কেউ কেউ ভাষার অ্যাকসেন্ট হারালেও কেন অনেকে তা পারেন না?
একজন ব্যক্তি কীভাবে কথা বলেন সেটি তার পরিচয়ের একটি অন্তর্নিহিত অংশ। এটা অনেকটাই গোষ্ঠীভিত্তিক, এর ফলে বক্তা চিহ্নিত হয়ে যান তিনি কোন সামাজিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সেটি। একই ভাষার বিভিন্ন অ্যাকসেন্ট যেমন বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আলাদা করে, ঠিক তেমনি ব্যক্তি নিজেকে কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত ভাবেন কিনা সেটিও এর মাধ্যমে বোঝা যায়।
এরপরও আমরা এমন কিছু ব্যক্তিদেরকে দেখতে পাই, যারা তাদের আঞ্চলিক অ্যাকসেন্ট 'হারিয়েছেন' বলে মনে হয়, আবার অনেককেই দেখা যায় যাদের অ্যাকসেন্ট অত্যন্ত প্রকট। কথা বলার ধরনের ওপরেই অনেক সময় ব্যক্তির ব্যক্তিগত এবং সামাজিক গুরুত্ব নির্ভর করে। তাহলে অ্যাকসেন্টের এই রহস্য কী?
আপনি হয়তো আপনার অ্যাকসেন্টকে আপনার শারীরিক অংশ হিসেবে ভাবেন, কিন্তু বাস্তবে অন্যদের সাথে মানিয়ে চলার একটি সচেতন বা অবচেতন ইচ্ছা আপনার কথা বলার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করতে পারে, সেটি আপনি চান অথবা না চান।
গবেষণায় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি যদি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে নিজেকে মনে করে, তবে সেই গোষ্ঠীর অ্যাকসেন্ট তার মধ্যে চলে আসে। অ্যাকসেন্ট হলো কথা বলার একটি মুক্ত বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি অস্ট্রেলিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার জন্য যান, তবে তারা হয়তো সচেতনভাবে অথবা অবচেতনভাবে তাদের উচ্চারণ পরিবর্তন করবেন।
তাছাড়া নিজেকে আরও স্পষ্টভাবে অন্যদের কাছে প্রকাশ করার জন্য, বোঝানোর জন্য কিংবা নতুন গোষ্ঠীর সাথে মানিয়ে চলার জন্য অ্যাকসেন্ট পরিবর্তন করে থাকেন অনেকে। আবার অনেকে উপহাস এড়ানোর জন্যেও তাদের অ্যাকসেন্টে পরিবর্তন আনতে পারেন।
একাত্মতার অনুভূতি
যাদের অ্যাকসেন্ট পরিবর্তন হয় তাদের কাছে তাদের পরিচয়ের ধারণার চেয়ে তাদের কথা বলার ধরন কম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অথবা এমনও হতে পারে তাদের সামাজিক বা পেশাদার অবস্থান তাদের অ্যাকসেন্টকে পরিবর্তন করতে বেশি চাপ দেয়।
আমাদের জন্ম হওয়ার আগে থেকেই আমরা আমাদের চারপাশের লোকদের কথা বলার ধরনের সাথে পরিচিত হই। নবজাতকদের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা যায়, তাদের কান্নার শব্দ থেকেই টোনাল দিকগুলো শণাক্ত করা সম্ভব, যেগুলো নির্দেশ করে গর্ভকালীন সময়ে তার আশেপাশে থাকা কমিউনিটির কথা বলার বৈশিষ্ট্য। আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য শুরু থেকেই আমরা নিজেদেরকে প্রোগ্রাম করে নেই। আমরা এমন এক কণ্ঠস্বর তৈরি করি, যেগুলো আমাদেরকে বড় করা গোষ্ঠীর সাথে মিলে যায়। এরপর আমাদের স্পিচ প্যাটার্নের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় এমনভাবে হতে থাকে, যেন আমাদের অ্যাকসেন্ট আমাদের আশেপাশের ব্যক্তিদের মতোই হয়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিবার ও প্রতিবেশী ছেড়ে সমাজের অন্যান্য অংশের সাথে পরিচয় ঘটার পর আমরা নতুন নতুন স্পিচ প্যাটার্নের সাথে পরিচিত হই। এ কারণেই বিদ্যালয়ে কোনো শিশুর উচ্চারণ দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে, যার মাধ্যমে তারা তাদের সমবয়সীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক, যিনি কাজের সূত্রে যুক্তরাজ্যে বাস করেন, জানান যে, তার বাচ্চা স্কুলে যাওয়ার পর থেকে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে প্রচলিত অ্যাকসেন্টে কথা বলা শুরু করেছে। তিনি এখন তার বাচ্চাকে 'সঠিক অ্যাকসেন্টের ইংরেজি' শেখাচ্ছেন।
শক্তিশালী পরিচয়
এদিকে যাদের অ্যাকসেন্টের তেমন পরিবর্তন হয় না, তারা তাদের জাতিগত পরিচয়ে নিরাপদ বোধ করে থাকেন। তাদের উচ্চারণটি সেই পরিচয়ের বড় একটি অংশ হিসেবে মনে করেন তারা। এছাড়াও হতে পারে তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অ্যাকসেন্টটি মূল্যবান এবং সেটি তিনি অবচেতনভাবেই করে আসছেন। যদি একজন বক্তার কাছে তার কথা বলার উচ্চারণ পছন্দ হয়, তবে তিনি এটি সংশোধন করে এ পছন্দ করা সুবিধা হারাতে চাইবেন না।
সচেতনভাবে হোক অথবা না হোক, নিজের মূলে ফিরে যাওয়ার সময় লোকেরা তাদের কথাবার্তার ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখে। তবে ব্রেইন ড্যামেজ, স্ট্রোক, অথবা বিরল ক্ষেত্রে ফরেন অ্যাকসেন্ট সিন্ড্রোমের কারণে এর হেরফের হতে পারে। ব্যক্তির নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই এমন শারীরিক পরিবর্তনের ফলে এই সিন্ড্রোম দেখা যায়। মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু অংশ ভাষা তৈরি এবং সেগুলো বোঝার সাথে যুক্ত। আবার অন্য আরেক অংশ আমাদের কথা বলার মোটর দিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে, বক্তারা অনেকসময় কথা বলার ক্ষমতা একেবারে হারিয়ে ফেলেন, আবার অনেকসময় তাদের শব্দ উচ্চারণ করার পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে যায়। কারণ তখন তারা বুঝতে পারেন, তাদের মোটর এলাকা কণ্ঠস্বর বের করা অঙ্গগুলোতে ভিন্ন নির্দেশনা পাঠাচ্ছে। এর একটি চরম উদাহরণ সম্প্রতি দ্য মেট্রোতে উঠে এসেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অ্যাবি ফ্রেঞ্চ নামের একজন নারী অস্ত্রোপচারের পর ফরেন অ্যাকসেন্ট সিন্ড্রোমসহ জেগে উঠেছিলেন। ফ্রেঞ্চের দাবি অনুযায়ী, তিনি অনেকসময় রুশ, ইউক্রেনীয় অথবা অস্ট্রেলীয়দের মতো অ্যাকসেন্টে কথা বলছেন।
কিছু ক্ষেত্রে, শ্রোতারা ফরেন অ্যাকসেন্ট সিন্ড্রোমের ব্যক্তিদেরকে বিদেশি মনে করে তাদের সাথে ভিন্নভাবে আচরণ করে থাকেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, কেবল আমাদের কথা বলার ধরনই কীভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।
তবে অনেক ব্যক্তিই যে তাদের আশেপাশের ব্যক্তি অনুযায়ী, তাদের কথা বলার ধরন পরিবর্তন করে ফেলেন তা শুনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।