাসে গুগল দেড়খানা সফল পণ্য তৈরি করতে পেরেছে: এক সময়ের শ্রেষ্ঠ এক সার্চ ইঞ্জিন ও হটমেইলের চমৎকার একটি ক্লোন।
এর বাইরে গুগল নিজে থেকে আর যা কিছু তৈরি করেছে, সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সেটা যেমন গুগল প্লাসের জন্য সত্য, তেমনি সার্বিকভাবে ব্যর্থ পণ্যের 'গুগল গোরস্তান'-এর ক্ষেত্রেও এ কথা সর্বৈব সত্য।
গুগলের সফল পণ্যগুলোর প্রায় সবগুলোই অধিগ্রহণ করা। এ তালিকায় আছে কোম্পানিটির মোবাইল প্রযুক্তি, বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি, ভিডিও সেবা, ডকুমেন্ট-কোলাবোরেশন টুল, ক্লাউড সেবা, সার্ভার-ম্যানেজমেন্ট টুল ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রেই এসব অধিগ্রহণ করা পণ্যকে নিজেদের তৈরি ব্যর্থ পণ্যের স্থলাভিষিক্ত করেছে ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের এ কোম্পানিটি।
আর সব মনোপলি ঘরানার কোম্পানির মতো গুগলও এখন পণ্য তৈরি করার চেয়ে পণ্য ক্রয় করার কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড়ে হেরে যাচ্ছে গুগল। প্রতিষ্ঠানটিতে এ নিয়ে সবাই সতর্ক হয়ে উঠেছে। নিষ্ঠুর, অপ্রয়োজনীয় একটি গণছাঁটাইয়ের পর যেসব কর্মীরা এখনো টিকে আছেন, তাদেরকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে গুগল সার্চের সঙ্গে চ্যাটবট যুক্ত করতে।
সেই পুরোন ধারা: গুগলের একটি মনোপলিস্টিক প্রতিযোগী ব্যবসায়ের অনিশ্চিত একটি পথে পা বাড়িয়েছে — শেষবার এটা ছিল ইয়াহু ও চীন; এবার তার স্থানে রয়েছে মাইক্রোসফট ও চ্যাটজিপিটি — আর এতেই অস্থির হয়ে পড়েছে গুগল। গুগলের নেতৃত্ব চায় এর কর্মীরা সবসময় প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর চালের পেছনে ছুটুক।
আমরা জানি এ সিনেমার গল্প কীভাবে শেষ হবে। গুগল ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা আরও খারাপ হবে। সার্চ ইঞ্জিনে কিছু অনুসন্ধানের পতমুখী মান আরও খারাপের দিকে যাবে। আর অনুসন্ধানকারী, বিজ্ঞাপনদাতা ও কর্মীদের চেয়ে মূল্য বেশি দেওয়া হবে কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডারদের।
সমস্যাটা এ নয় যে, সার্চের ক্ষেত্রে চ্যাটবট অপ্রাসঙ্গিক, বরং উল্টো। কিন্তু সমস্যা হলো, স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেখা উৎপাদনকারী এসব চ্যাটবট স্প্যামের বন্যা সৃষ্টি করবে, এমনকি ইচ্ছেমতো মিথ্যাও ছড়াবে। গুগলের লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ক বিবৃতিতে লেখা আছে, এটি বিশ্বের তথ্যকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে বৈশ্বিকভাবে প্রবেশযোগ্য ও উপকারী করে তুলতে চায়।
গুগলের উচিত ছিল এমন কোনো টুল তৈরি করা যেটি কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার তথ্য ও স্প্যামের ফ্যাক্টচেক করে সেগুলো থেকে ভুয়া তথ্য ছড়ানো আটকাবে। গুগল চাইলে এর মেশিন-লার্নিং গবেষণা বিভাগকে পুনর্গঠন করতে পারত।
কিন্তু গুগল এসবের কিছুই করেনি, আর করবেও না। দিকভ্রান্ত ও আইডিয়ার সংকটে ভোগা গুগল এর প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোর কাজ তাড়িয়ে বেড়াবে আর সেটাকে 'উদ্ভাবন' বলে প্রচার করবে।