ভারতবর্ষে উনিশ শতকে ট্রেনে নারীদের আলাদা কামরা রাখার পরিকল্পনা কেন সফল হয়নি
১৮৬৯ সালে ভারত ও ব্রিটেনের একাধিক সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়েতে হিন্দু ও মুসলমান 'নারী যাত্রীদের' জন্য বিশেষ কামরা রাখার একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন ভারতের ভাইসরয়। ট্রেনে ভ্রমণকারী ভারতীয় নারীদের 'অসম্মানিত' হওয়া প্রতিরোধে এটিই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছিল কর্তৃপক্ষ।
'সম্মানিত নেটিভ নারীদের' জন্য সংরক্ষিত এই বিশেষ কামরাটি প্রথম শ্রেণির মানসম্পন্ন হবে, তবে অন্যান্য প্রথম শ্রেণির কামরার চেয়ে কম ভাড়ায় ভ্রমণের সুবিধাসহ এই ব্যবস্থা তৈরির কথা ছিল। আরও সুপারিশ করা হয় যে, নারীদের জন্য সংরক্ষিত এ কামরায় একজন ইউরোপিয়ান নারী প্রহরী এবং একজন ইউরোপিয়ান নারী টিকিট সংগ্রহকারী সর্বক্ষণ থাকবেন। নারী যাত্রীরা যেন ট্রেনের কামরায় কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে না পড়েন, তা নিশ্চিত করা হবে এই প্রহরীর দায়িত্ব। সেই সঙ্গে ভ্রমণরত নারীর সঙ্গে কোনো পুরুষ আত্মীয় থাকলে তাকে পার্শ্ববর্তী কামরায় জায়গা দেওয়া হবে।
তবে তৎকালীন বাংলা সংবাদপত্র 'ঢাকা প্রকাশ'- এর একটি প্রতিবেদনে পরামর্শ দেওয়া হয়, কোনো নারী যদি একা ভ্রমণে আপত্তি জানান, তাহলে তিনি যেন তার পুরুষ আত্মীয়র সঙ্গেই একই কামরায় ভ্রমণ করতে পারেন - ট্রেনে এমন কামরার ব্যবস্থাও থাকা উচিত।
১৯১০ সালে, রেলওয়েতে নারী যাত্রীদের জন্য আলাদা কামরা রাখার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-এর কমিটি। কমিটির সচিব সীতা নাথ রায় রেলওয়ে বোর্ডের সভাপতিকে দেওয়া চিঠিতে ট্রেনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত কামরায় বারবার 'ডাকাতি ও জুলুমের' ঘটনাগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি তিনপাহাড় এলাকায় সাম্প্রতিক একটি ডাকাতির ঘটনার উদাহরণ দেন, যেখানে জনৈক বাঙালি নারীকে ছুরিকাঘাত করে তার গয়না চুরি করে নেয় ডাকাতরা এবং তার তিন সন্তানকে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়।
সীতা নাথ রায় চিঠিতে বলেন, নারীদেরকে স্বতন্ত্র একটি কামরায় ভ্রমণ করতে দিলে তারা 'দুর্বৃত্ত ও বেপরোয়াদের কবলে পড়ে নিজেদের সম্পূর্ণ অসহায় মনে করে'; এবং তারা জানে না যে হামলার কবলে পড়লে কিভাবে অ্যালার্ম বেল বাজাতে হয়।
কমিটির ধারণা ছিল, প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ট্রেনের যাত্রীসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে পারে। সে কারণে নারীদের জন্য ট্রেনে আলাদা কামরার রাখার ক্ষেত্রে তারা কিছু 'সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা' গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিল:
- সকল শ্রেণীর নারী যাত্রীদের একটি কামরায় রাখা যেতে পারে, যদি সেখানে একজন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য পুলিশ কর্মকর্তা থাকে এবং তার সঙ্গে সামনে-পেছনে আরও দুই থেকে তিনজন কনস্টেবল রাখা হয়।
- মধ্যবর্তী ও তৃতীয় শ্রেণীর কামরার মাঝে আলাদা পার্টিশন তোলা যাবে না।
- রাতেরবেলা ট্রেনে ভ্রমণের সময় দুজন নারী প্রহরী রাখতে হবে ওই কামরায়।
- নারীদের কামরার জানালায় শক্ত লোহার গ্রিল থাকতে হবে।
- নারীদের কামরাতে সাইড লাইট থাকতে হবে।
(এ আর্টিকেলটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ লাইব্রেরি আনটোল্ড লাইভস ব্লগ-এ)