জার্মান শেফার্ড পেতে চাইলে...
রাগী, তেজি, উন্নত জাতের জার্মান সারমেয় ঢাকার উষ্ণ আবহাওয়ায় দিব্যি দৌড়ে-খেলে বেড়াচ্ছে বাড়ির শিশু ও বড়দের সাথে। অবসরে বাড়ির সদস্যরা তাদের বাইরে ভ্রমণ ও খেলা করতে নিয়ে যান। মাশিকুর রহমান অমিত নামের মোহাম্মদপুরের এক বাসিন্দা শখের বশে ভারত থেকে জার্মান শেফার্ড কিনে এনে ঘরে পালতে শুরু করেন। তাকে দেখে উৎসাহী হয়ে এলাকার আরও কয়েকজন এ জাতের কুকুর পালনের সিদ্ধান্ত নেন। সেখান থেকেই শুরু হয় অমিতের জার্মান শেফার্ড কুকুর 'ব্রিডিং' করে বিক্রি করা। আমাদের দেশে পোষা প্রাণী হিসেবে বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে বিড়াল, পাখি, খরগোশ ও দেখতে আকর্ষণীয় এমন সব কুকুর। কিন্তু, এ ধারার বাইরে গিয়ে অমিত কেন জার্মান শেফার্ড পুষতে শুরু করলেন এবং গরম আবহাওয়ায় এ প্রাণীরা কীভাবে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকে তা জেনে নেওয়া যাক।
জার্মান শেফার্ড জাতের কুকুরের বিশেষত্ব হচ্ছে তারা উচ্চ বুদ্ধিসম্পন্ন ও সাহসী হয়। তবে ঘরে আদর-যত্ন করে পালার বদলে নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ কাজেই এদের ব্যবহার বেশি চোখে পড়ে। বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিরাপত্তাজনিত কাজে বহু আগ থেকেই জার্মান শেফার্ড কুকুর ব্যবহার করা হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সামনের সারিতে থেকে বোমা উদ্ধার ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকে বলে, অনেকেই শেফার্ডকে যুদ্ধ ময়দানের সৈনিক নামে ডাকেন।
একসময় ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে লোকে জার্মান শেফার্ড খুব একটা পালত না। তবে এ ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশেও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে অনেকেই জার্মান শেফার্ডকে ঘরের নতুন সদস্য হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। বাণিজ্যিকভাবে এ কুকুরের খামারও করেছেন কেউ কেউ।
ফেসবুক থেকে নতুন পরিবারের সন্ধান পাওয়া
জার্মান শেফার্ড পালনের চল আমাদের দেশে তেমন ছিল না বললেই চলে। তাই এ কুকুরের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে, তাদের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে লোক মারফত কিনে নিয়ে আসতেন। ফলে কারও ইচ্ছে হলেও এ কুকুর পালা সম্ভব হতো না। বর্তমানে জার্মান শেফার্ডের কয়েকজন মালিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গ্রুপ খুলেছেন, যেখানে যোগাযোগ করে আগ্রহীরা কিনতে পারেন।
ফেসবুকে অমিতের 'ঢাকা জার্মান শেফার্ড কেনেল' নামক একটি গ্রুপ রয়েছে। গ্রুপটিতে তিনি ও অন্যান্য জার্মান শেফার্ড মালিকেরা নিজেদের সারমেয়র সাথে খেলাধুলা, সময় কাটানোর ভিডিও শেয়ার করেন। কুকুরগুলো কতটা বড় এবং স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠল তা ছবিসহ গ্রুপে আপডেট দিয়ে থাকেন মালিকেরা। কেউ কেউ আবার কুকুরের নানা সমস্যার জন্য পরামর্শ চেয়ে পোস্ট করেন। জার্মান শেফার্ড কিনতে আগ্রহীরা এ গ্রুপে যুক্ত হয়ে কুকুরের ছবি দেখে কেনার বায়না দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার ব্রিডিং করার পূর্বেই কেনার কথা জানিয়ে রাখেন।
ফেসবুকে 'জার্মান শেফার্ড পেকস' নামক আরেকটি পেজ আছে, যারা বাণিজ্যকভাবে কুকুরের ব্রিডিং করে বিক্রি করে। ঢাকার নারায়ণগঞ্জে স্থায়ী খামার স্থাপন করে জার্মান শেফার্ডের ব্রিডিং ও লালন-পালনের কাজ করা হয়। খামার মালিক আরফাদুর রহমান বান্টি ২০১৬ সালে ব্যক্তিগত শখের বশে পরিচিত লোক মারফত বাইরের দেশ থেকে 'চ্যাম্প' নামক একটি জার্মান শেফার্ড কিনে আনেন। তারপর নতুন সদস্য হিসেবে যুক্ত হয় স্ত্রী-কুকুর চেরি ও চিজি। এরা বাচ্চা দিতে শুরু করলে তিনি কুকুর বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। এ বিক্রি থেকেই ব্যবসার সূচনা। তার পেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আগ্রহীরা কুকুর কেনার জন্য বুকিং দিয়ে রাখেন।
উন্নত জাতের ব্রিডিং করতে মেলানো হয় জুটি
প্রায় বছর চারেক আগে অমিত ভারত থেকে ৫০ হাজার রুপি দিয়ে একটি জার্মান শেফার্ড পুরুষ-কুকুরের বাচ্চা কিনে দেশে নিয়ে এসেছিলেন পালার উদ্দেশ্যে। কয়েকমাস বয়সী এ কুকুরটি হয়ে উঠে তার ঘরের নতুন সদস্য ও খেলার সঙ্গী। তারপর তিনি আরও একটি স্ত্রী-কুকুর কিনে নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে এ তারা বাচ্চা জন্ম দিতে শুরু করলে তার একার পক্ষে এতগুলো প্রাণীকে ঘরে রেখে পালা সম্ভব ছিল না বলে সেগুলো বিক্রি করে দিতে শুরু করেন। প্রতিটি কুকুরের ছানা তিনি ৫০-৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
অমিত জানান, 'আমার যখন ১৫ বছর বয়স তখন থেকে আমাদের বাড়িতে জার্মান শেফার্ড কুকুর পালা হয়। যেহেতু এ কুকুর দেখে বড় হয়েছি, সেখান থেকেই মূলত আমার ইচ্ছেটা জাগে নিজে একটি জার্মান শেফার্ডের ছানা কিনে এনে পালার। এ জাতের কুকুরের দাম বেশি হওয়ায় অনেকে নিজেদের আভিজাত্য দেখাতেও শখের বশে এ কুকুর কিনে থাকেন। নাহলে ঘরে পালতে এক লাখ টাকা দিয়ে আমাদের দেশের লোকজন কুকুর কিনতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক।
'দুই ধরনের ব্রিডিং হয় — জেনো ও ফেমো। কিছু কুকুরের চুল, পশম বড় হয়। একটি শেফার্ডের দৈহিক গঠন, পশম, আকার, ওজন ও অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি দেখে ভালো লাগলে- সেটির সঙ্গে আমার কুকুরটিকে ব্রিড করাই। কারণ কুকুরের শারীরিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকটা তাদের পূর্বপুরুষদের ওপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর সেখান থেকে কয়েকটি আমাকে দেওয়া হয়, আর বাকিগুলো অন্য কুকুরের মালিকেরা নিজেরা রেখে দেন। এভাবেই এখন পর্যন্ত দু'বছরে প্রায় ৫০টি জার্মান শেফার্ডের বাচ্চা বিক্রি করেছি। তবে দুই মাস বয়সের আগে কুকুরগুলো বিক্রি করা যায় না। তার আগে এগুলো মায়ের কাছে থাকে এবং টিকা দেওয়ার মতো কিছু কাজ থাকে,' জানাচ্ছিলেন অমিত।
খামারে একটি কুকুর থেকে আরও একাধিক উন্নতমানের জার্মান শেফার্ড ব্রিডিং করানোর পদ্ধতি নিয়ে 'জার্মান শেফার্ড পেকস' খামারের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'বর্তমানে ৭টি কুকুর থেকে আমরা ব্রিডিং করাচ্ছি। এরমধ্যে ৫টি স্ত্রী ও ২টি পুরুষ কুকুর রয়েছে। প্রথমদিকে কেবল ওয়ার্কিং লাইন কুকুর ব্রিড করানো হতো। পরবর্তীসময়ে আরও উন্নত জাতের জন্য আমরা 'শো লাইন কুকুরের ব্রিড করানো শুরু করি। পার্থক্য হচ্ছে ওয়ার্কিং লাইন কুকুরের ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্ত সমান্তরাল হয়, যা শো লাইন কুকুরের বেলায় একটু বাঁকা থাকে। এছাড়া এগুলোর দৈহিক গঠন, পশমের রঙ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যেও কিছুটা ভিন্নতা থাকে। ফেসবুকে ছবি দেখে ক্রেতারা আগে থেকেই জানিয়ে দেন কোন কুকুর থেকে ব্রিড করানো বাচ্চা তারা কিনতে চান। সে অনুযায়ী বাচ্চা দেওয়া হয়। স্ত্রী কুকুরগুলোকে বছরে একবারের বেশি ব্রিড করানো হয় না।'
জার্মান শেফার্ডের খাবার ও যত্নআত্তি
একটি প্রাপ্তবয়স্ক জার্মান শেফার্ড কুকুরকে দিনে দুইবার খাবার দিতে হয়। বাচ্চা কুকুরের বেলায় খাবারের পরিমাণ কম থাকলেও দিনে ৫-৬ বার খাবার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। জন্মের ৪০-৪৫ দিন পর্যন্ত শেফার্ড ছানারা মায়ের দুধ খেয়েই বেঁচে থাকে। তবে ৩০ দিন পর থেকেই তাদের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার দেওয়া যায়।
জার্মান শেফার্ড কুকুর লালনপালন ও খাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে অমিত বলেন, 'দু'বেলার মধ্যে আমি একবার ওদেরকে মুরগি, সবজি ও ভাত খেতে দিই। আরেক বেলা বাজার থেকে কিনে আনা কুকুরের খাবার (ডগ ফুড) খেতে দিই। একবেলায় প্রায় আধা কেজি মুরগি লাগে একটি কুকুরের জন্য। সে হিসাবে মাসে পাঁচ হাজার টাকার ওপর যায় একটি কুকুরের খাবার খরচ। আর বাচ্চা কুকুরকে ভাত, মুরগি, ডগ ফুড ও সেরেলাক খাওয়াতে হয়।
'এর জন্য মাসে তিন হাজারের মতো খাবার খরচ লাগে। ঠান্ডার দেশের কুকুর আমাদের দেশের আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা তো হবেই। তারমধ্যে গরমে চুলকানি, ঘামাচি ও পেট খারাপের অসুখ দেখা দেয়। জলাতঙ্ক ও অন্যান্য রোগের জন্য বছরে দুইবার কুকুরকে টিকা দিতে হয়। আর জ্বর, ঠান্ডায় নিয়মিত চিকিৎসা তো থাকেই।'
দুই বছরে ৫০টি কুকুর ব্রিডিং করে বিক্রি করলেও এ কাজটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করতে রাজি নন অমিত। তার ফেসবুক গ্রুপটি ব্যবসার জন্য নয়। কুকুর মালিক ও কুকুর প্রেমীদের বিভিন্ন মুহূর্ত ভাগাভাগি করতেই খোলা হয়েছে এটি। সেসব দেখে আগ্রহী হয়ে কেউ কুকুর কেনার ইচ্ছা পোষণ করলে ব্রিডিং করে বিক্রি করেন অমিত।
তবে অমিত তার শখের কাজকে উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিতে চান না। তার মতে, বাংলাদেশে পোষা প্রাণী হিসেবে পাখি, বিড়াল ও অন্যান্য প্রাণীর যে চাহিদা রয়েছে তা কুকুরের বেলায় দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক নানা বিধিনিষেধ কাজ করে বলেই লোকে এ প্রাণীর প্রতি তেমন সদয় নয় বলে মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে 'জার্মান শেফার্ড পেকস'-এর মালিক তার শখের কাজকে ব্যবসায় হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু উন্নত মানের সঙ্গে আপস না করতে, প্রতিবেলায় ঠিকঠাক মতো ভিটামিন, ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাইয়ে থাকেন কুকুরগুলোকে। এমনকি দেশের বাইরে থেকে ভালো মানের ডগ ফুড এনে খাওয়ানো হয় এই কুকুরগুলোকে। তাই প্রতিমাসে কুকুরের খাবারের পেছনে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচা হয়। তবুও তাদের লক্ষ্য থাকে কুকুরের মানসম্মত ব্রিডিং ও গুণাগুণ যেন ধরে রাখা যায়।
ব্রিডিং ব্যবসার হালচাল জানাতে মোস্তাফিজুর আক্ষেপ করে বলেন, 'একটি ইউরোপিয়ান জাতের জার্মান শেফার্ড আমদানি করে কিনে আনতে আমাদের প্রায় ১০ লাখ টাকা লাগে। এরপর এগুলো থেকে বাচ্চা ব্রিড করতে ও খাবারদাবারে আমাদের যে পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়, সে অনুযায়ী আমাদের দেশে বিক্রয়মূল্য কম। এক থেকে দেড় লাখ টাকায় কেউ জার্মান শেফার্ড কিনতে রাজি হয় না। তাই সব কিছু চিন্তা করেই আমাদের ৭০ থেকে ৯০ হাজারের মধ্যে বিক্রি করতে হয়, যা একটি কুকুরের পেছনে করা খরচা ও যত্নের তুলনায় কমই বলা চলে।'
জার্মান শেফার্ডকে ছোটবেলা থেকে ঠিকঠাক প্রশিক্ষণ দিতে পারলে এ কুকুরগুলো বেশ কাজের হয়ে ওঠে। শুধু ব্যক্তি বা বাড়ির নিরাপত্তা নয়, এ কুকুর প্রয়োজনে জীবনরক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। নিজ মালিককে রক্ষা করতে এরা মানুষের থেকেও বেশি সাহসী পদক্ষেপ নিতে পিছপা হয় না। আর এ সবটাই নির্ভর করে কর্তার ওপর — তিনি ঠিক কীভাবে তার কুকুরকে চালচলন ও সামাজিক শিক্ষা দিচ্ছেন।
এদের মধ্যে অপরিচিত লোক দেখলে হঠাৎ আক্রমণ করার প্রবণতা থাকে। তাই বাড়ির শিশুদের খেলতে দেওয়ার ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হয়। ছোট থেকে কুকুরদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হলে এরা ঠিক ঘরের সদস্যের মতোই হয়ে যায়। একটি জার্মান শেফার্ড কুকুরের জীবনকাল ৮-১৩ বছর হয়। ভালো খাবার আর যত্ন দেওয়া হলে এ জাতের কুকুর বাংলাদেশের আবহাওয়ায় প্রায় ১০ বছরের মতো বাঁচে।