উট ব্যবসায়ী থেকে সুদানের সম্ভাব্য রাষ্ট্রপ্রধান, কে এই জেনারেল 'হেমেদতি'?
সুদানের সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার পর সুদানে বেসামরিক শাসনের আশা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
আরএসএফ-এর এই বিশাল প্রভাবের পেছনে মূল কাণ্ডারি এর নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি পরিচিত 'হেমেদতি' বা 'লিটল মোহাম্মদ' নামে। ২০১৯ সালে প্রাক্তন শাসক ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশ শাসনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন কাউন্সিলের সদস্য হওয়ার পর তিনি ক্রমেই একজন শক্তিশালী নেতা হয়ে উঠেছেন। কাউন্সিলটি গঠিত হয়েছিল শীর্ষস্থানীয় বেসামরিক ও সামরিক লোকজনদেরকে নিয়ে।
২০২১ সালে হেমেদতির আরএসএফ এবং সামরিক বাহিনী একত্রিত হয়ে এই বেসামরিক-সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায়। কিন্তু দেড় বছর পর মনে হচ্ছে সামরিক বাহিনী নিয়ে অসন্তুষ্ট দাগালো। তিনি বিবৃতি দিয়েছেন, কীভাবে সামরিক বাহিনীর পদগুলো এখনো ওমর আল বশিরের অনুগত দিয়ে ভর্তি, যারা গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে।
কে এই জেনারেল 'হেমেদতি', যিনি সুদানের সবচেয়ে ধনী এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছেন? হয়ে উঠেছেন সুদানের শক্তিশালী আরএসএফ বাহিনীর পেছনের মূল কারিগর?
মিলিশিয়া মাস্টারমাইন্ডের সূচনা
১৯৭৪ সালের দিকে দারফুরের রিজিগাট সম্প্রদায়ের মাহারিয়া গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন দাগালো। রিজিগাটের উট-বাণিজ্যের সাথে জড়িত এক উপজাতি-প্রধানের ভাগ্নে তিনি। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও বেশিদূর গড়ায়নি, তৃতীয় শ্রেণী পড়ার পরই স্কুল ছেড়ে দেন, যোগ দেন উটের ব্যবসায়।
দাগালো সম্পর্কে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া গল্প হলো, দারফুর সংঘাতের সময় তার গোত্রের ৬০ জন মানুষকে হত্যা এবং তার উট লুট করে নিয়ে গেলে তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হন।
এরপর তিনি আরব উপজাতি মিলিশিয়াদের একটি গোষ্ঠী জাঞ্জাউইদে যোগ দেন, যেটি তার উট-বাণিজ্যের এলাকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে, যারা মূলত দারফুর অঞ্চল এবং চাদের কিছু অংশে সক্রিয় ছিল।
এরপর তিনি ক্রমেই নিজের পদোন্নতি ঘটান এবং রাষ্ট্রপ্রধান আল-বশিরের নজরে পড়েন। ২০০৩ সালে দারফুরে বশিরের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিল অ-আরব গোত্রগুলো। তাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করার জন্য জাঞ্জাউইদকে নিয়োগ দিয়েছিলেন বশির এবং দাগালো শীঘ্রই হয়ে ওঠেন জাঞ্জাউইদের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো দারফুরের সংঘাতের সময় জাঞ্জাউইদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ এবং বেসামরিক নাগরিকদের নির্যাতনসহ বেশকিছু যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করে।
এরপর দাগালোর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে গঠিত হয় আরএসএফ। আল-বশির এবং তার ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসের পৃষ্ঠপোষকতায় আরএসএফ হয়ে ওঠে বশিরের শাসন টিকিয়ে রাখার নতুন অস্ত্র।
আল-বশিরের মিত্র ও প্রতিপক্ষ
শীঘ্রই দাগালোকে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হতে থাকে। দারফুরসহ সুদানের অন্যান্য জায়গায় নিজেদের শত্রুকে নিকেশ করতে দাগালোর আরএসএফ-এর ওপর নির্ভর করা শুরু করেন ওমর আল বশির। এর পুরষ্কার হিসেবে আরএসএফ-কে স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়া হয়।
দাগালোকে এরপর পদোন্নতি দিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ দেন বশির। দাগালো আরএসএফ-কে ব্যবহার করে দারফুরে থাকা সোনার খনি এক প্রতিদ্বন্দ্বী উপজাতীয় নেতার কাছ থেকে দখল করে নেন এবং সেখান থেকেই তার অর্থের চাকা আরও জোরে ঘুরতে শুরু করে।
মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ফরেন পলিসি অ্যান্ড সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক আদেল আব্দেল গাফর আল জাজিরাকে জানান, "তিনি প্রভাবশালী হওয়ার সাথে সাথে বশিরের সাহায্যে নিজের ব্যবসা আরও বাড়াতে থাকেন। তার পরিবারকে নিযুক্ত করেন স্বর্ণ খনি, পশুসম্পদ এবং অবকাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা খাতে।"
আল-বশিরের দীর্ঘদিনের মিত্র এবং তার শাসনে ব্যাপকভাবে উপকৃত হওয়া সত্ত্বেও বশিরের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে যখন বিদ্রোহ শুরু হয়, তখন দাগালো নিজেই রাষ্ট্রপ্রধানকে উৎখাত করার অভিযানে অংশ নেন এবং ওমর আল বশিরের প্রায় ৩০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
বশির-পরবর্তী ক্ষমতা দখল
আল-বশিরের উৎখাতের পর, একটি বেসামরিক-সামরিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে দেশ শাসন শুরু হয় এবং দাগালো সেই সংকটকালে নিজের অবস্থান আরও শক্ত করেন। আল-বশিরের পতনের পর ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিলের উপ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। এরপর এই কাউন্সিলের উত্তরসূরি 'সভরেইনটি কাউন্সিল'-এও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি। এবং বরাবরের মতো এবারও দাগালো ভিন্নমতের ব্যক্তিদের কঠোরভাবে দমন করেন।
তার আদেশে ২০১৯ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরে হওয়া এক বিক্ষোভ মিছিলের ওপর ক্র্যাকডাউন করে ১০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করে আরএসএফ, যদিও দাগালো এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
দাগালোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত দাগালোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যদিও তারা ওমর আল-বশির এবং অন্যান্য শীর্ষ সুদানি কর্মকর্তাদেরকে গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
বেসামরিক শাসনে উত্তরণে অস্পষ্ট ভূমিকা
কয়েক বছর ধরে সুদানের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উভয় জায়গাতেই শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করেছেন দাগালো। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে মিত্র হিসেবে ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আরএসএফ বাহিনীকে পাঠিয়েছিলেন তিনি।
একইসাথে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের সাথে দেখা করেছেন, বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে আলোচনা করেছেন, যুদ্ধরত উপজাতিদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করেছেন এবং সুদানে গণতন্ত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসমক্ষে কথা বলেছেন তিনি। তবে এ সময় সেনাবাহিনীর প্রতি তার শত্রুতা লুকানোর কোনো চেষ্টা করেননি।
গত ডিসেম্বর মাসে সেনাবাহিনী, আরএসএফ এবং সুদানের বেসামরিক গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠী একটি চুক্তি করে, যে চুক্তি অনুযায়ী দেশটিতে একটি বেসামরিক শাসনের সূচনা হবে। চুক্তি অনুযায়ী, সেনাবাহিনী তার ব্যারাকে ফিরে যাবে এবং আরএসএফ সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হবে। দুই বাহিনীকে এক কমান্ডারের অধীনে আনা হবে, যিনি এখন সুদানের সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। এরপর থেকেই দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘাত শুরু হয়েছে।
গাফর জানান, "দাগালো এবং বুরহান উভয়ই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছেন এবং একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছেন। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সুদানের জনগণকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে এই যুদ্ধ দেখতে হবে, কারণ উভয় সামরিক নেতাই টিকে থাকতে নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।"
সূত্র: আল জাজিরা