অবশেষে শ্যামপুরে সরছে পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) বাস্তবায়িত 'অস্থায়ী ভিত্তিতে রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য নির্মিত গুদাম' প্রকল্পের মাধ্যমে পুরান ঢাকার শ্যামপুরে ৫৪ অস্থায়ী রাসায়নিক গুদাম উদ্বোধন করা হয়েছে।
রোববার শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এর উদ্বোধন করেন।
এসময় শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন, শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা, বিসিআইসি চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
২০১৯ সালের মার্চে শুরু হয়ে সম্প্রতি প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ৭১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ধরা হলেও প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ৬২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এরমধ্যে জিওবি ৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং বিসিআইসি দিয়েছে ৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
৬.১৭ একর জমির ওপর নির্মিত এ প্রকল্পটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় ৫৪টি গুদাম ও তিনতলা বিশিষ্ট দুটি অফিস ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
পুরান ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম একটি নিরাপদ জায়গায় দ্রুততম সময়ে স্থানান্তরের লক্ষ্যে 'উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড' শ্যামপুর, ঢাকা এর স্থলে এ প্রকল্পটি জরুরিভিত্তিতে সরকার হাতে নেয়। এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।
যদিও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তৈরীকৃত তালিকা অনুযায়ী, পুরান ঢাকা এবং এর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে ১৯২৪টি কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে।
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক পদার্থের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১১৯ জন নিহত হয়।
পরবর্তীতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সেদিনের ঘটনায় ৭৮ জন প্রাণ হারায়।
এ দুটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ব্যাতীত আরও বেশ কয়েকটি ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে রাসায়নিক গোডাউনের কারণে। ফলে ২০১৯ সালের মার্চে শ্যামপুরের গোডাউন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
২০২০ সালের ৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের তালিকা তৈরির জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে সেই বছর ২০ ডিসেম্বর থেকে বিস্ফোরক জাতীয় প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল ব্যবসা পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে জরিপ শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি জানায়, দক্ষিণ সিটির তিনটি কর এলাকায় জরিপ করতে দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হায়দর আলী, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক ও প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনকে প্রধান করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ সরকারের আরও বিশেষ তিনটি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে টিমগুলো গঠন করা হয়।
টিমগুলো প্রায় ২ মাস সময় নিয়ে সে সময় দক্ষিণ সিটির কর অঞ্চল ৩, ৪ ও ৫ এ জরিপ কাজ পরিচালনা করে। পরবর্তীতে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে পুরান ঢাকায় বিদ্যমান বিস্ফোরক জাতীয় প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল ব্যবসা পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
তালিকায় অঞ্চল ৩, ৪ ও ৫ এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ১ হাজার ৯২৪টি কেমিক্যাল গোডাউনের তথ্য সরবরাহ করা হয়।
তালিকা অনুযায়ী, অঞ্চল-৩ এ ১৩০১টি, অঞ্চল-৪ এ ৫৮৫টি এবং অঞ্চল-৫ এ ৩৮টি রাসায়নিক গুদাম ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে অঞ্চল-৩ এর ইসলামবাগে পাঁচশোর মতো রাসায়নিক গুদাম ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো তালিকায় কেমিক্যালের ধরন এবং ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ও নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ গুদামের সংখ্যা এবং এসব গুদামে রাখা রাসায়নিক দ্রব্যাদির নামও উল্লেখ করা হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, "নিমতলী ও চুরিহাট্টা ট্রাজেডির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। অস্থায়ীভাবে নির্মিত এই রাসায়নিক গুদাম শীঘ্রই প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নিকট বরাদ্দ দেয়া হবে। টঙ্গীতে এরকম একটি গুদাম নির্মিত হচ্ছে।"
শিল্পমন্ত্রী আরও বলেন, "মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩১০ একর জমির উপর 'বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক' প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেখানে আমরা ভূমি উন্নয়ন করেছি। বাউন্ডারি নির্মাণ ও অন্যান্য ভৌত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছি। প্লট বরাদ্দ প্রক্রিয়াধীন আছে।"
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, বিস্ফোরক দ্রব্যের জন্য আলাদা গুদামঘরের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, এ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুরান ঢাকা থেকে এগুলো স্থানান্তর করা হবে। যারা এখানে গুদামে আসবেন তাদের কিন্তু আবারও বিনিয়োগ করতে হবে। তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
"আমরা বিশ্বাস করি, সকল বিপজ্জনক রাসায়নিক সামগ্রী ধীরে ধীরে স্থানান্তর হবে। একটি দুর্যোগপূর্ণ নগরী হিসেবে নয়, আমরা চাই, ঢাকা হোক দুর্যোগ সহনশীল বাসযোগ্য একটি নগরী।"
'পুরান ঢাকা রাসায়নিক দ্রব্যাদি স্থানান্তর নীতিমালা' দ্রুত প্রণয়নের দাবি জানিয়ে মেয়র তাপস বলেন, "ব্যবসায়ী প্রতিনিধি যারা আছেন, তাদের মতামতের ভিত্তিতে একটি নীতিমালা করে দ্রুত স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ নীতিমালা করতে যেন আবার কয়েক বছর লেগে না যায়। এ নীতিমালাটি যেন ব্যবসাবান্ধব হয়।"