গরমকালে পান্তা...
গরমকাল এসে গেল…
আর সব ভাতের মধ্যে পান্তা নিয়ে বাঙালির যা নস্টালজিয়া, তেমনটি আর অন্য কিছু নিয়ে নেই। ভাতে জল ঢেলে কাঁচা বা শুকনো লঙ্কা দিয়ে পেঁয়াজ, কাসুন্দি, ভাজা আর চচ্চড়ি দিয়ে খাবার মজাই আলাদা। কাসুন্দির মিঠেকড়া মোলায়েম স্বাদের পাশে বিলিতি মাস্টার্ড যে টিকতে পারবে না, সে কথা তো মুজতবা আলি সায়েব কবেই বলে গেছেন। পান্তার মধ্যে আছে এক অদ্ভুত সরল জীবনচর্চা, অপচয় বিরোধী মনোভাব আর জ্বালানি বাঁচানোর প্রচেষ্টা।
ঢাকায় নাকি নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয় পান্তা খেয়ে। তার আবার নানা আয়োজন — বেগুনপোড়া, আলুভাতে, মৌরলা মাছ। রামকানাইয়ের বড় ভাইয়ের যখন যায় যায় অবস্থা, তখন তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী চিংড়ি মাছের ঝাল চচ্চড়ি আর ডাঁটা সহযোগে যে পান্তাভাত খাচ্ছিলেন, তা স্বয়ং রবিঠাকুর বলে গেছেন। বাল্যশিক্ষার একটি শিশু ছড়ায় পাই: 'পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে কাপড় দিয়ে গায়/ গোরু চরাতে পাঁচন হাতে রাখাল ছেলে যায়।' মঙ্গলকাব্যেও গর্ভবতী নিদয়ার খেতে সাধ হয়েছিল 'বাসি ব্যঞ্জন দিয়া পান্তাভাত'।
পান্তাকে বরিশাল জেলায় বলে পসুতি ভাত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় গরম ভাতে জল ঢেলে খাওয়া হয়। তাতে নাকি দারুণ পুষ্টি — এ ভাতের নাম তাই পোষ্টাই। খেলে পেট ঠান্ডা হয়। দুর্গাপুজোর দশমীর দিন মাকেও পান্তাভাত আর কচু দেওয়ার রীতি আছে। তিনদিন নানা ভালোমন্দ খাবার পর যাবার দিন পান্তাভাত খেলে শরীর ঠান্ডাও থাকে আর বর শিব জিজ্ঞেস করলে দুঃখু-দুঃখু মুখ করে বলাও যায় গরীব বাপ বেশি কিছু খাওয়াননি। শীতলা পুজোর আগের দিন ভাত রেঁধে পান্তা করে পরের দিন তা দেবীকে দেওয়া হয় — ভক্তরা নিজেরাও খান।
ভারতের ইতিহাসেও নাকি পান্তার নাম আছে। কথিত আছে, নবাবের তাড়া খেয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস এক মুদির দোকানে লুকোন। তাকে ইতিহাস কান্তবাবু নামে চেনে। কান্তবাবুর ভালো নাম কৃষ্ণকান্ত নন্দী। বাবা রাধাকৃষ্ণ নন্দী। আদি বাড়ি ছিল বর্ধমানের সিজনা গ্রামে। সেখান থেকে কান্তবাবু চলে এসেছিলেন কাশিমবাজারে। খিদেতে প্রাণ যায় যায় হেস্টিংসের। সেখানে কাঁচা লঙ্কা, চিংড়ি আর পান্তা খেয়ে সায়েবের প্রাণ বাঁচে। সে থেকে কাশিমবাজার অঞ্চলে হেস্টিংসের নাম হয় পান্তা সায়েব। বাঙালি সে ঘটনাকে ছড়ায় অমর করে রেখেছে:
হেস্টিংস সিরাজভয়ে হয়ে মহাভীত
কাশিমবাজারে গিয়া হন উপনীত।
কোন স্থানে গিয়া আজ লইব আশ্রয়
হেস্টিংসের মনে এই নিদারুণ ভয়।
কান্তমুদী ছিল তাঁর পূর্ব পরিচিত
তাহারি দোকানে গিয়া হন উপনীত।
মুস্কিলে পড়িয়া কান্ত করে হায় হায়
হেস্টিংসে কি খেতে দিয়া প্রাণ রাখা যায়?
ঘরে ছিল পান্তাভাত আর চিংড়ি মাছ
কাঁচা লঙ্কা, বড়ি পোড়া, কাছে কলাগাছ।
সূর্যোদয় হল আজি পশ্চিম গগনে
হেস্টিংস ডিনার খান কান্তের ভবনে।
হেস্টিংস যেদিন গভর্নর জেনারেল হলেন সামান্য কর্মচারী থেকে, সেদিনও তিনি ভোলেননি দুঃখের দিনের উপকারী বন্ধু কান্তবাবুকে। তাকে করে নিয়েছিলেন নিজের প্রিয়তম সাগরেদ।
তাই আর যা-ই করুন, পান্তাকে হেলাফেলা করবেন না মোটেই…
কৌশিক মজুমদার: ভারতীয় বিজ্ঞানী ও লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।