ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে স্থবির দেশের হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
তীব্র তাপদাহ, সাথে ঘন ঘন লোডশেডিং। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। তবে এক্ষেত্রে রোগী ও শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীরা নূন্যতম স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। রাজধানীর বাইরে এ সংকট আরও তীব্র আকারে দেখা দিচ্ছে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা বিবেচনা করে সরকার রোববার ঘোষণা দিয়ে আগামী ৮ জুন পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করেছে।
সোমবার সব সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক বিভাগের সব ক্লাস ৮ জুন পর্যন্ত স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে ঘন ঘন লোডশেডিং-এর ভোগান্তি এড়াতে অনলাইনে কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। অনলাইন ক্লাস শুরু হবে আজ থেকে, চলবে ১১ জুন পর্যন্ত।
কিন্তু এখনো যেমন বেসরকারি ও সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু আছে, সেগুলোর একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তি
ডায়াবেটিস ও কিডনির সমস্যা নিয়ে রোববার বিকেলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ আস্কির আলী।
চিকিৎসক তাকে মূত্র ও রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেন। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বসেও পরীক্ষাগুলো করাতে পারেননি আস্কির আলী।
বিদ্যুৎ না থাকায় হাসপাতালের ল্যাবের কাজ বন্ধ ছিল। ফলে তার মতো আরো অনেক রোগীকেই ফিরে যেতে হয় হাসপাতাল থেকে।
ঢাকার নিকটবর্তী ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লোডশেডিংয়ের কারণে পানি উঠাতে সমস্যা হচ্ছে, ফলে হাসপাতালে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে।
হাসপাতালের একটি জেনারেটর থাকলেও সেটি দিয়ে শুধু অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। দিন-রাত অধিকাংশ সময় লোডশেডিং থাকার কারণে আইপিএস যে পরিমাণে চার্জ হয়, তা পুরো হাসপাতালের লোড নিতে পারেনা। ফলে মাত্র কয়েকটি লাইট জ্বলে।
ওয়ার্ডে দিন-রাত অধিকাংশ সময় অন্ধকারে থাকে রোগীরা। মশা, গরম ও অন্ধকারে অতিষ্ঠ রোগীরা হাসপাতালের নার্স, ডাক্তারদের সাথে খারাপ আচরণ করছে। হাসপাতালের টেস্ট, অফিসিয়াল কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে লোডশেডিংয়ের কারণে।
শুধু সিলেটের কোম্পানিগঞ্জের উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স বা ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স নয় লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়গনস্টিক সেন্টারে সার্ভিস ব্যাহত হচ্ছে। তীব্র গরমের কারণে জ্বর, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগীর চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে, আবার চিকিৎসা নিয়ে গিয়ে রোগীদের ভোগান্তিও বাড়ছে। তবে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে এ সংকট বেশি তীব্র।
ঢাকা, রাজশাহী, যশোর, খুলনা, সিলেট, রংপুরসহ দেশের ২০টির বেশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কথা বলে এ বিষয়ক তথ্য পাওয়া গেছে।
অধিকাংশ হাসপাতালে জেনারেটর বা আইপিএস দিয়ে ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্ট, আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটর চললেও ওয়ার্ডে মোবাইলের আলো বা মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের। হাতপাখা, কাগজ দিয়ে বাতাসের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার মোছাম্মৎ রাবেয়া সুলতানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গরমের কারণে রোগী অনেক বেড়েছে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে রোগীদের প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। রাতে লোডশেডিং অনেক বেড়ে যায়। জেনারেটর দিয়ে কেবল জরুরি সেবা চালু রাখা যায়। তখন সাধারণ ওয়ার্ডের রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অন্ধকারে সেবা চালু রাখতে তাদেরও হিমশিম খেতে হয়।
লোডশেডিংয়ে রোগীর দুর্ভোগের কথা জানিয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শাহজাহান বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে অনেক সময় খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। তাছাড়া জেনারেটর থাকলে্ও তা সবসময় চালু রাখা যায় না তেলের সংকটের কারণে।
আখাউড়া উপজেলার কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা রুবেল আহমেদ সোমবার সকালে রক্ত পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে দেখেন বিদ্যুৎ না থাকায় ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেও বিদ্যুৎ না আসায় পরীক্ষা না করেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিমেল খান জানান, আধাঘণ্টা পরপরই লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুত না থাকলে প্যাথলজি বিভাগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ব্যহত হয় জরুরি বিভাগের সেবা। এছাড়া শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের নেবুলাইজারও দেওয়া যায়না। যার ফলে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, "আমাদের জেনারেটর সুবিধা নেই। আইপিএস দিয়ে কয়েকটি বৈদ্যুতিক পাখা ও লাইট চলে। কিন্তু বিদ্যুৎ ছাড়া প্যাথলজি বিভাগ চালু করা যায়না। এতে করে পরীক্ষা-নীরিক্ষা বাবদ রাজস্ব আয় কমছে।"
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাবের ইনচার্জ বিদ্যুত রায় জানান, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে মেশিনগুলো বারবার বন্ধ হয়। এতে করে মেশিনের সমস্যা হচ্ছে। পরীক্ষারত অবস্থায় মেশিন বন্ধের কারণে আবার নতুন করে পরীক্ষার কাজ শুরু করতে হয়। এতে করে সময় লাগছে বেশি। রোগীদেরও পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।
যশোর ২৫০ বেড হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা হারুণ অর রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হাসপাতালে লোডশেডিং একটু কম। তাও প্রতিদিন অন্তত ২ ঘণ্টা ইলেক্ট্রিসিটি থাকেনা। আমাদের হাসপাতালে ৩টি জেনারেটর আছে। তবে সব ওয়ার্ডে জেনারেটর কানেকশন নেই।"
খুলনার রুপসা উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি জেনারেটর থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে অকেজো রয়েছে। লোডশেডিংয়ের সময় রোগীদের চরম ভোগান্তিতে পরতে হয়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডিরেক্টর ড মো খলিলুর রহমান টিবিএসকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার. আইসিইউ, লেবার ওয়ার্ড ও ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্ট জেনারেটর সাপোর্ট আছে। তবে ওয়ার্ডে জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। লোডশেডিংয়ে ওয়ার্ডের রোগীদের কষ্ট হচ্ছে।
সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো।
মোহাম্মাদীয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একজন মালিক মামুন অর রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রংপুরে বিদ্যুৎ থাকেনা, মাঝে মাঝে আসে। লোডশেডিংয়ের কারণে গতমাসে জেনারেটর চালাতে আমাদের ৬০ হাজার টাকার ডিজেল কিনতে হয়েছে। এ মাসে তো পরিস্থিতি আরো খারাপ মনে হচ্ছে। আমরা তো রোগীর কাছ থেকে বেশি টাকা নিতে পারছিনা। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা একেবারে শেষ হযে যাবে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, "আমরা হাসপাতালগুলোকে দুটো করে ইলেক্ট্রিক লাইন নিতে বলেছি। যেসব হাসপাতালের জেনারেটর নষ্ট আছে সেগুলো ঠিক করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে জেনারেটর চালানোর জন্য তেলের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। তাই আপাতত ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্ট, আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটর জেনারেটর ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।"
শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটছে বড় ধরনের ব্যাঘাত
অসহনীয় লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকছে।
মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা দিয়ে শিক্ষার্থীদের রোদে খেলাধুলা করা বন্ধ করেছে; এছাড়া সুস্থ থাকার জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করার কথাও বলেছে।
বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও মুখপাত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনায় তারা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় বন্ধ থাকছে লাইট-ফ্যান; এ অবস্থায় ক্লাস চালানো প্রায় অসম্ভব।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সিনিয়র কমিউনিকেশন অফিসার মো. ওয়াহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "লোডশেডিংয়ের কারণে লিফটগুলো দুই-তিন ঘণ্টা অচল থাকে এবং এগুলোতে কোনো এসি নেই। জেনারেটর লোড নিতে পারছে না। এতে ক্লাসের পাশাপাশি অফিসিয়াল কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।"
স্টেট ইউনিভার্সিটির জনসংযোগ ও বিপণনের সহকারী পরিচালক তারেক ওমর টিবিএসকে বলেন, "লোডশেডিং এমন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে যে জেনারেটর আর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।"
চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে সোমবার সকাল থেকেই স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ)।
কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানান, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, সাধারণত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুমগুলোতে তেমন একটা বাতাস চলাচল করতে পারেনা। বিদ্যুৎ না থাকলে এসব ক্লাসরুমে বসে থাকা কঠিন।
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী কাউসার আমীর আলী টিবিএসকে বলেন, "ঢাকা উত্তর ও টঙ্গী এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ১,৩০০ মেগাওয়াট। কিন্তু এ এলাকায় সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে ৩০৬ মেগাওয়াট। সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আমাদের এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করতে হচ্ছে।"
কবে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "কতদিন এমন চলবে সে বিষয়ে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে কোনো নোটিশ পাঠানো হয়নি, তবে মন্ত্রী বলেছেন দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।"