হাজার কোটি টাকা দেনায় থাকা সীমা গ্রুপের ভবিষ্যৎ কী!
চট্টগ্রামে এমএস রডের প্রথম দিকের কারখানা সীমা অটোমেটিক রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। এমএস রড, শিপ ব্রেকিং ও অক্সিজেন খাতে দীর্ঘদিন ধরে ভালো ব্যবসা করে আসছিল সীমা গ্রুপ।
তবে, ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোহাম্মদ শফির মৃত্যুর পর থেকে সংকটে পড়ে গ্রুপটি। এক সময়ের প্রতিষ্ঠিত গ্রুপটির বেশিরভাগ কোম্পানি গত পাঁচ বছরে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে গ্রুপটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা আটকে রয়েছে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা। প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ শফির তিন ছেলে বর্তমানে গ্রুপটির সমস্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। তবে তাদের নেতৃত্বে গ্রুপের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই এখন লড়াই করছে টিকে থাকার।
এরইমধ্যে সীমা গ্রুপের ওপর সর্বশেষ আঘাতটি আসে গত ৪ মার্চ; সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ঘটে বিস্ফোরণ। এ ঘটনায় এক নতুন সংকটে পড়েছে সংস্থাটি। বিস্ফোরণের ঘটনায় আগুনে পুড়ে ৭জন প্রাণ হারান এবং ৩০ জন আহত হন। এতে অন্তত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় গ্রুপটি।
১৯৯০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত সীমা গ্রুপ চট্টগ্রামে এমএস রড, শিপ ব্রেকিং ও অক্সিজেন খাতে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসা করে আসছে।
বর্তমানে গ্রুপটি ৫ ব্যাংকের কাছে ১,০০০ কোটি টাকা দেনা। এতে পাওনাদার ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন হাজার কোটি টাকা দেনায় ডুবে থাকা সীমা গ্রুপ কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
পাওনাদার ব্যাংকগুলোর তথ্যমতে, প্রায় হাজার কোটি টাকার মধ্যে পূবালী ব্যাংক শেখ মুজিব রোড শাখায় ৪১০ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক অক্সিজেন শাখায় ২৫০ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখায় ২৫০ কোটি টাকা, সোশাল ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ৮০ কোটি টাকা এবং ডাচ বাংলা ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখায় ৪০ কোটি টাকা দেনা রয়েছে সীমা গ্রুপ।
পূবালী ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৪ সালে পূবালী ব্যাংক চট্টগ্রামের শেখ মুজিব রোড শাখায় ব্যবসা শুরু করে সীমা গ্রুপ। এরপর বিভিন্ন সময় ইস্পাতের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ কিংবা স্ক্র্যাপ শিপ আমদানিতে ঋণ সুবিধা নিয়েছে তারা। সর্বশেষ ২০১৯ সালেও কাঁচামাল (স্ক্র্যাপ শিপ) আমদানিতে ১০০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা নেয় গ্রুপটির সীমা অটোমেটিক রি রোলিং মিলস লিমিটেড।
২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাটির কাছে শাখাটির মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৮০ কোটি টাকা। ব্যাংকের টাকায় কাঁচামাল আমদানি এবং তা রড বানিয়ে বাজারে বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত দেয়নি। বর্তমানে গ্রুপটির কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৪১০ কোটি টাকা।
পূবালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২১ সালে ঋণটি রিশিডিউল করলে সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করেনি সীমা স্টিল। তবে সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে (২০২২ সাল) প্রায় ৮ কোটি টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়েছে।
এর পাশাপাশি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোলাটেরল সিকিউরিটি খুবই কম। ৪১০ কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে সীমা অটোমেটিকি রি-রোলিং মিলসটি বন্ধক রয়েছে ব্যাংকের কাছে। যার মূল্য সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা।
পূবালী ব্যাংকের এজিএম ও সাধারণ বীমা ভবন শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ আলী বলেন, ইস্পাত, শিপ ব্রেকিং ও অক্সিজেন খাতে ভালো ব্যবসা ছিল সীমা স্টিলের। বিশেষ করে, ইস্পাত খাতে চট্টগ্রামের লোকাল বাজারে ভালো দখল ছিল এই কোম্পানির। ফলে সহজে বড় অঙ্কের ঋণ পেয়েছে। কিন্তু গ্রুপটির কর্ণধার মারা যাওয়ার পর এই ঋণ আদায় নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় শঙ্কা।
সীমা গ্রুপের কাছে বিনিয়োগ করে বড় ঝুঁকিতে পড়েছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। কারণ গ্রুপটির সীমা স্টিলের কাছে ২৫০ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে ব্যাংকটির। যার বিপরীতে ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির কোনো কোলাটেরল সিকিউরিটি নেই।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং হেড অবহোল সেল ব্যাংকিং ডিভিশন, চট্টগ্রামের সৈয়দ মাহমুদ আখতার বলেন, ২০১০ সাল থেকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাথে ব্যবসা করে আসছে সীমা স্টিল মিলস লিমিটেড। দীর্ঘ কয়েক বছর ভালো ব্যবসা করলেও ২০১৯ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ঋণের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করে। পরবর্তীতে ২০২০ সালে ঋণটি রিসিডিউল করলেও শর্ত অনুযায়ী ঋণের কিস্তি শোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি।
তিনি আরও বলেন, "দীর্ঘ সময় ধরে ইস্পাত খাতে ভালো ব্যবসায় করায় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পেয়েছেন এই উদ্যোক্তা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ব্যবসা পরিচালনায় যোগ্য উত্তরসূরী না থাকায় এক সময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো রুগ্ন হয়ে পড়ে। এতে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণগুলোও আটকে যায়।"
মার্কেন্টাইল ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখার বিনিয়োগ ছিল সীমা গ্রুপের সীমা শিপ ব্রেকিংয়ে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে শাখাটিতে ব্যবসা শুরু করে বিভিন্ন সময়ে ঋণ সুবিধা নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালের পর থেকে ঋণের কিস্তি প্রদান অনিয়মিত হয়ে পড়ে কোম্পানি। সর্বশেষ, গত বছর প্রায় ৩ কোটি টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণটি রিসিডিউল করে। বর্তমানে সীমা স্টিলের কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পাওনা ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে, সীমা স্টিল মিলস লিমিটেডের কাছে ৪০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় গ্রুপটির চার কর্ণধারের বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা দায়ের করেছে ডাচ বাংলা ব্যাংক।
২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির ওআর নিজাম রোড শাখা চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে এই মামলা দায়ের করে। মামলায় সীমা স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মামুন উদ্দিন, পরিচালক মোহাম্মদ পারভেজ উদ্দিন এবং আশরাফ উদ্দিনকে বিবাদী করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাখার এক কর্মকর্তা জানান, "গত চার-পাঁচ বছর ধরেই সীমা স্টিলের ঋণের মান খারাপ হয়ে যায়। এরপরও আমরা চেষ্টা করেছি ঋণটি রেগুলার রেখে কিস্তি আদায়ে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্ণধারদের কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় আইনী প্রক্রিয়া যেতে হয়েছে।"
এই ঋণের বিপরীতে কোম্পানিটির মাত্র ৯৭ শতক জমি বন্ধক রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের তথ্যমতে, সীমা স্টিল এবং সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিনিয়োগ করেছিল ব্যাংকটি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোহাম্মদ শফি মারা যাওয়ার পর তাদের ঋণ আটকে যায়। এরমধ্যে বিভিন্ন সময় রিসিডিউলের কথা বলে কিছু ডাউন পেমেন্ট দিলেও তা কখনো শর্ত পূরণ করতে পারে নি। বর্তমানে সীমা স্টিলের কাছে ৭৮ কোটি টাকা ও সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখার ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির কাছে গ্রুপটির ১০ কোটি টাকার মতো জমি বন্ধক রয়েছে।
পাওনাদার ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৯০ এর দশকে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ছেড়ে শিপ ব্রেকিং ব্যবসায় আসেন সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি এলাকার মোহাম্মদ শফি। শিপ ব্রেকিংয়ে ভালো মুনাফা হওয়ার পর গড়ে তুলেন সীমা স্টিল মিলস। এরপর ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামে বেসরকারিভাবে প্রথম অক্সিজেন কারখানা গড়ে তুলেন সীমা। পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালে গড়ে তুলেন অটো রি-রোলিং মিলস।
শিপ ব্রেকিং, ইস্পাত ও অক্সিজেন এই তিন খাতে দীর্ঘদিন ভালো ব্যবসা করেন মোহাম্মদ শফি। বিশেষ করে, চট্টগ্রামের স্থানীয় বাজারে ভালো দখল ছিল সীমা স্টিলের।
কিন্তু ২০১২ সালে দেশিয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ইস্পাত পণ্যের দামের উত্থান-পতন, স্থানীয় বাজারে বাকিতে পণ্য বিক্রির প্রায় ২০০ টাকা আটকে যাওয়া এবং গ্রুপটির কর্ণধার ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘসময় ব্যবসা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় রূগ্ন হয়ে পড়ে সীমা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো।
২০১৯ সালে মোহাম্মদ শফির মৃত্যুর পর তার তিন ছেলে ব্যবসার হাল ধরেন। কিন্তু তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারেননি। বরং প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়ে পড়ে। এমনকি, এক পর্য়ায়ে ২০২০ সালে সীমা স্টিলের তিনটি ইয়ার্ডে জাহাজ কাটা বন্ধ হয়ে যায়। সীমা অটোমেটিক রি-রোলিং মিলটি চালু থাকলেও তা ছিল অনিয়মিত।
এরমধ্যে গত ৪ মার্চ রাতে গ্রুপটির সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের পর থেকে গ্রুপটির বর্তমান তিন কর্ণধার গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এমনকি তাদের মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে। ফলে বহু চেষ্টার পরও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ইফতেখার উদ্দিন বলেন, "অক্সিজেন প্ল্যান্টে দুর্ঘটনার পর ঝামেলা এড়াতে মালিকরা মোবাইল বন্ধ রেখেছেন। তবে আমরা ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণসহ যাবতীয় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রশাসনের নির্দেশে কাজ করছি।"
কারখানা কতদিনে মেরামত করা যাবে ও পুনরায় উৎপাদন শুরু হবে, এই বিষয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।