গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মা-ছেলের জয় ও আজমত উল্লাহর পরাজয়ের যত কারণ
সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ী হয়েছে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রবীণ রাজনীতিবিদ আজমত উল্লা খানকে তিনি হারিয়েছেন মোটামুটি বড় ব্যবধানে।
জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে আওয়ামী লীগের এমন পরাজয়ে ঘরোয়া রাজনীতিতে উঠেছে বেশকিছু প্রশ্ন। রাজনীতিতে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এমন ব্যবধানে জয়ী হলেন জায়েদা? গাজীপুরে আওয়ামী লীগের কৌশলে কোনো ভুল ছিল কি না, কেন সাধারণ মানুষ মা-ছেলের সমর্থনে গেল- এমন অনেক প্রশ্ন ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে সাম্প্রতিক এই সিটি নির্বাচন।
শুরুতেই নিজের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলম তার মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থী করেন।
তার ধারণা অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন দল সত্যিই তাকে মনোনয়ন দেয়নি, স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। তবে তার মায়ের প্রার্থীতা বৈধ হয়। জায়েদা খাতুনকে দেওয়াল ঘড়ি মার্কা দেওয়া হয়। যদিও এই ভোটে কোথাও ঘড়ি মার্কার পোস্টার-ব্যানার ও কেন্দ্রে এজেন্ট পর্যন্ত ছিল না। তারপরও জিতে যান জায়েদা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন জাহাঙ্গীর ও জায়েদা। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তার গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছে। এছাড়া, জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী-সমর্থকরাও নানানভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এতে তাদের প্রতি সাধারণ ভোটারদের একটি সহানুভূতি তৈরি হয়েছে।
মাত্র আড়াই বছর মেয়র থাকাকালীন অবস্থায় জাহাঙ্গীর আলম ব্যাপক উন্নয়ন করেন। জাহাঙ্গীর মেয়র থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর উন্নয়ন থেমে যায়, শহরে চাঁদাবাজি শুরু হয়; এতে নিম্ন আয়ের মানুষেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হন।
এছাড়া, শহরের উন্নয়ন কাজ যাতে ঠিকমত হয় সেজন্য জাহাঙ্গীর রাত-বিরাত, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েও প্রকল্পের কাজ তদারকি করেছেন নিজে উপস্থিত থেকে। এসব ঘটনা শহরের তরুণ ভোটারদেরকে তার প্রতি টেনেছে।
সেইসঙ্গে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল এবং জাহাঙ্গীর আলম পোশাক শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকায় এই শ্রেণির বিশাল পরিমাণ ভোটও ছিল তার পক্ষে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মন জয় করে চলেছেন জাহাঙ্গীর। যা আজমত উল্লা খানের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। যার কারণে প্রকাশ্যে নৌকার সমর্থন করতে বাধ্য হলেও ভিতরে ভিতরে অনেক নেতাকর্মীই জাহাঙ্গীরকে সমর্থন দিয়েছেন।
মহানগর আওয়ামীলীগের ঘনিষ্ট একটি সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পিছনে যেই বিষয়গুলো কাজ করেছে, তার মধ্যে একটি হলো গাছা ও টঙ্গী এলাকার ভোটের ফলাফল। গাছা ও টঙ্গী এলাকাকে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর এই দুই এলাকায় জাহাঙ্গীরের প্রভাব ব্যাপক।
সূত্র আরও জানায়, "তৃণমূল আওয়ামী লীগের যারা নৌকার পক্ষে শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে, ভিতরে ভিতরে তাদের বড় অংশই জাহাঙ্গীরের সমর্থক।"
"পাশাপাশি জাহাঙ্গীর শুধু আওয়ামীলীগ নয়, মেয়র থাকাকালীন বিএনপির সাথেও তার ভাল যোগাযোগ ছিল। ফলে বিএনপির ভোটগুলোও পেয়ছে জায়েদা খাতুন। আবার জাপা প্রার্থীর যেই পরিমাণ ভোট কাটার কথা ছিল, তার কিছুই করতে পারেনি এম এম নিয়াজ উদ্দিন। এটাও আওয়ামী লীগের যেই কৌশল ছিল, সেটিকে কার্যকর করতে পারেনি," জানায় সূত্র।
আরেকটি দিক জায়েদা খাতুনের বিজয়ের পক্ষে কাজ করেছে, আর সেটি হলো 'পাবলিক সিম্প্যাথি' বা জনগণের সহানুভূতি। নির্বাচনের শুরু থেকেই জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বিভিন্ন পর্যায়ে বাতিল, তার গাড়িবহরে হামলা থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘটনা ভোটারদের দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে।
এছাড়া অনেক কাউন্সিলর, যারা সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে আনায় মূল কাজ করেছেন, তারাও জায়েদাকে ভোট দিয়েছেন।
সেইসঙ্গে, নির্বাচনের আগে পুলিশ বিভিন্নভাবে জাহাঙ্গীরের সমর্থকদের হয়রানি করলেও শেষ মুহূর্তে হার্ড লাইনে থাকে তারা। যার কারণে কেন্দ্র এবং কেন্দ্রের বাইরে যথেষ্ট আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী থাকলেও তারা ভোটকেন্দ্র দখল বা এ ধরনের কিছু করার সুযোগ পায়নি।
ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, "নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে দলীয় প্রধান এমন মন্তব্যও করেছে যে আমি দেখতে চাই, আসলেই গাজীপুরে আমার কোনো লোক আছে কিনা। আওয়ামী লীগ যেমন দেখায়ে চেয়েছে- সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব, একইসাথে বিজয়ও চেয়েছে এই সিটিতে। আবার এই ধারণাও আগে থেকেই আওয়ামী লীগের ছিল যে পরাজয় হতে পারে। কিন্তু সরকারের হাই কমান্ড দেখতে চেয়েছে মাঠের অবস্থা।"
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লা মন্ডল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরাজয়ের কারণ তো নিশ্চয়ই আছে, তবে কেন হয়েছে তা এখনই না জেনে বলা যাবে না। সব বিষয় আমরা বিশ্লেষণ করব। দায়িত্বশীল জায়গা থেকে ভালোভাবে নিশ্চিত না হয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার উচিত হবে না। তবে সব বিষয়ই আমাদের মাথায় আছে। আমরা বিষয়গুলো, কারণগুলো, কিংবা সমস্যাগুলো যাই বলেন, বিশ্লেষণ করে তারপর হয়তো এ বিষয়ে কথা বলতে পারবো।
"কিংবা সমস্যা কোথায় ছিল, কর্মীদের মধ্যে কোনো সমস্যা ছিল কি না, সেগুলো বুঝতে পারবো," যোগ করেন তিনি।
এই নির্বাচনী ফলাফলের উপর ভিত্তি করে কৌশলগত কোনো পরিবর্তনের কথা ভাবছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "সেগুলো তো ভাবতেই হবে। কিন্তু তার আগে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে জানা, বোঝা দরকার সমস্যাগুলো কোথায় হয়েছে।"
তিনি বলেন, "মাঠের রাজনীতিতে অনেক হিসাব-কিতাব কাজ করে।"
দলের অনেক নেতাকর্মী, জায়েদা খাতুন তথা জাহাঙ্গীরকে সমর্থন ও তার পক্ষে কাজ করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "যেটি হয়েছে যে, তিনিও (জাহাঙ্গীর আলম) তো এই মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। কাজেই দীর্ঘদিন তার সঙ্গে থাকার কারণে একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়াটাতো খুবই স্বাভাবিক।"
"আবার বিএনপি মাঠে না থাকলেও কাজে কিন্তু ছিল। সুতরাং আমরা বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করছি," বলেন তিনি।
দলীয় অভ্যন্তরীণ কোনো কোন্দল আছে কি না এমন প্রশ্নে এই নেতা বলেন, "তেমন কিছু আমার চোখে পড়েনি কখনো। তারপরও সবকিছুই আমরা বোঝার চেষ্টা করবো।"
গত ১ মে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিলের পর ১৫ মে জাহাঙ্গীরকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। এরপরেই নিজের মাকে রাজনীতিতে আনার পদক্ষেপ নেন সাবেক এই মেয়র।
স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আজমত উল্লাহ পেয়েছেন ২২২,৭৩৭ ভোট। দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল ১৬ হাজার ১৯৭।