গ্রামের মানুষ ঝক্কিমুক্ত ঋণের দিকে ঝোঁকায় বেড়েছে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ
- ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৪০ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা
- ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ঋণ বিতরণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি
- ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি হয় ২৭ শতাংশ
- এক বছরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে নতুন ২২২ প্রতিষ্ঠান
মহামারির অভিঘাতে টানা দুই বছর বিপর্যস্ত থাকার পর বাংলাদেশের ছোট গ্রামীণ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন গত বছরের শেষদিক থেকে। এতে বাড়তে থাকে, পারিবারিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্র ওয়ার্কশপ, কৃষি-ভিত্তিক উদ্যোগ, পশু খামার, মৎস চাষ ও থ্রি হুইলার যান ইত্যাদির জন্য ক্ষুদ্র ঋণের চাহিদা।
এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে, তার অভিঘাত পুরো বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতিকে চড়া করে। বাংলাদেশেও ছড়ায় যার আঘাত। এই মূল্যস্ফীতির চাপেও অনেকে জীবনধারণের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
২০২১-২২ অর্থবছরে মাইক্রো ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মতো লক্ষ্যণীয় অর্জন তাদের।
অন্যদিকে, গ্রাহকদের বাড়তি চাহিদা মেটাতে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) গত ১৪ মাসে ২২২টি নতুন প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে।
নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষটির তথ্যমতে, এমআরএ নিবন্ধনপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২১-২২ অর্থবছরে এক লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি বিতরণ করেছে – যা ২০২০-২১ অর্থবছরের এক লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার চেয়েও বেশি।
তথ্যউপাত্ত বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও ঋণ বিতরণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রয়েছে, এসময়ে বিতরণ হয়েছে প্রায় এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
এমআরএ-র তথ্যমতে, নতুনভাবে অনুমোদন পাওয়া ক্ষুদ্রঋণ দাতাদের অধিকাংশ ইতোমধ্যেই তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। এদিকে কিছু সূত্র জানাচ্ছে, গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠায় – ভোগ্যপণ্য খাতের দেশীয় জায়ান্ট প্রাণ-আরএফএল এর মতো সংস্থাও সম্প্রতি মাইক্রো-ক্রেডিট লাইসেন্স নিয়েছে।
মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ বলেন, ছোট ছোট উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী, কৃষকরা ঋণ নিয়ে মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, এতে ক্ষুদ্র ঋণের বিতরণ বেড়েছে।
'আবার এখনও দেশের উপকূলীয়, হাওড় ও চরাঞ্চলের অনেক মানুষের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা পৌঁছায়নি। বিগত কয়েক বছরে গ্রামীণ এলাকায় নতুন নতুন কিছু ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে, যেখানে ঋণের প্রয়োজনীয়তা আছে। এসব বিবেচনায়, নতুন করে কিছু প্রতিষ্ঠানকে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে'- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
ফসিউল্লাহ জানান, যেসব প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক অনুমোদন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে, তাদের মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান এক বছরের কম সময়ে চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারা কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন খাতে (ঋণ বিতরণে) বিশেষ দক্ষতা ও পারদর্শীতা দেখিয়েছে বলেও যোগ করেন তিনি।
ব্যাংকের অনাগ্রহের সুবিধা পাচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ দাতারা
সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যক্তিরা জানান, করোনা মহামারির অর্থনৈতিক অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অনেক ব্যবসা ও ছোট ছোট ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। গত বছরের শেষদিক থেকে তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
সরকার কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের জন্য প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করলেও ব্যাংকগুলো ওই তহবিল থেকে ঋণ বিতরণে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। যেকারণে ছোট উদ্যোগগুলো বাড়তি সুদ দিয়ে হলেও ক্ষুদ্রঋণ দাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছে। অন্যদিকে, মহামারির সময় কাজ হারিয়ে অনেক মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। ওইসব জনগোষ্ঠীও জীবনধারণের জন্য ঋণ নিচ্ছেন। বিতরণের তথ্যে দেখা যায়, ছোট ব্যবসা, গবাদি পশু পালন, মৎস চাষ এবং থ্রি হুইলার ও মোটর সাইকেল কেনা খাতে ঋণ গেছে বেশি।
ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বিভাগের প্রধান অমিত কান্তি সরকার বলেন, 'করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ চাহিদা অনেক কমে যায়। ছোট ছোট উদ্যোক্তা বা গ্রাহকরা দূর্যোগে টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। নতুন বিনিয়োগের ঝুঁকি নেননি। যেকারণে ওই সময় ঋণ বিতরণে নেগেটিভ গ্রোথ হয়'।
'এখন যখন তারা ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, তখন তাদের পুঁজির চাহিদা দেখা দিয়েছে। ফলে ক্ষুদ্রঋণের চাহিদাও বেড়েছে। এই সময়ে ছোট ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি ঋণের চাহিদা দেখা গেছে। পাশাপাশি কৃষি, মৎস চাষ খাতেও ঋণের চাহিদা বেড়েছে। গত বছর ব্র্যাকের ঋণ বিতরণে প্রায় ৩০শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে' বলে তিনি টিবিএসকে জানান।
গত বছর প্রায় তিন কোটি মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ দাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে, বেশিরভাগ অর্থই গেছে ছোট প্রতিষ্ঠানে। শীর্ষ ঋণদাতাদের মধ্যে আছে- ব্র্যাক, আশা, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, সাজেদা ফাউন্ডেশন।
এমআরএ-র লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংক, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে থাকে। গত বছরে এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ বিতরণ বেড়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের ১৯ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার চেয়ে বেশি। এসময়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিতরণ করেছে ৯ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।
পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন করে থাকে। তাদের তথ্যমতে, পিকেএসএফ এর সহযোগী সংস্থাগুলো একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে।
পিকেএসএফ চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের সুবাদে মানুষের মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। পল্লী এলাকার মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
তার মতে, উপকূল, হাওড়, কোনো কোনো চরাঞ্চল ও পাহাড়ে ব্যাংকগুলোর সেবা সেভাবে বিস্তৃত হয়নি। ফলে নতুন ক্ষুদ্রঋণ দাতা প্রতিষ্ঠানের সামনে সম্ভাবনাময় অনেক এলাকা, সম্প্রদায় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী রয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা উল্লেখ করেন যে, আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলে লালফিতার দৌরাত্ম্য ও আমলাতান্ত্রিক হয়রানির কারণেই ক্ষুদ্রঋণের এই স্ফীতি বেড়েছে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ছোট উদ্যোক্তারা ব্যাংকের জটিল ঋণ প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়তে চান না। ফলে ছোটখাট ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ বেশি সুদে হলেও মাইক্রো ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পছন্দ করেন'।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি মিলিয়ে মোট ৬১টি ব্যাংক প্রায় ১১ হাজার শাখা নিয়ে কাজ করছে।
মূল্যস্ফীতিও বাড়াচ্ছে ক্ষুদ্রঋণের চাহিদা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেখা দেওয়া মূল্যস্ফীতির চাপ গ্রামীণ পরিবারগুলো– বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর পড়েছে। দরিদ্রদের অনেকেই জীবনধারণের জন্য ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন।
গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বা ৯.৫২ শতাংশ, এতে প্রান্তিক মানুষই বিপন্ন হয় বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিও পণ্যদ্রব্যের দামকে আরো চড়া করেছে। বিশ্ববাজারে দাম কমার পরেও স্থানীয় বাজারে দুই অঙ্কে বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা সহসাই নিয়ন্ত্রণযোগ্য অবস্থায় নামার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
মানুষ সঞ্চয় ভাঙিয়ে চলতে বাধ্য হওয়ায়, ব্যাংকে আমানতও হ্রাস পেয়েছে।
সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেই হয়তো মানুষ ক্ষুদ্রঋণের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে, তবে এবিষয়ে তাদের কোনো গবেষণা নেই বলেও জানান তিনি।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায়– সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সরকারকে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসায় আগ্রহী প্রাণ
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটর (এমআরএ) ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সনদ দিতে আবেদন চায়। এতে সাড়া দিয়ে সারাদেশ থেকে ১,১৪০ প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। জানুয়ারি পর্যন্ত ২২২ প্রতিষ্ঠানকে সাময়িক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
সূত্রগুলো জানায়, 'এগ্রি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় কৃষিপণ্য ব্যবসার জায়ান্ট প্রাণ-আরএফএল। তবে এই প্রতিষ্ঠান কবে নাগাদ, দেশের কোন অঞ্চলে কার্যক্রম শুরু করবে– তা জানাতে রাজি হয়নি প্রাণ গ্রুপ।
এছাড়া, এসবিকে ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়েছেন মাইক্রোসফট বাংলাদেশের সাবেক সিইও সোনিয়া বশির কবির।
চূড়ান্ত লাইসেন্স পেতে হলে সাময়িক সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে ঋণ বিতরণের স্থিতি এক কোটি টাকা এবং এক হাজার জন সদস্য অর্জন করতে হবে। বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া ৭৩৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।