হিন্ডেনবার্গের আদানি রিপোর্ট প্রকাশের পর ভারতীয় ট্রাক চালক-মালিকরা, ঈশ্বর তাকে পাঠিয়েছেন
আদানির কারখানায় সিমেন্ট পরিবহনকারী ট্রাক মালিক ও চালকদের জন্য স্রষ্টাপ্রেরিত আশীর্বাদ হয়ে এসেছে হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন। ট্রাক মালিক ও চালকরা বলছেন, এ প্রতিবেদন তাদের জীবিকা বাঁচাতে সাহায্য করেছে। খবর রয়টার্স-এর।
ভারতের হিমাচল প্রদেশের প্রায় ৭ হাজার ট্রাক মালিক ও চালক কয়েক সপ্তাহ ধরে আদানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে আসছেন। ফ্রেইট চার্জ নিয়ে বিবাদের জেরে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর আদানি গ্রুপ তাদের দুটি সিমেন্ট কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
আদানির দাবি ছিল, সিমেন্ট পরিবহনের জন্য যে ভাড়া দিতে হয়, সেটি তাদের জন্য লাভজনক নয়। এ কারণে তারা পরিবহন ভাড়া অর্ধেক কমাতে চেয়েছিল।
তবে হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বেকায়দায় পড়ে যাওয়া গৌতম আদানির গ্রুপটি সোমবার বলে, তারা ফ্রেইট চার্জ ১০ থেকে ১২ শতাংশ কমিয়ে 'সৌহার্দ্যের সঙ্গে সমস্যার সমাধান' করেছে। আদানির সঙ্গে আলাপের পর একে নিজেদের বিজয় অভিহিত করে ইউনিয়ন নেতারা রাস্তায় নেমে উল্লাস করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানির বিরুদ্ধে শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ তোলার চার সপ্তাহ পর ট্রাক মালিক-চালকদের সঙ্গে এই বিবাদ নিষ্পত্তি হলো গ্রুপটির। যদিও হিন্ডেনবার্গের অভিযোগকে গ্রুপটি ভিত্তিহীন বলেছে।
গত ২৪ জানুয়ারি হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই আদানির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে পতন শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ১৪০ বিলিয়ন ডলারের বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
টানা সম্পদ হারানোর জেরে শীর্ষ ধনীদের তালিকায়ও গৌতম আদানির ব্যাপক পতন হয়েছে। ফলে একসময় বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ব্যক্তি এখন ২৫ ধনীতম ব্যক্তির তালিকায়ও আর নেই। ফোর্বস ও ব্লুমবার্গের বিলিয়নেয়ারদের তালিকা অনুসারে, বুধবার আদানির মোট সম্পত্তি প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। ফোর্বস ও ব্লুমবার্গের তালিকায় গৌতম আদানি যথাক্রমে ২৬তম এবং ২৯তম শীর্ষ ধনীর স্থানে আছেন এখন।
ট্রাক মালিক-চালকদের এ বিজয় অবশ্য আদানি সাম্রাজ্যে তেমন কোনো প্রভাবই ফেলতে পারবে না। তবে এটি দারিদ্র্যপীড়িত হিমাচলের ট্রাক চালক ও মালিকদের জন্য বড় বিজয়।
বিক্ষোভকারী চালক-মালিকদের অন্যতম নেতা রাম কৃষ্ণ শর্মা বলেন, হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন 'ভারতের সবচেয়ে ব্যবসাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এটি ট্রাক মালিক-চালকদের সঙ্ঘবদ্ধ করতে ও রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ে সাহায্য করেছে।'
প্রথম কয়েক সপ্তাহ আদানির পক্ষের আলোচকরা ট্রাক চালক-মালিকদের দাবি মানতেই রাজি ছিলেন না। এ কারণেই অনেক ট্রাক চালক-মালিক মনে করছেন, হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন তাদের জন্য স্রষ্টার পাঠানো উপহার হয়ে এসেছে।
উল্লেখ্য, প্রতিবেদনটি প্রকাশের একদিন আগেই বহু ট্রাক চালক-মালিক একটি মন্দিরে গিয়ে পূজা দিয়েছিলেন বিবাদ নিষ্পত্তির আশায়।
হিমাচলের সিদ্ধান্ত নিতে হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন কোনো ভূমিকা রেখেছে কি না—রয়টার্সের পক্ষ থেকে এ প্রশ্ন করা হলেও আদানি গ্রুপ উত্তর দেয়নি।
আদানি সিমেন্টস এক বিবৃতিতে, 'সৌহার্দ্যের সঙ্গে সমস্যার সমাধান' হওয়ায় ইউনিয়ন, হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রীসহ সব স্টেকহোল্ডারের প্রতি 'কৃতজ্ঞতা' প্রকাশ করেছে।
আদানির দরকষাকষি সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র অবশ্য রয়টার্সকে জানিয়েছে, হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনের পর গ্রুপটি চাপে ছিল। ট্রাক মাইল-চালকদের সঙ্গে সমস্যার সুরাহা হওয়ায় আদানি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে।
হিমাচলের ক্ষমতায় আছে মোদির প্রতিপক্ষ দল কংগ্রেস। হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই কংগ্রেস বারবার বলে আসছে, বছরের পর বছর ধরে আদানিকে অন্যায়ভা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছেন মোদি।
ওই সূত্র আরও বলে, এই পদক্ষেপ আদানিকে এ-ও ইঙ্গিত দিতে সাহায্য করবে যে, মোদির প্রতিপক্ষের শাসনাধীন রাজ্যের বাণিজ্যিক সমস্যার সমাধানও গ্রুপটি করতে পারে।
গত বছর ১০.৫ বিলিয়ন ডলার চুক্তিতে এসিসি ও আম্বুজা সিমেন্টস অধিগ্রহণ করে নেয় আদানি। এর মাধ্যমে আদানি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারী হয়ে ওঠে।
ট্রাক চালক-মালিকরা অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছেন দাবি করে গত ডিসেম্বরে গ্রুপটি হিমাচলে গাগাল ও দারলাঘাট গ্রামের কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়।
আদানি গ্রুপ প্রতি টন সিমেন্ট পরিবহনের জন্য প্রতি কিলোমিটারে ১১ রুপি থেকে কমিয়ে ৬ রুপি ফ্রেইট চার্জ দিতে চেয়েছিল। এ থেকেই দুই পক্ষের বিবাদের সূত্রপাত।
ট্রাক মালিক-চালকরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে আদানির পক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকেন। পরে এসব গ্রুপে হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনও শেয়ার করতে থাকেন। এর ফলে আদানির প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম আরও দ্রুত পড়তে থাকে।
প্রথমে আদানি গ্রুপ ট্রাক মালিক-চালকদের বিক্ষোভে পাত্তা না দিলেও হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের পরই তাদের সঙ্গে রফায় আসে। প্রতি কিলোমিটারে প্রতি টনের পরিবহন চার্জ ১১ রুপি থেকে কমিয়ে ৯.৩–১০.৫৮ রুপি করা হলেও ট্রাক চালক-মালিকরা অন্তত নিজেদের কাজ বাঁচানোর স্বস্তিতে আছেন।
বিক্ষোভকারীদের নেতা বান্টু শুক্লা বলেন, 'আদানির কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমতে দেখা পর আমাদের মনে হয়েছিল, দেবতারা আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন ছিল আশীর্বাদ, যা আমাদের ব্যবসা বাঁচিয়েছে।'