অনাহারে থাকবে না একটি কুকুরও
সিলেট নগরীর মদন মোহন সরকারি কলেজে বসানো হয়েছে অস্থায়ী চুলা। বিকেল হলেই শুরু হয় রান্নার আয়োজন। সন্ধ্যার পরপরই মোটরসাইকেলে করে রান্না করা খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তারা। ওই খাবার নগরীর বিভিন্ন সড়কগুলোতে ঘুরে বেড়ানো কুকুরদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
প্রতিরাতে পাঁচটি টিম পাঁচটি মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ায় নগরীর অলিগলিতে। শতাধিক কুকুরের মাঝে করা হয় খাবার বিতরণ।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে চলমান সাধারণ ছুটিতে দেশে চলছে অঘোষিত লকডাউন। বন্ধ রয়েছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট। সড়কে মানুষের চলাচলও কম। তাই বিপাকে পড়েছে সড়কের বেওয়ারিশ কুকুরগুলো। খাবার সঙ্কটের কারণে হিংস্র হয়ে ওঠে ওরা। সড়কে হঠাৎ মানুষজন দেখতে পেলেই কুকুরগুলো তেড়ে আসত, ঘিরে ধরত।
লকডাউনে বিপাকে পড়া বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর কথা ভেবে সিলেটে ২৮ মার্চ থেকে শুরু হয় এই খাবার বিতরণ। এরপর চলছে একটানা। প্রথমে স্বল্প পরিসরে শুরু হলেও দিনদিন বাড়ছে পরিধি।
ভূমিসন্তান বাংলাদেশ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন প্রথম এই কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমে বিতরণ করা হতো শুকনো খাবার। পরে সংগঠনেরই এক সদস্যের বাসায় রান্না করে রাতে খাবার বিতরণ করা হতো। ভূমিসন্তানের এমন উদ্যোগে অগ্রহী হন আরও অনেকে। পেট লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে আরেকটি প্রাণীপ্রেমী সংগঠন যুক্ত হয় তাদের সঙ্গে। ব্যক্তি উদ্যোগে যুক্ত হন আরও কয়েক তরুণ।
স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা বাড়ায় বাড়ানো হয় কাজের পরিধি। এখন প্রায় পুরো নগরীতে ক্ষুধার্ত কুকুরের খোঁজে ঘুরে বেড়ান তারা। কাজের পরিধি বাড়ায় বাসার বদলে রান্না শুরু হয় মদন মোহন কলেজে।
এমন উদ্যোগের ব্যাপারে ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবির বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মানুষের মতো বেওয়ারিশ পশুগুলোও বিপাকে পড়েছে। মানুষদের মধ্যে অনেকে সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এলেও সড়কের কুকুরদের ব্যাপারে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে কুকুরগুলো দিন দিন হিংস্র আচরণ শুরু করেছিল। আমরা ছোট পরিসরে ২৮ মার্চ থেকেই এ কার্যক্রম শুরু করি। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয় রান্না করা খাবার বিতরণ। এরপর আরও অনেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
তিনি বলেন, কেউ কেউ আগে থেকেই এ কাজ করে আসছিলেন। এখন আমরা সবাই সমন্বিতভাবে খাবার বিতরণের কাজ করছি।
যতদিন সঙ্কট থাকবে, ততদিন খাবার বিতরণ করা হবে বলে জানান তিনি।
আশরাফুল কবির আরও বলেন, স্বেচ্ছাসেবী ছাড়াও নগরীর অনেক লোক আমাদের চাল-ডালসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করছেন।
পেট লাভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অরুপ শ্যাম বাপ্পী বলেন, আমাদের এই উদ্যোগ দেখে আরও অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন। কয়েকটি পাড়ার তরুণরা তো বলেই দিয়েছেন, তাদের পাড়ায় আমাদের আর যেতে হবে না। তারা নিজেরাই প্রতিদিন পাড়ার কুকুরগুলোর খাবার দেবেন। আমার মনে হয় এটাই আমাদের বড় সাফল্য। সবাই প্রাণীদের কষ্ট বুঝতে পারছেন।
সাংস্কৃতিক সংগঠক বিমান তালুকদারও যুক্ত রয়েছেন এই কাজে। তিনি বলেন, প্রথমদিকে আমাদের দেখেও কুকুরগুলো তেড়ে আসত। এখন আমাদের মোটরসাইকেল দেখামাত্র সবাই চুপচাপ এসে জড়ো হয়। প্রতিটি এলাকার কুকুরগুলো আমাদের অনেকটা পথ এগিয়েও দেয়।
কুকুরদের এই খাদ্যসহায়তা কর্মসূচীর প্রতিদিনকার রান্নাবান্নার ধকল সামলান বাপন তালুকদার। বিকেল হলেই বিশাল ডেগে রান্না চড়াতে হয় তাকে। যেন বিয়ে বাড়ির আয়োজন।
বাপন বলেন, আমরা কুকুরগুলোর মধ্যে সাধারণত খিচুড়ি বিতরণ করি। খিচুরির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মাংস, ঘিলা-কলিজা এগুলোও থাকে। মাঝে মধ্যে শুকনো খাবারও বিলি করি।
মৌলভীবাজারে ২০০ কুকুরকে একমাস ধরে খাবার
এদিকে, মৌলভীবাজার পৌর এলাকায় থাকা প্রায় ২০০ কুকুরকে গত একমাস ধরে খাবার দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপ কমিটির সদস্য সুয়েল আহমদ। শহরের সকল হোটেল রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় তিনি নিজ উদ্যোগে ৭ এপ্রিল কুকুরদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। স্থানীয় প্রাণীপ্রেমিদের প্রশংসা কুড়িয়েছে তার এ উদ্যোগ।
সুয়েল আহমদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, পৃথিবীতে সব প্রাণীর বাঁচার অধিকার রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমতো মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণীদের পাশেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। মানুষের যেমন খাদ্যের দরকার, বোবা প্রানীদেরও দরকার। তাই আমি তাদের কথা ভুলে যাইনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহ্বায়ক আ স ম সালেহ সোহেল জানান, এটা খুবই দরকারি ছিল। মানুষের পাশাপাশি কুকুরেরও বেঁচে থাকা দরকার। এদের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানসিকতা সবার থাকে না। এটি মহৎ উদ্যোগ।