১৫৪ বছরে ঢাকার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি: পাঠক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, শহীদুল্লাহ, শামসুর রাহমান...
চারশো বছরের নগরী ঢাকা। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা এ শহর প্রথম রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছিল সেই ১৬১০ সালে। এরপর পেরিয়েছে বহুকাল। মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে, এসেছে ব্রিটিশ শাসন। ব্রিটিশরা চলে গেছে সে-ও শতবর্ষ হতে চলল। শুধু একটি বিষয় থেকে গেছে, তা হলো ইতিহাস।
এ অঞ্চলে ব্রিটিশদের শাসনকাল প্রায় দুশো বছরের। তারপর দেশ স্বাধীন হয়েছে দুবার। এসবের পরেও ব্রিটিশ আমলের অসংখ্য কীর্তি ও স্থাপনা এখনো টিকে রয়েছে দেশের আনাচেকানাচে। দুই শতকের শাসনচিহ্ন তো আর সহসাই মিলিয়ে যায় না, যেমন আচমকাই নিশ্চিহ্ন হয় না ঐতিহাসিক নিদর্শন।
ঢাকার প্রাচীনতম অংশে, বুড়িগঙ্গার তীরে তাই হরহামেশাই চোখে পড়ে ব্রিটিশ আমলের স্মৃতিচিহ্ন। পুরান ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরে এমনই এক কীর্তি চোখ এড়ায় না ইতিহাস সচেতন মানুষদের। এখানেই উনিশ শতকের শেষ ভাগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগার। ১৮৬৯ সালে বাংলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণের প্রধানতম পুরুষ রাজা রামমোহন রায়ের নামে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে হিসেবে গ্রন্থাগারটির বর্তমান বয়স ১৫৪ বছর। ইতিহাসের এত বাঁকবদল পেরিয়ে এসে আজকের দিনে কেমন চলছে গ্রন্থাগারটি? অতীতের ধুলো ঝেড়ে এখনো কি বই হাতে তুলে নেন পাঠক? নাকি ফেলে আসা সোনালি দিনগুলো রোমন্থন করেই দিন কাটাতে হয় গ্রন্থাগারিককে? চলুন জেনে নেয়া যাক ঢাকার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরির আদ্যোপান্ত।
শুরুটা যেভাবে
ঢাকায় প্রথম প্রেস বা ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৪৭-৪৮ সালে। ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা নিজেদের ধর্মবিষয়ক পুস্তিকা ছাপানোর জন্য মুদ্রণযন্ত্রটি ভারতবর্ষে এনেছিলেন। এরপর ১৮৫৬ সালে 'ঢাকা প্রেস' নামে আরেকটি মুদ্রণযন্ত্র ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকে প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা 'দ্য ঢাকা নিউজ'। ১৮৬০ সালে 'বাংলা যন্ত্র' নামে আরেকটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানেও বাংলা বই ছাপানো শুরু হয়।
উনিশ শতকের শেষ অবধি এ অঞ্চলে প্রায় ৪০ টি মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল। এসব প্রেস থেকে বইও প্রকাশিত হয় অগণিত। গ্রহাম শ-র এক জরিপে দেখা যায়, ১৮৫৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত মোট ৩৪৪২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ সময়ে ঢাকার ব্রাহ্মরা গ্রন্থ রচনা ও বিক্রির জন্য বেশ কিছু বইয়ের দোকানও খুলেছিল। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এমনটিই উল্লেখ করেছেন 'ঢাকার ইতিহাস' গ্রন্থে। ফলে অনুমান করা যায়, ঢাকা শহরে সে সময় একটি নিয়মিত পাঠক শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল।
তখনকার দিনে গ্রন্থাগার বলতে ছিল ব্যক্তিগত সংগ্রহ অথবা পারিবারিক লাইব্রেরি। কিন্তু ঢাকার মতো উঠতি শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের শহরে একটি পাবলিক গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই অনেকে উপলব্ধি করেছিলেন। তবে ব্রিটিশশাসিত বঙ্গদেশে পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগারের ধারণা উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের আগে ছিল না। ১৯৫৪ সালে ৪টি গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে গ্রন্থাগার আন্দোলনের সূচনা হয়। এগুলো হলো—বগুড়ার উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি, বরিশাল, রংপুর ও যশোর পাবলিক লাইব্রেরি।
ঢাকায় গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ নেয় পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজ। ঢাকায় ব্রহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়, ১৮৬৯ সালে প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অভয় চন্দ্র দাশ। প্রথমে ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরে লাইব্রেরিটি স্থাপিত হলেও পরে ১৮৮১ সালে আলাদা ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯০৭ সালে লাইব্রেরির নিজস্ব ভবন স্থাপনের জন্য ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক রতন মণি গুপ্ত পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করেন। অন্যান্য জায়গা থেকে আরও অর্থ সংগ্রহ করে মোট নয় হাজার টাকায় লাইব্রেরি ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯১০ সালের ২৮ জানুয়ারি স্যার কে.জি. গুপ্ত লাইব্রেরি ভবনটি উদ্বোধন করেন। তবে ২০১৫ সালে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি আবারও মন্দিরে স্থানান্তর করে পুনরায় চালু করা হয়।
ছিল সোনালি অতীত
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরিতে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব মনীষীর নিয়মিত পদচারণা ছিল। বিভিন্ন সময়ে এখানে সময় কাটিয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন সাহিত্য-সংস্কৃতির একেকজন দিকপাল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে শামসুর রহমান পর্যন্ত, অগণিত গুণী মানুষের উপস্থিতিতে মুখরিত থাকতো গ্রন্থাগার প্রাঙ্গন।
ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রমেশচন্দ্র মজুমদারের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আসেন। ওঠেন নবাবদের বিলাসবহুল হাউস বোটে। ২৬ ফেব্রুয়ারি লীলা রায়ের শ্রী সংঘের নারী সমাবেশে অংশ নিতে ব্রাহ্মসমাজের গ্রন্থাগারের আসেন তিনি। এ সমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেন। পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
অন্যান্য প্রখ্যাতজনের মধ্যে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজ ও গ্রন্থাগারের সাথে জড়িত ছিলেন। ফলে গ্রন্থাগারটি হয়ে উঠেছিল ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এ গ্রন্থাগারে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করতেন বাংলা ভাষার পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কবি জীবনানন্দ দাশ ১৯৩০ সালে বিয়ে করেন লাবন্য গুপ্তকে। তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল এ লাইব্রেরিতেই। ১৯৩০ সালে ব্রাহ্মমতে তাদের বিয়ে হয়। জীবনানন্দ দাশের মা, আরেক প্রখ্যাত কবি কুসুম কুমারী দাশও এখানে আসা-যাওয়া করতেন। এছাড়া কবি বুদ্ধদেব বসু, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, কাজী মোতাহার হোসেন এ গ্রন্থাগারে সময় কাটিয়েছেন। এখানে আসতেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। পরবর্তীতে কবি সুফিয়া কামাল ও শামসুর রহমান এ গ্রন্থাগারকে আলোকিত করেছেন। কবিগুরুর আগমনের ছেচল্লিশ বছর পর তার নাতি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসেন। তখন তিনি এই গ্রন্থাগারে এসেছিলেন।
গ্রন্থাগারে ছিল দুষ্প্রাপ্য সব বই ও পুঁথির সংগ্রহ। ছিল মূল্যবান নথি, সাময়িকী। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বাংলা ও ইংরেজি বই সংগ্রহ শুরু হয়। একসময় বইয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ হাজারে। তবে এখান থেকে বই ইস্যু করে বাড়িতে নেয়া যেত না। পড়তে হতো গ্রন্থাগারে বসেই।
ঢাকার এই গ্রন্থাগারটি শুরু থেকেই সাধারণ পাঠকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকত। প্রতিদিন এক-দেড়শো পাঠক এখানে পড়তে আসতেন। ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল জনশিক্ষা সম্প্রসারণ। সে উদ্দেশ্য পূরণে 'রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি' যথেষ্ট অবদান রেখেছিল। অল্পদিনে ঢাকায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এ গ্রন্থাগারটি।
মুক্তিযুদ্ধে যে ক্ষতি হয়েছিল
মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকার সবচেয়ে পুরাতন গণগ্রন্থাগারটিও। পাঞ্জাবিদের ইন্ধনে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরিতে হামলা চালায় পাক বাহিনী। মূল্যবান গ্রন্থ, পুঁথি, ডকুমেন্টস সব লুট হয়ে যায়। অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় গ্রন্থাগারটি। যুদ্ধের আগে এর সংগ্রহে ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মত গ্রন্থ। কিছু বই ও পুঁথি ছিল খুবই দুর্লভ।
যুদ্ধ শেষ হয়, স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। গ্রন্থাগার তখন আর আগের অবস্থায় ছিল না। স্বাধীনতার পর নতুন করে উদ্যোগ নেয়া হয়। গ্রন্থাগারটিকে নতুন করে চালু করা হয়। হারিয়ে যাওয়া বইপত্র ফিরিয়ে আনতে বিজ্ঞাপন দেয়া হয় পত্রিকায়। উচ্চমূল্যে কিনে নেয়ার কথা সে বিজ্ঞাপনে জানানো হয়। কেউই তেমন সাড়া দেয়নি। প্রবাসী পত্রিকার দুটি কপি ছাড়া আর কিছু ফেরতও পাওয়া যায়নি। ফলে তখন থেকেই জৌলুশ হারাতে থাকে গ্রন্থাগারটি। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ অবধি এসেছে।
কেমন চলছে গ্রন্থাগারটি?
পুরান ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলের পাশ দিয়ে হাঁটলে একটু সামনেই সুমনা হাসপাতাল। হাসপাতালের পাশে তিন নং লয়াল স্ট্রিটের গলিতে ঢুকে সামনেই ব্রাহ্ম মন্দিরের ফটক। ওদিক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে নানা প্রজাতির ফুলে ভরা বাগান। দুটি বড় কাঠগোলাপ গাছ থেকে একটু পরপরই ঝরে ঝরে পড়ছে ফুল। বাগানের সামনেই ব্রাহ্ম মন্দির। মন্দির প্রাঙ্গণ বিভিন্ন মনীষীদের ছবি ও বাণী দিয়ে সজ্জিত। রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের ছবি টাঙানো চতুর্দিকে। দর্শনার্থীদের জন্য লেখা রয়েছে আচরণবিধি।
এমন পরিবেশেই এক সময় বই পড়তেন পাঠকরা। তবে অনেক আগেই ফুরিয়েছে সেসব সোনালি দিন। শতবর্ষ পেরিয়ে এসে গ্রন্থাগারটি এখন কোনোমতে টিকে রয়েছে। নেই পাঠক, নেই বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে জৌলুশ। পাঁচ-ছয়শো বইয়ের ছোট একটি সংগ্রহ এখন। এর মধ্যে ব্রাহ্ম ধর্ম বিষয়ক বইয়ের সংখ্যাই সর্বাধিক। আছে রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন রায়ের বই।
কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তালাবদ্ধ থাকে লাইব্রেরি। দর্শনার্থী এলে খুলে দেওয়া হয়। অনেক সময় তা-ও দেয়া হয় না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) লাইব্রেরি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করায় ২০১৫ সালে মন্দিরে সরিয়ে আনা হয়েছিল সব কার্যক্রম। এখন সেটিরও সংস্কার চলছে। ২০০৪ সালে প্রায় দশ বছর বন্ধ ছিল কার্যক্রম। তেমন পাঠক না থাকায় এখনও খোলা হয় না। বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রনবীর রবি জানান, একটি মামলা চলমান থাকায় তিনি গ্রন্থাগার নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। ফলে লাইব্রেরির ভবিষ্যৎ যে দোদুল্যমান, তা অনুমান করা যায়।
প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, এদেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের চাইতে একটু বেশি। আধুনিক যুগে এসেও এ কথার মর্ম নিশ্চয়ই অনেকে বোঝেন। তাহলে কেমন হবে ঢাকার সবচেয়ে পুরাতন গণগ্রন্থাগারের ভবিষ্যতৎ? আবারও কি জেগে উঠবে আপন আলোয় নাকি সময়ের সাথে টিকে থাকত না পেরে হারিয়ে যাবে কালেরগর্ভে? ঢাকার সর্বপ্রথম গণগ্রন্থাগারটির পুনর্জাগরণই সকলের চাওয়া। যে উদ্দেশ্যে গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা অর্জন করতে হলে একে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
তথ্যসূত্র:
১. জীবনের সাতরং—সাঈদ আহমদ
২. Public Libraries in Bangladesh: History, Problems and Prospects—Azizul Hakim
৩. রনবীর পাল (রবি)—সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজ।