চীন-বাংলাদেশ 'বন্ধুত্বের দূত' হতে চায় আলিফা
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দা ১৩ বছর বয়সী কিশোরী আলিফা চীন। নিজের নামের শেষ অংশটির কারণে প্রায়ই তাকে চীনা ভেবে ভুল করেন কেউ কেউ। তবে জন্মসূত্রে চীনা না হলেও, আলিফার জন্মের সঙ্গেই এই দেশটির একটি বিশেষ সম্পর্ক জুড়ে গিয়েছে।
"আমার নামটা আমার অনেক পছন্দ। আমার মনে হয়, চীনের সাথে আমার একটা রক্তের সম্পর্ক আছে এবং আমার এই নাম বাংলাদেশ-চীনের বন্ধুত্বের প্রতীক", বলে আলিফা।
২০১০ সালে আলিফার জন্মের সময় যখন ঘনিয়ে আসে, তখন তার মা জান্নাতুল ফেরদৌসের হৃদরোগের কারণে সাধারণ ডেলিভারি সম্ভব ছিল না। স্থানীয় ডাক্তাররা ঐ সংকটপূর্ণ মুহূর্তে সার্জারি করাতেও পারছিলেন না। আবার রোগী যেকোনো সময় প্রসববেদনা উঠতে পারে সেই চিন্তায় তাকে অন্য শহরে স্থানান্তরও করা যাচ্ছিল না।
এমন সময়ে চীনা নৌবাহিনীর পিস আর্ক হসপিটাল শিপ চট্টগ্রামে এসে ভেড়ে, স্থানীয়দের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার জন্য। ওই জাহাজে থাকা চীনা ডাক্তার ও নার্সদের সহায়তায় জান্নাতুল ফেরদৌস একটি সুস্থসবল কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। তার স্বামী আনোয়ার হোসেন কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মেয়ের নাম রাখেন আলিফা চীন। ইংরেজি 'চায়না'কে বাংলায় চীন বলা হয়ে থাকে।
ফেরদৌস বলেন, "এখন আমাদের মনে হয় যে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বন্ধন রয়েছে। এই দুটি দেশ শুধু প্রতিবেশীই না, সত্যিকারের বন্ধুও।"
এবছর আলিফা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি চিঠি লেখে। অবাক করা ব্যাপার হলো, চীনা প্রেসিডেন্ট তার চিঠির জবাবও দিয়েছেন!
চিঠিতে শি জিনপিং আলিফা চীনকে ভালোভাবে পড়াশোনা করে নিজের স্বপ্নপূরণ করতে এবং চীন-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক জোরদার করার জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
আলিফা চীন জানায়, তার বন্ধুরা যখন জানতে পারে যে চীনা প্রেসিডেন্ট তাকে চিঠির উত্তর দিয়েছেন, তখন তারা তার প্রতি 'হিংসা' করে।
"প্রেসিডেন্টের প্রত্যাশা পূরণ করতে আমি সবসময় মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে চাই, যাতে আমি চীনে গিয়ে মেডিক্যাল সায়েন্সে পড়াশোনা করতে পারি এবং বড় হয়ে একজন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে পারি, ঠিক যেমন আমার চাইনিজ মামা আমার জন্য করেছে", বলে আলিফা চীন।
আলিফার বাবা আনোয়ার হোসেন বলেন, "আমরা ভাবতেই পারিনি যে চীনা প্রেসিডেন্ট আমাদের মেয়ের চিঠির জবাব দেবেন। এটা আমাদের জীবনে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা!" আলিফার পরিবার চিঠিটি ফ্রেমে বাঁধাই করে তাদের লিভিং রুমের দেয়ালে টানিয়ে রেখেছে।
'চাইনিজ মামা'
চট্টগ্রাম বন্দরে যখনই কোনো চীনা নৌবাহিনীর জাহাজ নোঙর করে, তখনই আলিফা চীনের পরিবার ছুটে যায় দেখতে যে তাদের 'চাইনিজ মামা' এসেছে কিনা। অর্থাৎ, যে চীনা চিকিৎসক আলিফাকে জন্ম দিতে তার মাকে সাহায্য করেছিলেন, তিনি এসেছেন কিনা
যে ব্যক্তির কথা তারা বলছেন, তার নাম শেং রুইফাং। আলিফার জন্মের সময় সেই পিস আর্ক হসপিটাল শিপ-এ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হিসেবে ছিলেন রুইফাং এবং স্থানীয় একটি হাসপাতালে আলিফার মায়ের সিজারিয়ান ডেলিভারিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন তিনি। চীনা মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞদের এবং তাদের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধপত্রের সহায়তায় এই সার্জারিটি করা হয়েছিল।
শেং রুইফাং এর ভাষ্যে, আলিফার মায়ের অস্ত্রোপচার ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। জাহাজ বন্দরে ভিড়তেই চীনা নৌবাহিনীর চিকিৎসকদের কাছে সাহায্য চেয়েছিল আলিফার পরিবার। "আমরা রাজি হয়েছিলাম অস্ত্রোপচার করতে, কারণ এখানে দুজনের জীবন জড়িয়ে ছিল", সেদিনের স্মৃতিচারণ করে রুইফাং জানান তাদের পুরো মিশনের সবচেয়ে জটিল সার্জারি ছিল এটি।
২০১০ সালে পিস আর্ক হসপিটাল শিপ ৮৭ দিনের মেডিক্যাল মিশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। জাহাজটি চিকিৎসা সেবা দিতে এডেন উপসাগর এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার পাঁচটি দেশ পরিদর্শন করে এবং বাংলাদেশ ছিল তাদের মিশনের শেষ স্টপেজ।
২০১৩ সালে যখন পিস আর্ক পুনরায় বাংলাদেশ পরিদর্শনে আসে, যখন চীনকে জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নৌবাহিনীর ডাক্তাররা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন।
২০১৭ সালে যখন চীনা নৌবাহিনীর একটি নৌবহর বাংলাদেশ সফরে আসেন, যখন চট্টগ্রাম বন্দরে চীনের সাথে আমারও দেখা হয় শেং রুইফাং এর। তিনি বলেন, "পতাকা ওড়াতে থাকা বহু লোকের মধ্যে আমি চীনকে দেখতে পাই, কালো কোঁকড়া চুলের সেই ছোট্ট মেয়েটা। তখনই সে আমাকে চুমু খেয়ে আমায় 'চাইনিজ মামা' বলে ডেকে ওঠে।"
এদিকে আলিফা চীনের বাবা আনোয়ার হোসেন জানান, ঐ চীনা জাহাজটি বাংলাদেশে আসায় স্থানীয় অনেক মানুষ উপকৃত হয়েছে। তিনি বলেন, "আমরা চাই এই জাহাজটি ভবিষ্যতে আবারও বাংলাদেশে আসুক।"
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীন এবং তার পরিবার চীনে বেড়াতে যায় এবং ঝেজিয়াং প্রদেশের ঝুশানে সেই হসপিটাল শিপে ওঠে। আলিফা বলে, এতগুলো বছর ধরে চীনের আংকেল-আন্টি তার খোঁজখবর রেখেছে, এটা তার কাছে খুবই ভালো লাগার বিষয়। "আমি চীনকে ভালোবাসি, আমি চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বের দূত হতে চাই।"
আলিফা চীন এখন ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। গণিত তার প্রিয় বিষয় এবং সে ছবি আঁকতে পছন্দ করে।
২০১৯ সালে চীন ও তার পরিবারকে আসলে চীনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ঐ ভ্রমণের সময়ই তার শেং রুইফাং এর সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটে। চীন জানায়, শেং এবং অন্যান্য ডাক্তাররা তাকে নিজের মেয়ের মতো করে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। চীন বলে, 'তিনিই (শেং) আমার কাছে সত্যিকারের হিরো।'
পিস আর্কের একাধিক মিশনে অংশগ্রহণ করা শেং রুইফাং দেখেছেন কিভাবে চিকিৎসা সহায়তার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মানুষ চীন সম্পর্কে ভালো ধারণা পাচ্ছে। তিনি বলেন, "আফ্রিকায় আমরা স্থানীয় অনেক মানুষকে চোখের ছানি অপারেশনে সাহায্য করেছি। স্থানীয়দের কাছে চীন এমন একটি প্রধান দেশ যারা দায়িত্বশীল, শান্তিপ্রিয় এবং সদা সাহায্য করতে প্রস্তুত।"
পিস আর্ক চালু হওয়ার পর থেকে ১০টি বিদেশী মিশন হাতে নিয়েছে, ৪৩টি দেশ পরিদর্শন করেছে এবং ২৫০,০০০ জনেরও বেশি মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছে।
শেং জানান, বাংলাদেশের একটা মেয়ের সঙ্গে 'মা-মেয়ের মতো' এই সম্পর্কটা তার জন্য খুবই অর্থবহ। "আমার মনে হয় বাংলাদেশ ও চীনের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে চলে আসছে, এই ঘটনা সেটারই প্রতীক", বলেন তিনি।
এদিকে আলিফা চীন জানিয়েছে, যদি আবারও চীনে যাওয়ার সুযোগ মেলে, তাহলে সে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও শেং রুইফাং এর সঙ্গে দেখা করতে যায় এবং চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে চায়।