নিউমার্কেটের জিনাত বুকস-এর বই ও ইফফাতের বেড়ে ওঠার গল্প
সময়টা নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। ঢাকার শিক্ষিত পরিবারগুলোতে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম তখন রেডিও, টেলিভিশন আর বই। ইফফাত সুমাইয়া যে পরিবারে বেড়ে উঠেছেন সেখানে সপ্তাহান্তে ঘুরতে বের হওয়া মানেই ছিল বইয়ের দোকানে যাওয়া। অনেকটা নিয়ম করেই প্রতি সপ্তাহে মা-বাবা নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে নিয়ে যেতেন তাকে। সেই সুবাদেই চার-পাঁচ বছর বয়সে ইফফাতের পরিচয় হয় দেশের মৌলিক বইয়ের অন্যতম পুরনো দোকান 'জিনাত বুক সাপ্লাই'-এর সঙ্গে। বিদেশি বইয়ের জন্য অসংখ্য বইপ্রেমির প্রথম পছন্দ ছয় দশক পুরোনো এই বইয়ের দোকানটি বন্ধ হতে যাচ্ছে চলতি মাসেই।
প্রিয় বইয়ের দোকানটিকে বিদায় জানিয়ে ইফফাত সুমাইয়ার একটি লেখা বুকওয়ার্ম বাংলাদেশের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হলে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে দ্রুতই। দেশের নানা প্রান্তের শত-শত বই পড়ুয়া 'জিনাত' নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন সেখানে। নব্বইয়ের দশক থেকে এই পর্যন্ত জিনাত বুক সাপ্লাইয়ের সঙ্গে জড়িত স্মৃতির কথা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বর্ণনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ইফফাত সুমাইয়া।
ইফফাতের শৈশবের স্মৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো। চাচার বইয়ের দোকান 'বুক গ্যালারি'র পাশাপাশি জিনাত বুক সাপ্লাইয়ে কাটতো তার অধিকাংশ সময়। দোকানের মেঝেতে শুয়ে-বসে বই পড়তে পড়তে কাটিয়ে দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক বসাতেই কয়েকটি বই শেষ করে বাড়ি ফিরতেন কোনো কোনো দিন। জিনাত বুক সাপ্লাইয়ের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সালের সঙ্গে তখন থেকেই ছিল তার দারুণ সখ্য।
"বিশ বছরের বেশি সময় ধরে আমি একইরকম দেখে আসছি জিনাতকে। ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই বই। ফয়সাল আংকেল আর ম্যানেজার ওবায়েদ আংকেল ছাড়া আর একজন থাকতেন সবসময় দোকান দেখাশোনার জন্য। সবার সাথেই ছিল আমার ভালো সম্পর্ক। দোকানে ঢোকার সাথে সাথেই দেখা পেতাম ফয়সাল আংকেলের মুখ ঝলমল করা হাসির। আমার জন্য বিশেষ ডিস্কাউন্টের ব্যবস্থাও ছিল তার দোকানে। এছাড়াও প্রতিবার বই কেনার সময় ব্যাগে করে দিয়ে দিতেন উপহার," বলছিলেন ইফফাত সুমাইয়া।
কৈশোরে জিনাতে গেলেই ইফফাত বই দেখার ফাঁকে চা আর বিস্কুট হাতে গল্প জুড়তেন মোহাম্মদ ফয়সালের সঙ্গে। দোকানের বেশিরভাগ কাস্টমারের সঙ্গেই অন্তরঙ্গতা ছিল ফয়সালের। শুধু বই ক্রয়-বিক্রয় নয়, তাদের দৈনন্দিন জীবনের খোঁজ খবরও রাখতেন তিনি।
ইফফাতের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর বই কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ থাকতো পরিবার থেকে। সেই টাকার অধিকাংশই খরচ হতো জিনাত বুক সাপ্লাই থেকে বই কেনায়। জন স্টেইনব্যাক, টেনেসি উইলিয়ামস, বেল হুকস, সোজার্নার ট্রুথ, চিমামান্দা এনগোজি আদিচি, এলিজাবেথ গ্যাসকেল, উরসুলা লে গুইন, মার্গারেট অ্যাটউডের মতো লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন জিনাতের হাত ধরেই। একবার জন্মদিনে সর্বোচ্চ ৩৮ হাজার টাকার বই কিনেছিলেন তিনি জিনাত থেকে।
ইফফাতের ভাষ্যে, "আমাদের দেশের মানুষ নিজেদের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অনেক দৃঢ়। বইয়ের দোকানের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। মালিকপক্ষের নিজস্ব বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে কোনো বই খুব জনপ্রিয় না হলে সাধারণত দোকানগুলোতে রাখা হয় না। কিন্তু জিনাত ছিল সবচেয়ে ব্যতিক্রম। ফয়সাল আংকেল সত্যিই মনে করতেন মানুষকে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বই নির্বাচন করার সম্পূর্ণ অধিকার দেওয়া উচিত। তাই সব ধরনের বই-ই পাওয়া যেত তার দোকানে।"
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সবসময়ই অতিরিক্ত সুবিধা থাকতো জিনাত বুক সাপ্লাইয়ে। রেগুলার কাস্টমারদের কেউ তাৎক্ষণিক কোনো পছন্দের বই কিনতে না পারলেও তাদের অনুরোধে অনেকসময় সেটি তুলে রাখা হতো কয়েক মাস পর্যন্ত। নতুন বইয়ের সাপ্লাই এলেই লিস্ট পাঠানো হতো নিয়মিত পাঠকদের কাছে, যেন তাদের উইশলিস্টের কোনো বই হাতছাড়া না হয়ে যায়। অন্যান্য সব দোকানে যখন ভারতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে রূপির বিপরীতে টাকার কনভার্সন রেট রাখা হত ১.৫ থেকে ২ টাকা পর্যন্ত, সেখানে জিনাতে সবসময়ই ১ রূপির বিপরীতে রাখা হতো ১ টাকা।
এ পর্যন্ত ইফফাতের নিজস্ব সংগ্রহে বই আছে প্রায় ১,৬০০। যার মধ্যে নেই কোনো পাইরেটেড কপি। বইগুলোর একটা বড় অংশই কেনা জিনাত থেকে। জিনাত বন্ধ হওয়ার আগে মোহাম্মদ ফয়সাল শেষবারের মতো নিজের পছন্দের বই সংগ্রহ করতে মেসেজ দিয়েছিলেন ইফফাতকে। জানিয়েছিলেন, শেষ কয়দিন দোকানে থাকবেন না তিনি। ষাট বছর ধরে পরিচিত গ্রাহকদের শেষবারের মতো মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই তার।
ইফফাতের ভাষ্যে, "জিনাত থেকে শেষবারের মতো বই কিনে এনে আমি যখন শেলফে রাখছিলাম তখন খেয়াল করলাম এ পর্যন্ত কী কী বই আমি ওখান থেকে কিনেছি। বইগুলো আলাদা করে সাজিয়ে রেখে মনে হলো, আজকে আমি মানুষ হিসেবে যেমন- তার পেছনে আমার পড়া বইগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি। আর সারাজীবনে পড়া বইগুলোর মধ্যে একটা বড় অংশই জিনাত থেকে কেনা। আমার মানসিকতাটা গড়ে তোলার জন্য এই বইগুলো খুব বেশি প্রয়োজনীয় ছিল। জিনাতকে বিদায় জানানো আমার কাছে কোনো স্বজন বিয়োগের চেয়ে কম কিছু নয়।"
জিনাত বুক সাপ্লাইয়ের মতো দোকানগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ইফফাত দায়ী মনে করেন নতুন প্রজন্মের কাছে বইয়ের চাহিদা কমে যাওয়াকে। প্রযুক্তির উপর নির্ভরতার কারণে এখন বেশি দাম দিয়ে কেউ কাগজের মৌলিক বই কিনতে চায় না। তাছাড়া অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হওয়ায় সরাসরি দোকানে গিয়ে বই খোঁজার ধৈর্যও খুব কম পাঠকের আছে। গত কয়েকবছরে গতানুগতিক বইয়ের দোকানগুলো যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তাতে জিনাতের মতো পরিণতি হতে পারে আরো অনেকের।