সংকর জাতের ভেড়া যেভাবে পরবর্তী ‘অর্থকরী প্রাণী’ হতে পারে
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় বাড়িঘর হারান অরুণ মণ্ডল ও স্ত্রী বিপুলা। ওই বিপর্যয়ের পর তারা আশ্রয় নেন খুলনার দাকোপ উপজেলার গুনারী গ্রামে। অরুণের পেশা ছিল শিবসা নদী থেকে মাছ ও চিংড়ি ধরা।
এরপর পেরিয়ে গেল দশ বছর। ততদিনে অরুণ ও বিপুলার বড় ছেলে ননী গোপাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। তবু অরুণকে মাছ ধরার কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। কারণ তার দ্বিতীয় ছেলে অর্ধেন্দু তখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে।
কিন্তু ২০১৯ সালে একদিন অতিরিক্ত চাপে সংসারের ঘানি টেনে চলা অরুণের ব্রেন স্ট্রোক হলো। আংশিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। আইলাও অরুণের পরিবারে এত বড় আঘাত হয়ে আসেনি। তবে ক্লান্ত-শ্রান্ত বিপুলা হাল ছাড়লেন না। ছোট্ট একখণ্ড পতিত জমিতে সবজি চাষ শুরু করলেন তিনি। এছাড়া এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছোট্ট একটা গবাদিপশুর খামারও করেছিলেন তারা। সেই খামারের গরুর দুধও বিক্রি করতে থাকলেন বিপুলা।
কিন্তু পরের বছরই এল করোনা মহামারির আঘাত। ধস নামল সবজি ও দুধের বাজারে। সংসারের খরচ চালাতে দুটো মাদি ভেড়া রেখে সব গরু বিক্রি করে দিলেন বিপুলা।
২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর বিপুলা হিড বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) থেকে সহজ শর্তে ৬ হাজার টাকা ঋণ নিলেন। সেই টাকায় কিনলেন দেশি জাতের দুটি ভেড়া। ওই ঋণ স্কিমে তাকে বিনামূল্যে ৮ হাজার টাকা দামের একটি ভারতীয় জাতের প্রাপ্তবয়স্ক সংকর পুরুষ ভেড়াও দেওয়া হয়।
২০২২ সালের শেষ নাগাদ সংকর জাতের ভেড়াসহ বিপুলার খামারে ভেড়ার সংখ্যা ৫টি থেকে বেড়ে ১৭টিতে দাঁড়ায়। জানুয়ারিতে তিনি দাকোপের মাংসের বাজারে ছয়টি ভেড়ার শাবক বিক্রি করেন।
বিপুলা মণ্ডল বলেন, 'আমাদের টাকাপয়সার টানাটানি আস্তে আস্তে কমছে। আমি এনজিওর ঋণ শোধ করে দিয়েছি। কয়েকটা ভেড়া গর্ভবতী, শিগগিরই নতুন বাচ্চা দেবে। এই খামার আরও বড় হবে।'
আইলার আরেক শিকার লক্ষ্মণ বাইন, মণ্ডল পরিবারেরই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। লক্ষ্মণ গত বছর বাজারে দুটি দেশি ভেড়ার বাচ্চা বিক্রি করেন, প্রতিটির জন্য দাম পান ৫ হাজার টাকা।
বিপুলার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে লক্ষ্মণও এনজিও থেকে একই ঋণ নেন। এখন একটি সংকর ভেড়াসহ মোট পাঁচটি ভেড়া আছে তার। লক্ষ্মণ বলেন, 'আশা করছি প্রতিটা সংকর জাতের ভেড়া ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারব।'
লক্ষ্মণ মৌসুমী কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এলাকায় আমন ধান কাটা শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি দিনমজুরের কাজের সন্ধানে সাময়িকভাবে গোপালগঞ্জে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন।
তিনি বলেন, 'ভেড়ার খামারটা বড় হলে আমাকে কাজের জন্য অন্য এলাকায় যেতে হবে না।'
সম্ভাবনা
খুলনা বিভাগের দক্ষিণাঞ্চলে দেশি জাতের ভেড়া পালন হয় প্রচুর। বিশেষ করে ভারত সীমান্তসংলগ্ন মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় ভেড়ার সংকরায়ন বেশি দেখা যায়। এ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ২০১৭ সালের জুনে দাকোপে ৪ বিঘা জমির ওপর ১০০-ভেড়া রাখার সক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলে।
প্রথমে হিড বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করা হয়। পাইলট প্রকল্পটিতে সাফল্য পাওয়ার পর এখন দাকোপের ১৭৮টি ছোট খামারে ভেড়ার সংকরায়ন চলছে। আগামী কয়েক মাসে আরও ৬৪টি খামার চালু হবে।
প্রজনন কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন আল ইমরান। তিনি জানান, একটি প্রাপ্তবয়স্ক সংকর ভেড়া থেকে ৩০-৩৫ কেজি মাংস পাওয়া যায়। অন্যদিকে একই বয়সি দেশি ভেড়া থেকে পাওয়া যায় মাত্র ১০-১৫ কেজি মাংস।
গত কয়েক বছর ধরে দাকোপের আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ভেড়ার মাংসের চাহিদা বাড়ছে। দাকোপের কসাই মিজানুর রহমান জানান, এক বছর আগে তিনি প্রতি কেজি ভেড়ার মাংস বিক্রি করতেন ৭০০ টাকায়। এখন একই পরিমাণ মাংস বিক্রি করেন ৮৫০ টাকায়।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি মিজান বলেন, 'গত সপ্তাহে ছয়টা ভেড়া আর একটা ছাগলের মাংস বিক্রি করেছি।'
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলীয় অঞ্চলে দেশি জাতের ভেড়া উৎপাদনের সম্ভাবনা এবং সমস্যার ওপর ২০১৯ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভেড়া পালন শুরু করার পর অধিকাংশ ভেড়া খামারির (৯৪ শতাংশের বেশি) আয় বেড়েছে।
ওই গবেষণার মূল লেখক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক সরদার সফিকুল ইসলাম বলেন, সংকরায়ন বাংলাদেশের গবাদিপশুর খামার ও দুগ্ধ শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তিনি বলেন, 'একইভাবে ভেড়ার সংকরায়নও ইতিবাচক ফল আনতে পারে।'
পিকেএসএফের 'পাথওয়েজ টু প্রসপারিটি ফর এক্সট্রিমলি পুওর পিপল'-এর প্রকল্প পরিচালক শরীফ আহমেদ চৌধুরী গরু ও ছাগলের পর ভেড়াকে অন্যতম 'অর্থকরী প্রাণী' অভিহিত করে বলেন, 'স্থানীয় ভোক্তারা খাসির মাংস পছন্দ করলেও, ভেড়ার মাংসের একটা বড় রপ্তানি বাজার আছে।'
বিদেশি ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরসংলগ্ন উপকূলীয় বাজার থেকে ভেড়ার মাংস কেনেন। এই ব্যবসা এখনও স্বীকৃতি পায়নি উল্লেখ করে শরীফ বলেন, 'আমরা যদি গুণমান ও স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে মাংস প্রক্রিয়াজাত করে এই বাণিজ্যকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি, তাহলে খামারিরা আরও ভালো দাম পাবেন।'
কার্বন ফুটপ্রিন্ট কম
লবণাক্ত এলাকায় গরু পালন কতটা ব্যয়বহুল, তা খুব ভালো করেই জানেন ৫৫ বছর বয়সি কৃষক নিগম আনন্দ হালদার।
নিগমের তিন বিঘা জমি আছে। মাত্র এক দশক আগেও সেখানে তিনি ধান চাষ করতেন। বছরে ৫০ মণ ধান ঘরে তুলতেন এক ফসলি জমি থেকে। কিন্তু লোনা পানি ঢুকে জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় তিনি ধান চাষ ছেড়ে দেন। নিগম এখন জমিটি ইজারা দিয়ে দিয়েছেন, সেখান থেকে ৪৫ হাজার টাকা পান।
কিন্তু এতে তার খুব একটা লাভ হয় না। নিগম বলেন, '২০ হাজার টাকায় আমি ছয় মাসের পশুখাদ্য কিনেছি। চারটা গরু আর একটা বাছুরের খাবার কিনতেই ইজারার অর্ধেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।'
গরু লবণাক্ত পানি পান করে না। তাই নিগমকে এদের জন্য পানীয় জল সংগ্রহ করতে হয়। বিনিয়োগ করলেও গরুগুলো আকারে তেমন বাড়েনি।
সংকর গরু পালার চেষ্টা করেননি কেন? এ প্রশ্নের জবাবে নিগম পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'হাইব্রিড গরুর জন্য পর্যাপ্ত খাবার-পানির ব্যবস্থা কোত্থেকে করব?'
লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমিতে ঘাস জন্মে কম। অন্যদিকে এক ফসলি ধান চাষের ফলে গবাদিপশুর খাদ্যও (ধানের খড়) ঠিকমতো পাওয়া যায় না।
পিকেএসএফ কর্মকর্তাদের দাবি, উপকূলীয় অঞ্চলে গরুর চেয়ে ছাগল-ভেড়া পালন বেশি লাভজনক।
'তবে ছাগল খাবারের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। অন্যদিকে ভেড়া ময়লা সাফাইকারী প্রাণীর মতো খায়। সবুজ ঘাস, খড়, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট—মোদ্দা কথা, যা পায়, তা-ই খায় ভেড়া। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এরা গরুর চেয়ে কম খাবার খায়,' জানালেন আল ইমরান।
ভেড়ার খাদ্যাভ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণায়নের-সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। প্রাণীকুল খাবার খায় এবং শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেন নিঃসরণ করে।
অধ্যাপক সফিকুল বলেন, 'একটি প্রাণী যত কম সেলুলোজ [খড়ের প্রধান উপাদান] গ্রহণ করবে, ততই কম গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করবে। এদিক থেকে একটা ভেড়ার কার্বন ফুটপ্রিন্ট একটা গরুর চেয়ে অনেক কম।'
২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিএসএমআরএসটি ইউনিভার্সিটি, গোপালগঞ্জের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে 'অ্যান এস্টিমেশন অভ গ্রিনহাউস গ্যাস এমিশন ফ্রম লাইভস্টক ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি গবেষণা করেন। ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১৮ সালে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি মিলিয়ে দেশের গবাদিপশুরা মোট যে পরিমাণ গ্রিনহাউস নিঃসরণ করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কম গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করেছে ভেড়া।
চ্যালেঞ্জ
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) ২০২১-২২ অর্থবছরের গণনায় দেখা গেছে, সারা দেশে ভেড়ার সংখ্যা ৩৭.৫২ লাখ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ভেড়ার সংখ্যা ছিল ২৮.৭৭ লাখ।
তিনটি উপকূলীয় জেলাসহ মোট ১০টি জেলা নিয়ে গঠিত খুলনা বিভাগে অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় দুই লাখ ভেড়া রয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. এবিএম জাকির হোসেন অবশ্য বলেন, 'অনেক উদ্যোগের পরও উপকূলীয় জেলাগুলোতে ভেড়ার সংখ্যা আশানুরূপ বাড়েনি।' সংকরায়ন নিয়ে ব্যাপক গবেষণার ওপরও জোর দেন জাকির।
জবাই না করা হলে একটি ভেড়ার আয়ু সর্বোচ্চ আট বছর পর্যন্ত হয়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক মাদি সংকর ভেড়া বছরে দুটি শাবক (সর্বোচ্চ) জন্ম দেয়। অন্যদিকে দেশীয় ভেড়া বছরে চারটি মেষশাবকের জন্ম দেয়।
হিড বাংলাদেশের খুলনা রিজিওনাল ম্যানেজার রতন কুমার অধিকারী বলেন, 'সংকর ভেড়ার এটা একটা অসুবিধা। এদের উন্নত প্রজননের জন্য বিশেষ ভেটেরিনারি চিকিৎসা ও লালনপালনে ভর্তুকি দিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, বর্ষায় জোয়ারের মাত্রা বাড়লে উপকূলীয় বেল্টের চারপাশে চারণভূমির ব্যাসার্ধ সংকুচিত হয়ে পড়ে। 'সে সময় ভেড়া, ছাগলের মতো প্রাণীগুলো চরতে পারে না।'
এছাড়া ভেড়া ও ছাগলের অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ পিপিআর বা 'গোট প্লেগ' নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
অধ্যাপক সফিকুল বলেন, 'খামারিদের উচিত সময়মতো টিকা এবং ভেড়ার স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান নিশ্চিত করা।'