সম্ভাবনাময় পাদুকা শিল্পে করোনার থাবা
প্রায় এক যুগ ধরে পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত মো. রিগান। এই শিল্প থেকে তিনি প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করেন। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের পীরবাড়ি এলাকার অ্যাকটিভ ফুটওয়্যার নামে একটি জুতা কারখানায় আপারম্যান হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কারখানার পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। নিজের সংসার চালানোর পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতেও বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠান।
কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রিগান। বাসা ভাড়া বকেয়া পড়েছে দুই মাসের। ঘরে পর্যাপ্ত খাবারও নেই। বাধ্য হয়ে সংসার চালানোর অর্থ যোগাতে গিয়েছিলেন ধান কাটতে। কিন্তু শ্রমিকদের মতো ধান কাটতে না পারায় ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। তাই এখন মানবেতর দিন কাটছে রিগান ও তার পরিবারের।
রিগানের মতো করুণ অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্ভাবনাময় পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় তিন হাজার শ্রমিকের। করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৫ মার্চ থেকে জেলার সকল পাদুকা তৈরির কারখানা বন্ধ রয়েছে। এতে করে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা। উৎপাদন বন্ধ থাকলেও কারখানার ভাড়া ও বৈদ্যুতিক বিলসহ আনুষাঙ্গিক ব্যয় ঠিকই মেটাতে হচ্ছে।
জুতা তৈরির জন্য মজুদ করে রাখা প্রয়োজনীয় অনেক কাঁচামালও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে এখন পর্যন্ত আট কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এছাড়াও কারখানা বন্ধের কারণে দৈনিক কয়েক লাখ টাকার জুতা বিক্রি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
মাহমুদ আলী নামে ভারতের পাটনা শহর থেকে আসা এক ব্যবসায়ী ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমারশীল মোড়ে একটি পাদুকা কারখানা স্থাপন করেন। বর্তমানে জেলা শহরের পীরবাড়ি, নাটাই, ভাটপাড়া ও রাজঘরসহ কয়েকটি এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড়শ কারখানা সচল রয়েছে।
গুণগত মানসম্পন্ন ও দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় চট্টগ্রাম, সিলেট, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জুতা নিয়ে যান। প্রতি জোড়া জুতা পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত রোজার মাসকেই পাদুকা শিল্পের মৌসুম ধরা হয়। এই মৌসুমে ব্যবসায়ীরা কয়েক লাখ টাকা করে মুনাফা করেন। পাশাপাশি শ্রমিকরাও বাড়তি কিছু টাকা আয় করেন।
শুধুমাত্র রোজার মাসেই বড় কারখানাগুলো থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে আট লাখ টাকার জুতা বাজারজাত করা হয়। আর ছোট কারখানাগুলোতে গড়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকার জুতার চাহিদা থাকে পাইকারদের। তাই ঈদুল ফিতর কেন্দ্রিক বাজার ধরার জন্য এক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেন পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা রোজা শুরুর ১৫-২০দিন দিন আগে থেকে রাত-দিন মিলিয়ে কাজ করেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে এবারের মৌসুমে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন পাদুকা ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরাও।
উৎপাদন বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের বেতনও দিতে পারছেন না কারখানা মালিকরা। এতে করে মানবেতর দিন কাটছে প্রায় তিন হাজার শ্রমিকের। চক্ষুলজ্জায় লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ সহায়তাও নিতে পারছেন না অনেকে।
অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের আপারম্যান মো. রিগান জানান, রোজার মাসে কাজ করে বাড়তি ৫-১০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। এ টাকা দিয়েই পরিবারের সবার জন্য ঈদের নতুন জামা-কাপড় এবং অন্যান্য সামগ্রী কিনেন। কিন্তু এবার সেই বাড়তি আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস।
সংসার চালানোর পাশাপাশি বাবা-মাকেও টাকা পাঠাতে হয় তার। কিন্তু এখন নিজেই চলতে পারছেন না। এভাবে কারখানা বন্ধ থাকলে না খেয়ে মরা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না বলে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানান তিনি।
একই কারখানার সেলাইম্যান মো. সেলিম জানান, ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনিই সবার বড়। তাই পুরো সংসারের দায়িত্ব তার উপর। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে কারখানা বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে এখন কষ্ট হচ্ছে তার। কারো কাছ থেকে চেয়ে ত্রাণ সহায়তাও নিতে পারছেন না। অন্য কোনো কাজ না জানায় চরম কষ্টে দিন কাটছে তার পরিবারের।
আরেক আপারম্যান নাহিদুল ইসলাম বলেন, পাদুকা শিল্পের এমন দুর্দিন আগে কখনো দেখিনি। কাজ না থাকায় চরম অর্থকষ্টে দিন কাটছে আমাদের শ্রমিকদের।
'পেট তো আর ভাইরাস চেনে না। এভাবে আমরা কতদিন চলব? এই ভাইরাস আমাদের পথে বসিয়ে ছাড়বে' নিজদের দুর্দশার কথা এভাবেই প্রকাশ করেন তিনি।
ঈদুল ফিতরের কেনাকাটা করার সুবিধার্থে স্বাস্থ্য বিধি মেনে গতকাল ১০ মে থেকে সীমিত পরিসরে বিপণী বিতানগুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার। কিন্তু এই সিদ্ধান্তেও মুখে হাসি নেই পাদুকা ব্যবসায়ী-শ্রমিকদের। চলমান লকডাউনের কারণে জুতা তৈরির পর্যাপ্ত কাঁচামাল না আসায় চাহিদা অনুযায়ী জুতাও তৈরি করা যাচ্ছে না।
এ ছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে কারখানা বন্ধ থাকায় যে পরিমাণ লোকসান হয়েছে তা শুধুমাত্র ১০/১৫ দিন ব্যবসা করে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব না। তাছাড়া বিপণী বিতান খুললেও মানুষজন যাবেন কী না সেটি নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন পাদুকা ব্যবসায়ীরা।
অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের স্বত্বাধিকারী রাকিবুর রহমান বলেন, আমরা শ্রমিকদের কিছু সহায়তা করেছি। ব্যবসা বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছি না। কারখানায় উৎপাদন না থাকলেও লোকসান ঠিকই গুণতে হচ্ছে আমাদের। যে কাঁচামাল মজুত রেখেছিলাম সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। আমাদের সারা বছরের ব্যবসা হয় রোজার মাসে। এই রোজায় আমার কারখানা থেকে প্রতিদিন আট লাখ টাকার জুতা বাজারজাত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু ভেস্তে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পথে বসতে হবে।
দিশা সুজের সত্ত্বাধিকারী মো. নাদিম বলেন, শ্রমিকরা যে রিকশা চালিয়ে সংসচার চালাবে সে উপায়ও নেই। কারখানা বন্ধ হওয়ার আগেরদিন ধার-দেনা করে শ্রমিকদের বেতন দিয়েছি। এখন কারখানা বন্ধের কারণে শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে পারছি না। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই লোকসান গুণতে হচ্ছে। সারা বছর মার্কেটে যে বাকি দিয়েছি বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই টাকাগুলো উঠিয়ে আনা সম্ভব না। রোজা উপলক্ষ্যে আমার ফ্যাক্টরি থেকে অন্তত দুই লাখ টাকার জুতা বাজারজাত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু কারোনাভাইরাসের কারণে সেটি করতে পারছি না।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহসিন মিয়া বলেন, সারাবছর কষ্ট করি রোজার মাসে ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু এবার এই রোজার মাসেই আমাদের সবচেয়ে বেশি লোকসান হচ্ছে। অথচ এই মাসে একেকটি কারখানায় কয়েক কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করা হতো।
তিনি বলেন, সারাবছরের লোকসান আমরা এই মাসে ব্যবসা করে আমরা পুষিয়ে নিতে পারতাম। এখন আমাদের এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কারখানা খুলে দেয়ার পাশাপাশি সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন।