স্ট্রিমিং জমানায় প্রথম ধর্মঘটের মুখে হলিউড
গ্লোবাল স্ট্রিমিং সার্ভিসের বিকাশের যুগে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে আমূল পরিবর্তন এবং ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাওয়ার অভিযোগ তুলে আজ মঙ্গলবার (২ মে) থেকে ধর্মঘটে যাচ্ছেন হলিউডের হাজার হাজার টিভি ও চলচ্চিত্র লেখকেরা। খবর রয়টার্সের।
স্ট্রিমিং সার্ভিসের যুগে এই প্রথম ধর্মঘটের মুখে পড়েছে এ ইন্ডাস্ট্রি। হলিউড সর্বশেষ ধর্মঘটে পড়েছিল ২০০৭ সালে।
এবার ওয়াল্ট ডিজনি কো. এবং নেটফ্লিক্স ইনক. এর মতো স্টুডিওগুলোর কাছ থেকে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়ার বিষয়ে একটি চুক্তিতে আসতে ব্যর্থ হওয়ার পর গত ১৫ বছরের মধ্যে প্রথম এ ধরনের কর্মবিরতিতে যাচ্ছে রাইটারস গিল্ড অব আমেরিকা (ডব্লিউজিএ)।
এর আগে ২০০৭ সালে লেখকদের বেতন ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে এএমপিটিপি'র (অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রডিউসারস) সঙ্গে একটি অচলাবস্থার মধ্যেই ধর্মঘটে গিয়েছিলেন ডব্লিউজিএ'র সদস্যরা। রয়টার্সের দেওয়া তথ্যমতে, সর্বশেষ ধর্মঘটটি ১০০ দিন পর্যন্ত চলেছিল এবং এর ফলে ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতিতে ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।
নিজেদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে ডব্লিউজিএ বলেছে, "কোম্পানিগুলোর আচরণ ইউনিয়নের মধ্যে একটি 'গিগ ইকোনমি' তৈরি করেছে এবং এই আলোচনায় তাদের অটল অবস্থানের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়েছে এবং লেখালেখির পেশাকে আরও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।"
নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং অন্যান্য জায়গার প্রায় ১১,৫০০ লেখকের প্রতিনিধিত্ব করে রাইটারস গিল্ড অব আমেরিকা। মঙ্গলবার বিকাল থেকেই হলিউড স্টুডিগুলোর বাইরে তাদের পিকেটিং শুরু করার কথা রয়েছে।
এদিকে স্টুডিওগুলোর প্রতিনিধিত্ব করা সংস্থা অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রডিউসারস (এএমপিটিপি) সোমবার জানিয়েছে, তারা লেখকদের 'পারিশ্রমিক অনেকটাই বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে', কিন্তু দুই পক্ষ কোনো চুক্তিতে আসতে পারেনি।
এই মুহূর্তে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো একটি কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাবস্ক্রাইবার আকৃষ্ট করতে প্রোগ্রামিং এর পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পর ওয়াল স্ট্রিট থেকে কনগ্লোমারেটদের চাপ দেওয়া হচ্ছে তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিসকে লাভজনক করে তোলার জন্য।
স্ট্রিমিং সার্ভিসের বিকাশ এবং এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার ফলে টেলিভিশনের দর্শক কমে গিয়েছে এবং বিজ্ঞাপনদাতারাও মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় টিভি বিজ্ঞাপন থেকে আয় হ্রাস পেয়েছে। তার উপর বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিই মন্দার মুখে পড়ার ঝুঁকিও দেখা দিয়েছে।
এর আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ডব্লিউজিএ'র ধর্মঘটের ফলে প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কর্মহীন লেখক, অভিনেতা ও প্রযোজকরা খরচ করা কমিয়ে দেওয়ার ফলে ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতিতে আনুমানিক ২.১ বিলিয়ন ডলার লোকসান হয়।
এএমপিটিপি এবং রাইটারস গিল্ডের মধ্যে আলোচনাটি এমন একটি সময়ে এসেছে যখন উভয় পক্ষই সমস্যার মধ্যে আছে। সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন শো প্রযোজনা করা বহু মিডিয়া ও টেক প্রতিষ্ঠান, যারা লেখকদের সাহায্য নিয়ে কাজ করে, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের স্টকের দাম কমে গিয়েছে। ফলে কর্মী ছাঁটাই থেকে শুরু করে ব্যয় সংকোচনের নানা উদ্যোগ নিয়েছে তারা।
কিন্তু হলিউডের লেখকদের সামনেও বিকল্প চাকরির সুযোগ অনেক কম এবং এদের অনেকেই শুধুমাত্র লেখালেখির মাধ্যমে নিজেদের ভরণপোষণ চালাতে পারেন না। সেই সঙ্গে গতানুগতিক ব্রডকাস্ট ও ক্যাবল প্রোগ্রাম থেকে সরে ইন্ডাস্ট্রি এখন স্ট্রিমিং সার্ভিসের দিকে ঝুঁকে পড়ায় তাদের আয়ের উৎসও কমে এসেছে।
ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "কোম্পানিগুলো লেখকদের পেছনে ব্যয় কমাতে এখন স্ট্রিমিং সার্ভিসের দিকে ঝুঁকেছে… ফলে সকল শ্রেণীর সিরিজ লেখকদের জন্য কাজের পরিবেশ আরও খারাপ হয়েছে। বেশিরভাগ লেখকই অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও খুব কম সময়ের জন্য কাজ করছে, বিগত দশকে সিরিজ নির্মাণের ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও মাঝামাঝি অবস্থানকারী লেখক-প্রযোজকদের পারিশ্রমিক হ্রাস পেয়েছে।
এনবিসি নিউজ সূত্রে জানা যায়, ইউনিয়নের যে দলটি নেগোসিয়েশন করছে, সেই দলের একজন সদস্য ড্যানিয়েল সানচেজ-উইটজেল গত ১১ এপ্রিল প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় বলেন, "এটা কোনো সাধারণ নেগোসিয়েশন না। আমরা লেখকদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও আমাদের পেশার স্থিতিশীলতার জন্য লড়াই করছি।"
রাইটারস গিল্ড এর পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে টিভি সিরিজ লেখকদের অর্ধেকেই ন্যূনতম বেতনের আওতায় কাজ করছে; ২০১৩-১৪ মৌসুমে যা ছিল এক-তৃতীয়াংশ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এ আলোচনায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্টুডিওগুলো যেন লেখকদের আগের কাজগুলো থেকে এআই ব্যবহার করে নতুন স্ক্রিপ্ট তৈরি না করে, সেই নিশ্চয়তা চায় ডব্লিউজিএ। লেখকেরাও চান, তাদেরকে যেন এআই'র সাহায্যে লেখা খসড়া স্ক্রিপ্ট পুনঃলিখন করতে না দেওয়া হয়।
এদিকে উভয় পক্ষের এই দ্বন্দ্বের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কিছু কিছু টিভি প্রোগ্রাম প্রচারে বাধা পড়তে পারে।
'জিমি কিমেল লাইভ' এবং 'দ্য টুনাইট শো উইথ জিমি ফ্যালন'-এর মতো যেসব শো'তে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে জোকস লিখতে লেখকদের প্রয়োজন হয়, সেসব শো'র প্রোডাকশন তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মানে, টিভিতে নির্ধারিত সময়ে নতুন এপিসোডগুলো প্রচারিত হবে না এবং অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিসেও মানুষ পরদিন তা দেখতে পারবে না।
এছাড়াও, আগামী শরত মৌসুমে যেসব শো আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল, লেখকদের ধর্মঘটের ফলে সেগুলো পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।