আগামী এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে
ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষা অবকাঠামো ও উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে কোভিড-১৯-এর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৬২ শতাংশ বেশি বরাদ্দ পেতে যাচ্ছে শিক্ষা খাত।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের সংশোধিত এডিপির ১৮,৪৩১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে শিক্ষা খাতের জন্য আগামী এডিপিতে ২৯,৮৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এ বরাদ্দ প্রস্তাবিত মোট এডিপির ১১.৩৬ শতাংশ যা সবগুলো খাতের এডিপির মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ।
পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য খাতেও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৬,২০৪ কোটি টাকার এ প্রস্তাবিত বরাদ্দ চলমান অর্থবছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি।
অন্যান্য খাতের মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে এডিপিতে সর্বোচ্চ ৭৫,৯৪৪.৬২ কোটি টাকার বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্ক, এবং রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প ও মাতারবাড়ি কয়লা বিদুৎ প্রকল্পের উন্নয়নে এডিপিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৪,৩৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অগ্রাধিকার
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি ৭,২১৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপিতে ১৪,৩৫৮ কোটি টাকার বড় বরাদ্দ পাচ্ছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব (উন্নয়ন) মোল্লা মিজানুর রহমান মনে করেন, নতুন যুগে প্রবেশ করছে শিক্ষা খাত।
তিনি বলেন, নতুন শিক্ষা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বড় বরাদ্দের প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষা কারিকুলামেরও পরিবর্তন হচ্ছে, তাই অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নও প্রয়োজন। এ কারণে শিক্ষা খাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দেও বড় উল্লম্ফন দেখা গেছে — ৭,৭৮৫ কোটি টাকা থেকে বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়টির যুগ্মসচিব (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, আগামী অর্থবছরে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) বাস্তবায়ন জোরদার করতে এ বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। পিইডিপি-৪ কর্মসূচিতে আগামী অর্থবছরের চাহিদা প্রায় ৮,৫০০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া শিক্ষার্থীদেরকে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ ও নিয়মিত স্কুলমুখী করার মাধ্যমে ঝরে পড়া রোধ করতে স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ পরিমাণ অর্থ এখনো অপর্যাপ্ত। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পরিমাণগত দিক থেকে প্রতিবছর বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়লেও, শিক্ষার্থীদের সংখ্যাবৃদ্ধির কথা বিবেচনা করলে এ বাড়তি বরাদ্দ তেমন বেশি নয়।
সরকারের নীতিনির্ধারণী নথিপত্রে শিক্ষায় ব্যয়বৃদ্ধি বাড়িয়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত করার অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে তিনি শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে সরকারকে আহ্বান জানান।
'অন্য অনেক খাতের মতো শিক্ষা খাতে কোনো মেগা প্রকল্প নেই। যদি শিক্ষায় এখন পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া না হয়, তাহলে আগামী ১৫–২০ বছর পর আমাদেরকে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার জন্য বাইরে থেকে জনবল নিয়োগ দিতে হবে।'
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম টিবিএসকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য হলো কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা।
তিনি মানবসম্পদ উন্নয়ের ওপর জোর দিয়ে বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাই এ মুহূর্তে অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানবসম্পদ উন্নয়ন।
প্রতিমন্ত্রীর মতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ মানবসম্পদে বিনিয়োগের সমতুল্য।
তিনি বলেন, শিক্ষা খাতে — বিশেষ করে যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ও ল্যাব সুবিধা প্রয়োজন — সেগুলোতে সরকারকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে। একইভাবে শিক্ষার অন্যান্য স্তরেও অনেক উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। আর ভৌত অবকাঠামোতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার।
এছাড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ও উন্নয়নের প্রয়োজন এবং দেশকে স্বনির্ভর করতে স্বাস্থ্য খাতে সরকারকে অর্থ ব্যয় করতে হবে। প্রতিমন্ত্রী মনে করেন, চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মানুষের বিদেশমুখিতাকে রোধ করতে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, সরকার অর্থ বরাদ্দের পাশপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যাতে এ অর্থ ব্যয় করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। এজন্য প্রকল্প ও প্রোগ্রামের উপযুক্ত বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং ব্যবস্থাও জোরদার করা হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরে ১৫টি খাতে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত এডিপির মধ্যে বৈদেশিক সহায়তায় ৯৪ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দুর্বল বাস্তবায়ন বনাম স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের বড় বৃদ্ধি
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, স্বাস্থ্য খাতকে সরকার অগ্রাধিকারে রেখেছে — বিশেষ করে কোভিড-পরবর্তী সময়ে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করা যায় না।
চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে ১৯,২৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু আগের বরাদ্দ অব্যবহৃত পড়ে থাকায় সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ১২,৭৪৫ কোটি টাকা করা হয়েছিল।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। কিন্ত এ বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার সবচেয়ে কম।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বরাদ্দের মাত্র ২৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট-এর অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান বাজেটের বরাদ্দের চেয়ে তিন গুণ বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন।
সরকারের জানানো ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হারের ওপর ভিত্তি করে আগের অর্থবছরের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে বরাদ্দ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে স্বাস্থ্যখাতের চাহিদা মেটাতে এ বৃদ্ধি পর্যাপ্ত হবে না।
'দুর্বল বাস্তবায়নের কারণে যদি বছরের মাঝামাঝি সময়ে বরাদ্দ কমিয়ে ফেলা হয়, তাহলে বরাদ্দের ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি কোনো কাজে আসবে না।'
ড. হামিদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খরচ, বিশেষ করে ফ্যাসিলিটি পর্যায়ে খরচ ব্যবস্থাপনার অক্ষমতা। অডিটের আশঙ্কায় ব্যয় কমিয়ে রাখা হয়। পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর মামলার মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কারণে চাকরিও চলে যেতে পারে।
তিনি মনে করেন, স্বাস্থ্যে ব্যয় বাড়াতে এ ভয়ের পরিবেশ দূর করতে হবে। দুর্নীতি একটি উদ্বেগের বিষয়, কিন্তু এটিকে অন্য উপায়ে দমন করতে হবে। এসব উপায়ের মধ্যে থাকতে পারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিট ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা।
ড. হামিদের মতে, অন্য খাতে বিলম্ব হয়তো গ্রহণযোগ্য, কিন্তু হাসপাতাল সেবায় ঘাটতি থাকলে তা-তে মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হবে।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, চলমান বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প যেমন কর্ণফুলি টানেল, মেট্রো রেল, যমুনা রেল সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ও মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন ইত্যাদিতে অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী অর্থবছরে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ এডিপি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
তারা আরও জানান, কর্ণফুলি টানেল, পদ্মা রেল সংযোগ, ও দোহাজারী–কক্সবাজারের মতো যোগাযোগ অবকাঠামোর বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এগুলোর বাস্তবায়ন কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।
এছাড়া বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে আগারগাঁও–কমলাপুর মেট্রোরেল লাইন (এমআরটি-৬) প্রকল্প। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ সাবওয়ের (এমআরটি-১) নির্মাণকাজ পুরোদমে শুরু হবে আগামী বছর। পাশাপাশি মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়নের কাজেও গতি আসবে।
হযরত শাহজালান বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের মতো প্রকল্প এবং বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর মতো বড় ব্যয়ের প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজেও আরও গতি বাড়বে বলেও জানান পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।