একাধিক গাড়ি থাকলে দ্বিতীয় গাড়ির জন্য কার্বন কর আসছে
কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, শহরের যানজট সমস্যার নিরসন এবং গণপরিবহনের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে আগামী অর্থবছর থেকে প্রথমবারের মতো কার্বন কর চালু করতে পারে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্যানুসারে, একাধিক গাড়ি আছে এমন করদাতাদের দ্বিতীয় গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও নবায়নের সময় ২৫ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি কর দিতে হবে।
কার্বন করের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে সর্বোচ্চ ইঞ্জিন সক্ষমতার গাড়ির ভিত্তিতে। অর্থাৎ একাধিক গাড়ি থাকলে যে গাড়ির সিসি ক্ষমতা বেশি হবে সেটির ওপর কার্বন কর ধার্য করা হবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক এক সভায় এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। ১৪ মে প্রস্তাবগুলো অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপন করা হবে।
কর্মকর্তারা বলেন, ২০২৩-৩৪ অর্থবছরের বাজেটে কার্বন করের প্রস্তাব উত্থাপন করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, উদ্যোগটি ভালো। তবে এই করের মাধ্যমে রাজস্ব আয় করার চাইতে পরিবেশের সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। তা না হলে এটি আরেক ধরনের সম্পদ করই হবে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) গবেষণা আইনজীবী বারিশ হাসান চৌধুরী বলেন, 'কার্বন কর চমৎকার উদ্যোগ। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি পরিবেশ নীতি এবং কর নীতি দুটো হিসেবেই কাজ করে।'
ফ্রেন্ডস অভ দি আর্থ এশিয়া প্যাসিফিক-এর রিজিয়োনাল ফ্যাসিলিটেটর বারিশ বলেন, আমাদের সতর্কত থাকতে হবে, যাতে উপযুক্ত মানুষদের করজালের আওতায় আনা যায়। এ করের প্রকৃত উদ্দেশ্য যদি কার্বন নিঃসরণ ও যানবাহনের ব্যবহার কমানো হয়, তাহলে এটি সেভাবেই আরোপ করতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ এ রাজ্জাক বলেন, পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বা অল্প সময়ের নোটিশে কার্বন কর আরোপ করা যুক্তিসংগত হবে না। 'সরকার যদি কার্বন কর আরোপ করতে চায়, তাহবে তার আগে একটা নীতিমালা তৈরি এবং জনগণকে সতর্ক করতে হবে,' বলেন তিনি।
কিন্তু কার্বন নিঃসরণ কমানোর চাইতে রাজস্ব আদায়ের দিকে সরকারের ঝোঁক বেশি মনে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন রাজ্জাক। এ সময় তিনি যুক্তরাজ্যের উদাহরণ দিয়ে বলেন, দেশটি তার জনগণকে সতর্ক করেছে দিয়ে বলেছে যে ২০৩০ সালের পর থেকে ডিজেলচালিত গাড়ির ওপর তারা কর আরোপ করবে।
চলতি অর্থবছরে সরকার মোটর গাড়ির সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। ২০০১ সিসি থেকে ৩০০০ সিসির গাড়ি আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫০ শতাংশ করা হয়েছে এবং ৩০০১ সিসি থেকে ৪০০০ সিসির গাড়ির সম্পূরক শুল্ক ৩৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার কার বা মাইক্রোবাসের ওপর কর ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করে। এর ফলে ১৫০০সসি পর্যন্ত ইঞ্জিন ক্ষমতার গাড়ির মালিককে বার্ষিক ২৫ হাজার টাকা কর দিতে হয়, যা আগে ছিল ১৫ হাজার টাকা।
৩৫০০ সিসির বেশি ইঞ্জিন ক্ষমতার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বা নবায়নের সময় ২ লাখ টাকা দিতে হবে, যা আগে ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এছাড়া আয়কর আইন অনুসারে, মালিকের কাছে দুই বা ততোধিক মোটরগাড়ি থাকলে প্রত্যেক বাড়তি মোটরগাড়ির জন্য করের হার ৫০ শতাংশ বাড়বে।
বর্তমানে অনেক দেশই মোটর যানবাহন ক্রয় বা ব্যবহারের ওপর তাদের করের ক্ষেত্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সংক্রান্ত নানা ধরনের কর আরোপ করছে।
অনেক দেশে করের পরিমাণ নির্ভর করে যানবাহনের জ্বালানি সাশ্রয়ের ওপর—যা কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।
'ইনসেনটিভস ফর কার্বন-ডাই-অক্সাইড এমিশন রিডাকশনস ইন কারেন্ট মোটর ভেহিকল ট্যাক্সেস' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মোটরগাড়ি থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাসের জন্য যে প্রণোদনা দেওয়া হয় তা অর্থনীতির অন্যান্য খাতে দেওয়া নিঃসরণ হ্রাস প্রণোদনার চেয়ে অনেক বেশি।
লন্ডন স্কুল অভ ইকোনমিকস-এর গবেষকদের পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সুইডেনে পরিবহন জ্বালানির ওপর কার্বন কর এবং মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তনের পর সুইডিশ পরিবহন খাত থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন গড়ে প্রায় ১১ বেসিস পয়েন্ট কমেছে। ৬ বেসিস পয়েন্ট হ্রাসের পেছনে কার্বন করের প্রভাব রয়েছে।
বিআরটিএ-র তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিআরটিএর নিবন্ধন পাওয়া মোট গাড়ির সংখ্যা ৫২ লাখ ৯২ হাজার ৪৪০টি; এর মধ্যে কার-এর সংখ্যা ৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৯১টি।