ভালুকার বিলাসবহুল রূপ
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকশিত এক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ময়মনসিংহের ছোট্ট শহর ভালুকা। খুব শিগগিরই সেই অর্জনের মুকুটে জুড়বে আরো পালক – একটি পাঁচ তারকা মানের বিলাসবহুল হোটেল, উচ্চ মানের বেসরকারি আবাসন প্রকল্প, বিশ্বখ্যাত একটি বিদ্যালয়ের শাখা, আর একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল।
বর্ধনশীল শহরটিকে এখানে চাকরি আর ব্যবসার কাজে বসবাসকারী এবং ভ্রমণে আসা মানুষের জন্য সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত করতে এসব প্রকল্প নিয়েছে বেস্ট হোল্ডিং লিমিটেড (বিএইচএল)।
৮৫০ একর জমির ওপর এসব প্রকল্পে গ্রুপটি বিপুল অঙ্কের বা ৩,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। এতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে বলে জানান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশে নির্মাণ খাতের একজন অগ্রদূত আমিন আহমেদ।
ভালুকায় বস্ত্র, সিরামিক, ওষুধ ও ফ্লোট গ্লাস-সহ বিবিধ পণ্য উৎপাদন করছে শত শত কারখানা। প্রতিনিয়ত আসছেন দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা। তাদের চাহিদা মাথায় রেখে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মাওনার কাছে ২২৮ কক্ষের এক বিলাসবহুল হোটেল- ম্যারিয়ট ভালুকা গড়ে তোলা হবে। এটি হবে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনালের হোটেল।
সম্প্রতি রাজধানীর নিকুঞ্জে অবস্থিত তার অফিসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমিন আহমেদ বলেন, আসলে পুরো এলাকাটি জুড়েই গড়ে তোলা হবে একটি টাউনশিপ; থাকবে আটটি ব্যাংকের শাখা, ১২০টি শোরুম আর দুটি সিনেপ্লেক্স।
ম্যারিয়ট ভালুকা হোটেলের পাশাপাশি, ভালুকার মামারিশপুরে ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনালের একটি বিলাসবহুল কালেকশন ব্র্যান্ড রিসোর্ট 'দ্য মসলিন'-ও নির্মাণ করছে বিএইচএল।
কিন্তু, কোন বিষয়টি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভালুকা উপজেলায় বিলাসবহুল হোটেল ও স্কুল নির্মাণে এত টাকা বিনিয়োগে আমিন আহমেদকে আগ্রহী করেছে?
এপ্রসঙ্গে তার ব্যাখ্যা হলো, এই এলাকায় ও আশেপাশে প্রায় পাঁচ হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে আসেন বহু বিদেশি। কিন্তু, তাদের থাকা বা অবসর কাটানোর কোনো ভালো বন্দোবস্ত নেই। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আতিথেয়তার এই ঘাটতির দিকটিই তাকে ভালুকায় বিলাসবহুল হোটেল, রিসোর্ট ও স্কুল নির্মাণে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করেছে।
ঢাকার বিলাসবহুল হোটেলগুলোর চেয়ে ভালুকার হোটেল ও রিসোর্ট আরো দ্রুত বিনিয়োগের রিটার্ন দেবে এবিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েই তিনি এ উদ্যোগ নিয়েছেন।
আমিন আহমেদের অবকাঠামো উন্নয়নের অনুপ্রেরণা শুধু আতিথেয়তা খাতেই থেমে নেই। হেইলিবেরি ভালুকা নামে ১,০০০ শিক্ষার্থীর আবাসিক-সুবিধা সম্পন্ন উচ্চমানের স্কুল নির্মাণ করছেন তিনি। হেইলিবেরি যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি স্কুল। ভালুকার শাখাটি বাংলাদেশের বেস্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের সাথে তাদের একটি যৌথ উদ্যোগ।
আহমেদ বৈশ্বিকভাবে স্বনামধন্য এই স্কুল চেইনের ভালুকা শাখা নির্মাণে ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তিনি বলেন, 'প্রায় সবকিছুই প্রস্তুত, চলতি বছরেই স্কুলটি চালু হবে। পরিচালনার জন্য এক ব্রিটিশ প্রিন্সিপালকে নিয়োগ দেওয়া দেওয়া হবে'।
বড় স্বপ্ন-ই দেখেন আহমেদ
আমিন আহমেদ মনে করেন, বড় স্বপ্ন না থাকলে কেউ সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে পারে না। বাংলাদেশ ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, তারপরও দেশের বেসরকারি খাতের কোনো উদ্যোক্তা আজো শত কোটি ডলারের কোনো প্রকল্প নেওয়ার সাহস করেননি। বিষয়টি তাকে রীতিমতো বিস্মিত করে বলে জানান তিনি। টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে দূরদর্শীতা ও জ্ঞানের অভাবকেই এজন্য দায়ী করেন আমিন।
আহমেদ অবশ্য স্বপ্নটা বড় দেখতেই ভালোবাসেন। ১৯৮০'র দশকের শেষদিকে একজন ঠিকাদার হিসেবে ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। এরপর তিস্তা, ধরলা, ভৈরব, ব্রহ্মপুত্র, কাঞ্চন, ধলেশ্বরী, তৈলারদ্বীপ ও তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুসহ দেশজুড়ে দুই শতাধিক সেতু নির্মাণ করেছে তার প্রতিষ্ঠান।
এখন আর তিনি সরকারি নির্মাণ ব্যবসায় নেই। ২০০৯ সাল থেকে নিজস্ব অবকাঠামো প্রকল্পেই মনোযোগ দিচ্ছেন। ঢাকায় লা মেরিডিয়ান হোটেলের মাধ্যমে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেন তিনি। যদিও এই যাত্রা যতোটা নির্বিঘ্ন হবে বলে প্রথমে তিনি ধারণা করেছিলেন, তা হয়নি।
২০০৬ সালে লা মেরিডিয়ান এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু, তারপরই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তা বন্ধ রাখতে হয়। নির্মাণ আবার শুরু হয় ২০০৯ সালে, অবশেষে ২০১৫ সালে হোটেলটির নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারেন তিনি। এরপর ২০১৬ সাল থেকেই এটি চালু করা হয়। তবে এরইমধ্যে তার ৪৬২ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ সুদের বোঝাসহ বেড়ে দাঁড়ায় ১,৮০০ কোটি টাকায়।
আমিন আহমেদ বলেন, 'ঋণের একটি অংশ ইক্যুইটি শেয়ারে রুপান্তর করতে পেরেছিলাম। তাছাড়া, হোটেলটি এখন মুনাফাও করছে'।
লা মেরিডিয়ান নির্মাণের সাফল্য তাকে বিলাসবহুল হোটেল প্রকল্প গ্রহণে আরো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
ভালুকায় যারা ব্যবসা ও অবসর কাটাতে আসছেন- তাদের কথা মাথায় রেখেই গড়ে তোলা হচ্ছে ম্যারিয়ট ভালুকা। এর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকেই চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পে ১,২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন আমিন আহমেদ।
এছাড়া, দ্য মসলিন লাক্সারি কালেকশন নামে ১,৩৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনালের বিলাসবহুল ব্র্যান্ড রিসোর্ট নির্মাণ করছেন তিনি। এটি চালু হবে ২০২৪ সালে। প্রায় ৫৭ একর জমিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে এই অভিজাত প্রকল্প।
এছাড়া, ৩০ একর জমিতে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০টি বিলাসবহুল ভিলা নির্মাণ করছেন তিনি। তিন বেডরুমের এসব ডুপ্লেক্স বাড়ি যারা ব্যক্তিগতভাবে কিনতে আগ্রহী তাদের কাছে বিক্রি করা হবে, আর রক্ষণাবেক্ষণে থাকবে ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল।
আতিথেয়তা খাতে আগ্রহী কেন হলেন?
আমিন আহমেদ অনেকটাই প্রচারবিমুখ। তিনি জানান, প্রায় ১৬ বছর আগে ভালুকায় ৮৫০ একর জমি কেনেন। কিন্তু, দেশে জমির আছে লক্ষণীয় সংকট, আর তা নিয়ে বিরোধও থাকে অনেক। এসব কারণে বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়ন গতি হারায়। এসব বিষয় তাকেও ভাবিয়ে তুলছিল। আর তখনই বড় কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে।
বর্তমানে এই জমিতেই তিনি অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প প্রকল্পসহ তার সব স্বপ্নের প্রকল্প গড়ে তুলছেন।
ভালুকায় ১,০০০ শয্যার একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও আছে তার। এজন্য কোনো আন্তর্জাতিক হাসপাতাল চেইনকে অংশীদার হিসেবে খুঁজছেন।
ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখযোগ্য সব অর্জনের পরও আমিন আহমেদ সাদামাটা জীবনযাপনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। জীবনযাপনের এই শিক্ষা তিনি সন্তানদেরও দিয়েছেন, যারা বাবার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের সুবিধা নেওয়ার চেয়ে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।