স্বল্প সুদের ক্ষুদ্র ঋণে বদলে গেছে যশোরের অনেক নারীর জীবন
১৯৯৭ সালে যশোর চৌগাছা উপজেলার পাতিবিলা গ্রামের রিক্সা চালক আজগর আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় রীনা বেগমের। আবাদযোগ্য জমিহীন পরিবারে তিন সন্তান নিয়ে দিনে দুইবেলা খাবার যোগাতে কষ্ট হতো রীনা-আজগর দম্পতির।
২০১০ সালে আহ্ছানিয়া মিশনের ডাম (ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন) ফাউন্ডেশন থেকে স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে পেয়ারা চাষের মাধ্যমে ভাগ্য বদলানো শুরু হয় রীনার। মাত্র ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করে, এক দশকের ব্যবধানে রীনা এখন স্বাবলম্বী। বাড়ির আঙিনার ছোট্ট বাগান ছাড়িয়ে এখন ৩-৪ বিঘা পেয়ারার বাগান, গরু-ছাগল-হাস-মুরগীর পাল রীনা বেগমের।
রীনা বেগম বলেন, "অভাবের সংসার কাটিয়ে এখন আমি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার সম্পদের মালিক।"
নিজের সফলতার গল্পে তিনি জানান, "ডাম ফাউন্ডেশন থেকে প্রথমে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেই, সেই টাকা দিয়ে বাড়ির পাশে সামান্য একটু জমিতে পোয়ারার চাষ করে আস্তে আস্তে সংসারের অভাব দূর করতে থাকি। ধীরে ধীরে ঋণ শোধ করে নতুন জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ বাড়াতে থাকি। বর্তমানে ১১০ শতক জমিতে পেয়ারা চাষ করছি। বাগানে এখন নিজের দুই ছেলে স্বামী ছাড়াও ৩ জন কর্মচারী কাজ করেন।"
আয় দিয়ে তিনি ইতোমধ্যে কিনেছেন ১০ শতক জমি, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা। বর্তমানে ব্যবসায়ে তার রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মূলধন। এছাড়া, বাড়িতে ১২ টি ছাগল, ২টি গরুসহ রয়েছে হাস-মুরগির খামার।
রীনার পাশাপাশি তার গ্রামের অন্তত ৩০ জন নারী ঋণ নিয়ে পেয়ারা ও ড্রাগন ফল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে জানান তিনি।
তেমনি একজন একই গ্রামের বাসিন্দা নাজমা বেগম। ২০০৮ সালে আহ্ছানিয়া মিশনের ঋণের ১০ হাজার টাকা দিয়ে পেয়ারা ও ড্রাগন ফলের চাষ করে আজ ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার সম্পদের মালিক তিনি। গড়েছেন দালান বাড়ি, আড়াই বিঘা জমিও কিনেছে আয় দিয়ে।
নাজমা বেগম টিবিএসকে বলেন, "আমি এখন বছরে ১৩ থেকে ১৫ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বাজারে বিক্রি করি, এভাবে চাষাবাদ চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বছরে আমার বিক্রি দাঁড়াবে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা।"
রীনা ও নাজমা বেগমের মতো জেসমিন বেগমও আহ্ছানিয়া মিশনের ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন। তিনিও গ্রামের কৃষি জমিতে ভুট্টা চাষ করে বছরে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা আয় করেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "২০০৮ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ভুট্টা চাষ করে আজ আমার ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার সম্পদ হয়েছে। এখন আমি স্বাবলম্বী।"
আহ্ছানিয়া মিশন বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। উপমহাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং প্রখ্যাত সূফী সাধক হযরত খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) ১৯৫৮ সালে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও আত্বক জীবন উন্নয়নে নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। প্রতিষ্ঠানটির অনেকগুলো মিশনের মধ্যে রয়েছে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ 'ডাম ফাউন্ডেশন ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট' (ডিএফইডি)।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে, এ পর্যন্ত ৩৪,৪৯০,৮৯৭,০০০ টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১,১১৬,৬৮৫ জন মানুষের মধ্যে। গত বছর (২০২১-২২ অর্থবছর) ঋণ দেওয়া হয়েছে ১৪৬,৬৮৫ জনকে। প্রতিষ্ঠানটির চলতি বছরের (২০২২-২৩ অর্থবছর) লক্ষ্যমাত্রা ২১০,০০০ জনকে ঋণ দেওয়া।
২০১০ সালে রীনা বেগমকে ঋণ দেন যশোর চৌগাছা উপজেলার ডিএফইডির শাখা ব্যবস্থাপক জামাল উদ্দীন। তিনি বলেন, "রীনা বেগম যখন ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন, তখন তার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল; কোনো মতে দিনাতিপাত করতেন। তিনি যখন আমাদের কাছে ঋণের জন্য আসেন, তখন তিনি ৩০ হাজার টাকার ঋণ প্রস্তাব করেন। কিন্ত তার পরিবারের অভাব-অনটন দেখে আমরা মাত্র ১০ হাজার টাকা ঋণ দেই।"
"বর্তমানে রীনা বেগম এই এলাকায় একজন অনুকরণীয় সফল উদ্যোক্তা। তারা দেখাদেখি নাজমা ও জেসমিনসহ অনেক নারীর পরিবার আজ স্বাবলম্বী," যোগ করেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা সরকারের এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা কখনো পেয়েছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে রীনা বেগম বলেন, "এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। যদি সরকারি সামান্যও সহযোগিতা পাই, তাহলে আগামী ৮-১০ বছরের মধ্যে আমার চাষাবাদ ৭-৮ গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি।"